গাড়িচালক এনায়েত আকবর ২৪ বছর বয়সী তরুণ। বিদেশ ফেরত যুবককে আনতে একই পরিবারের ১১ সদস্যকে নিয়ে তিনি ঢাকার হযরত শাহজালার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যান।
ফেরার পথে তিনি ছাড়াও প্রবাসীসহ গাড়িতে ১২ জন যাত্রী ছিলেন। ঘুম ঘুম চোখে গাড়ি চালাচ্ছিলেন তিনি। বারবার সতর্ক করা সত্ত্বেও তিনি কানো কথা কানে তোলেননি।
কুমিল্লায় দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে উঠতেই তাকে সতর্ক করে বিরতি নিতে বলা হয়। না শুনে তিনি চোখে ঘুম নিয়েই লক্ষ্মীপুরের উদ্দেশ্যে আসছিলেন। অবশেষে তার ঘুমের কারণেই গাড়িটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সড়কের পাশে খালে পড়ে পানিতে ডুবে পরিবারটির ৭ সদস্য মারা যান। দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে ফেরা প্রবাসী বাহার উদ্দিন এমনটাই অভিযোগ করেন।
এদিকে, গাড়িচালক আকবরের একটি ভিডিও টিকটকসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। কয়েকদিন আগেই তিনি নিজেই ভিডিওটি করেছেন। মিউজিকের সঙ্গে সেখানে বলতে শোনা যায়, ‘অল্প বয়সেই গাড়ি চালানো শিখেছি, ওস্তাদের ভালোবাসায় ড্রাইভার হয়ে গেছি। অল্পদিনে ওস্তাদে শিক্ষা দিছে মন ভইরা, তাই তো আজ গাড়ি চালাচ্ছি সারা দেশ ভইরা। আমার ওস্তাদের মনটা ছিল খুব নরম, আমার মাথাটা হেলপারি লাইফ থেকে কিন্তু খুব গরম। ড্রাইভারের সঙ্গে নিওনা কোনো পাঙ্গা, তাহলে কিন্তু ব্রেকের জায়গায় ধরব এক্সেলেটর, আর তোর দুনিয়াদারি করে দেবো ঠান্ডা’। কথাগুলো তার নিজের কণ্ঠের কি না তা জানা যায়নি। ধারণা করা হচ্ছে অন্য কারো কণ্ঠের সঙ্গে তিনি ভিডিও বানিয়েছেন।
নাম প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক জেলা শহরের রেন্ট-এ-কারের তিনজন গাড়িচালক বলেন, ‘মালিকপক্ষ কম বেতনে অদক্ষ চালক নিয়োগ দেয়। কয়েকবার চালালেই অটোগাড়িতে মোটামুটি কারো সমস্যা হয় না। তবে দক্ষতা প্রয়োজন। ঘুম আসলে গাড়ি থামিয়ে বিরতি নিতে হবে। যতটুকু শুনেছি, চালককে যাত্রীরা বিরতি নিতে বলেছিল, কিন্তু সে শোনেনি। ছোট মানুষ, দক্ষতা কম, দক্ষ চালক হলে ঘুম কাটানোর জন্য অবশ্যই সে বিরতি নিত। কিন্তু কারো কথা না শুনে তার খামখেয়ালির কারণেই এতগুলো প্রাণ গেল। তবে কোনো চালকই ইচ্ছে করে দুর্ঘটনা ঘটায় না, অনাকাঙ্ক্ষিত হয়ে যায়।
দুর্ঘটনাস্থল থেকে বেঁচে ফেরা প্রবাসী বাহার উদ্দিন বলেন, ‘কুমিল্লায় দুর্ঘটনার কবলে পড়তে পড়তে বেঁচে গেছি। কিন্তু চালকের ঘুমের কারণে বাড়ির কাছাকাছি এসে আমার পুরো পরিবার শেষ। তার দক্ষতা নিয়ে সন্দেহ ছিল। এ জন্য বাবাকে বকেছিলাম। তাকে আমিসহ অন্যরা গাড়ি থামিয়ে বিরতি নিতে বলেছিলাম, সে নেয়নি। আমার মা-নানি, স্ত্রী-মেয়ে, দুই ভাতিজি ও ভাবি চোখের সামনে ডুবে মারা গেল। আমরা তাদের বাঁচাতে পারলাম না। সে গাড়ির লক খুলে না দিয়ে পালিয়ে গেছে।’
চালক আকবরের বিষয়ে জানতে চাইলে বৃহস্পতিবার (৭ আগস্ট) দুপুর পৌনে ১২টার দিকে গাড়ির মালিক রাসেল মুঠোফোনে বলেন, ‘চালক আকবর ৬ বছর ধরে গাড়ি চালাচ্ছে। প্রথমে সে চালকের সহযোগী ছিল। এরপর সে নিজেই গাড়ি চালানো শুরু করে। ২ বছর ধরে সে দেশের বিভিন্ন জেলায় ভাড়া নিয়ে গেছে। দক্ষ চালক দেখেই তাকে গাড়ি দিয়েছি। গাড়িটি লোনে ক্রয় করেছি। যদি অদক্ষ চালক হতো, কখনোই গাড়ি দিতাম না। তার ড্রাইভিং লাইসেন্সও রয়েছে। লাইসেন্সবিহীন কোনো চালককে ঝুঁকি নিয়ে কেউই গাড়ি দেবে না।’
