বরিশালের বিতর্কিত ছাত্রদল নেতা সবুজ আকনের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থাগ্রহণ করেছে হাইকমান্ড। স্ত্রীর বড় বোনের স্কুলপড়ুয়া মেয়েকে ধর্ষণের অভিযোগ প্রকাশ্যে আসতেই তুমুল আলোচনা-সমালোচনার মধ্যে তার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক পদক্ষেপ নেওয়া হয়।
রোববার (২৫ মে) ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সংসদ তাকে বহিষ্কার করে প্রেস বিজ্ঞপ্তি জারি করে। তবে বরিশালের এই আলোচিত ছাত্রদল নেতার বিরুদ্ধে কোন যুক্তিতে ব্যবস্থাগ্রহণ করা হয়েছে, তা বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ না করলেও বলা হয়েছে, দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে সবুজ আকনকে বহিষ্কার করা হয়।
এ নিয়ে বরিশাল ছাত্রদলের নেতাদের আনুষ্ঠানিক কোনো প্রতিক্রিয়া না পাওয়া গেলেও অনেকে বলছেন, সবুজের অপকর্মের ফিরিস্তি অনেক দীর্ঘ। কেন্দ্রীয় সংসদ তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগসমূহের প্রমাণ পেয়েই কার্যকর সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে। ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সূত্র নিশ্চিত করে বিষয়টি।
বাবুগঞ্জের বাসিন্দা সবুজ আকন বিগত দিনে আওয়ামী লীগবিরোধী আন্দোলন-সংগ্রামে ব্যাপক ভূমিকা রাখলেও গত বছরের ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পর তিনি অসংখ্য বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন। বিশেষ করে ক্ষমতার প্রভাব বিস্তার করে সরকারি ভূমি দখলে নেওয়াসহ চাঁদাবাজির মতো অভিযোগ রয়েছে এই ছাত্রদল নেতার বিরুদ্ধে।
বাবুগঞ্জের স্থানীয় একাধিক সূত্র জানিয়েছে, স্বৈরাচার শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পরে তাদের দোসর আওয়ামী লীগ নেতাদের বাসা-বাড়িতে হামলা-ভাঙচুর এবং আগুনে পুড়িয়ে দেওয়ার ভয়ভীতি দেখিয়ে তাদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের চাঁদা নেয় ছাত্রদল নেতা সবুজ আকন।
বিশেষ করে আওয়ামী লীগপন্থি ইউনিয়ন চেয়ারম্যানদের কাছ থেকে অর্থ নেওয়ার বিষয়টি আলোচনায় প্রাধান্য পাচ্ছে।
এ ছাড়াও ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে তিনি স্থানীয় একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সভাপতির চেয়ার দখল করেছেন, যা নিয়ে স্থানীয় বিএনপি নেতা-কর্মীদের মধ্যে ক্ষোভ রয়েছে।
এসব কর্মকাণ্ডে আলোচনা-সমালোচনা চলামান থাকার মধ্যেই এই ছাত্রদল নেতার বিরুদ্ধে স্ত্রীর বোনের ১৪ বছর বয়সী মেয়েকে ধর্ষণের অভিযোগ ওঠে। এই ঘটনায় স্কুলছাত্রীর মা বাদী হয়ে গত ২০ মে বরিশাল নারী ও শিশু নির্যাতন ট্রাইব্যুনালে মামলা করেন।
অবশ্য ছাত্রদল নেতা আত্মপক্ষ সমর্থনে একদিন বাদে অর্থাৎ ২১ মে বরিশাল প্রেসক্লাবে আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলন করে অভিযোগসমূহ অস্বীকার করেন এবং মামলাটি হয়রানিমূলক বলে দাবি করেন।
তখন তিনি ধর্ষণ মামলার বাদীর বিরুদ্ধে পাল্টা অভিযোগ তোলেন এবং বলেন, ‘জমিসংক্রান্ত বিরোধের জেরে তাকে ফাঁসানো হচ্ছে।’
তবে এই বক্তব্যের সপক্ষে সবুজ কোনো প্রমাণ দেখাতে পারেননি। ধর্ষণকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ার খবরটি মোটা দাগে ফলাও করে প্রকাশ করে স্থানীয়সহ দেশের প্রথম শ্রেণির গণমাধ্যমগুলো, যা নিয়ে কদিন বরিশালে সরব আলোচনা- সমালোচনা শোনা যায়। তখনই ধারণা করা যায়, বিতর্কিত ছাত্রদল নেতার বিরুদ্ধে শাস্তির খড়্গ আসছে।
তা ছাড়া ‘শত্রুভাবাপন্ন’ জেলা ছাত্রদলের একটি অংশও চাচ্ছিলেন সবুজের বিরুদ্ধে হাইকমান্ড যেন কঠোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। কিছুটা বিলম্বে হলেও সবুজকে বহিষ্কারের খবরে সেই বিরোধী অংশটিকে রোববার আত্মতৃপ্তির ঢেকুর গিলতে দেখা গেছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে জেলা ছাত্রদলের একাধিক নেতা অভিযোগ করেন, ‘দলীয় প্রভাব বিস্তার করে সবুজ আকন নিজের গ্রাম বাবুগঞ্জে গত বছরের ৫ আগস্টের পরে ব্যাপক ত্রাস চালিয়েছেন। শীর্ষস্থানীয় নেতা-কর্মীরা তাকে একাধিকবার সতর্ক করলেও তিনি তা উপেক্ষা করেছেন। একের পর এক বিতর্কিত ঘটনার জন্ম দিয়ে নিজেকে সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে গেছেন। সর্বশেষ তার বিরুদ্ধে ভাগনিকে ধর্ষণের অভিযোগ ওঠায় শীর্ষস্থানীয় নেতারা আর নীরব থাকতে পারলেন না।’
সূত্রগুলো নিশ্চিত করেছে, ধর্ষণের অভিযোগসহ সবুজ আকনের সব অপরাধের ফিরিস্তি ছাত্রদলের প্রতিপক্ষ অংশটি হাইকমান্ডের কাছে পৌঁছে দেয়। সেই অভিযোগ প্রাথমিক তদন্ত করতেই তার বিরুদ্ধে বেশকিছু অপকর্মের প্রমাণ পায় ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সংসদ, যার প্রেক্ষিতে বহিষ্কার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
অভিন্ন তথ্য দিয়ে ঢাকার একটি সূত্র জানায়, সবুজের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগগুলো গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করা হচ্ছে। প্রাথমিকভাবে তার বিরুদ্ধে কিছু অভিযোগের সত্যতা পাওয়ায় তদন্তের স্বার্থে তাকে আপাতত বহিষ্কার করা হয়।
পরবর্তী সময়ে তদন্তে বাকি অভিযোগের প্রমাণ পাওয়া গেলে তার বিরুদ্ধে আইনি প্রক্রিয়ায়ও ব্যবস্থা গ্রহণ করা হতে পারে।
অবশ্য এরই মধ্যেই এই নেতার সঙ্গে ছাত্রদলের সব পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের কোনো ধরনের সাংগঠনিক সম্পর্ক না রাখারও নির্দেশনা দেওয়া হয়। রোববার ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটির দপ্তর সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে এ তথ্য নিশ্চিত করা হয়েছে