তবে ড্রাইভিং লাইসেন্স এই প্রতিবেদকের হোয়াটসঅ্যাপে পাঠাতে বললে তিনি সাংবাদিকদের দেবেন না বলে জানান।
রাসেল আরও বলেন, ‘ঘটনার পরপরই চালক আমাকে ফোন দিয়ে জানিয়েছে। আমি তাৎক্ষণিক ছুটে গিয়ে খালে নেমে আটকা পড়া লোকজনকে উদ্ধারের চেষ্টা করেছি। সবাই বলেছে ড্রাইভার পালিয়ে গেছে, কিন্তু সে পালায়নি। সে ঘটনার পর প্রায় ৪০-৪৫ মিনিট ঘটনাস্থলে ছিল। দুর্ঘটনায় সেও অসুস্থ হয়ে পড়ে। পরে তাকে হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে বলে শুনেছি। এখন তার মোবাইল ফোন বন্ধ, যোগাযোগ করতে পারছি না। ভুক্তভোগীরা রাগে-ক্ষোভে গাড়ির পেছনের গ্লাস ভেঙে ফেলেছে। পরিবারটি ৭ জন সদস্যকে হারিয়েছে, ঘটনাটি মর্মান্তিক এবং খুব বেদনাদায়ক। এ দুর্ঘটনায় গাড়ির ক্ষতি হয়ে আমিও বিপদে রয়েছি। চালক দক্ষ না হলে কখনোই কোনো মালিক গাড়ি দেবে না।’
অভিযুক্ত গাড়িচালক এনায়েত আকবর লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার হাজিরপাড়া ইউনিয়নের চরচামিতা এলাকার পাটওয়ারী বাড়ির মৃত ফয়েজ আহমেদের ছেলে।
হাজিরপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সামছুল আলম বাবুল বলেন, ‘নিহতদের বাড়ি আমার পাশের ইউনিয়নে, আমি দেখে এসেছি। চালক কে বা কারা তা আমার জানা নেই। কেউ আমাকে বলেওনি।’
আকবরের ড্রাইভিং লাইসেন্সের বিষয়ে জানতে বিআরটিএ লক্ষ্মীপুর কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মো. কামরুজ্জামানকে একাধিকবার কল দিলেও তিনি রিসিভ করেননি। কার্যালয়ে গিয়েও তাকে পাওয়া যায়নি।
তবে তার বরাত দিয়ে কার্যালয়ের মেকানিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট পবন চাকমা বলেন, ‘স্যার চাঁদপুরের অতিরিক্ত দায়িত্বে আছেন, তিনি সেখানে। দুর্ঘটনায় অভিযুক্ত চালকের তথ্যাদি পেতে হলে লাইসেন্সের কপি লাগবে, তা না হলে কোনো তথ্য বের করা সম্ভব নয়। এ ছাড়া দুর্ঘটনাটি হয়েছে নোয়াখালী। এ বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নিতে হলে তা নোয়াখালী বিআরটিএ কর্তৃপক্ষ নেবেন।’
এ ব্যাপারে চন্দ্রগঞ্জ হাইওয়ে থানার ওসি মোবারক হোসেন বলেন, ‘ঘটনার পর থেকে চালক আকবর পলাতক রয়েছে। তার লাইসেন্স আছে কি না, তাও বলতে পারছি না। তাকে আটক করতে পারলে তার বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য জানা যাবে।’
প্রসঙ্গত, মঙ্গলবার (৫ আগস্ট) রাতে পরিবারে ১১ সদস্য মাইক্রোবাসযোগে রাজধানীতে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যায় ওমান প্রবাসী বাহার উদ্দিনকে আনতে। সেখান থেকে বাহারকে নিয়ে ফেরার পথে নোয়াখালীর চন্দ্রগঞ্জ পূর্ব বাজারের অদূরে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে গাড়িটি প্রায় ৩০ মিটার গভীর খালে পড়ে। এ ঘটনায় পানিতে ডুবে ৪ নারী ও ৩ শিশু মারা যান। সেখান থেকে বেঁচে ফেরেন প্রবাসী বাহার, তার বাবা আব্দুর রহিম, শ্বশুর ইস্কান্দার মীর্জা, ভাবি সুইটি আক্তার ও শ্যালক রিয়াজ হোসেন।
তাদের দাবি, চালকের ঘুমের কারণেই দুর্ঘটনাটি ঘটেছে এবং পরিবারের ৭ সদস্য মারা গেছেন। নিহতরা সদর উপজেলার উত্তর জয়পুর ইউনিয়নের চৌপল্লী এলাকার বাসিন্দা।
আপনার মতামত লিখুন :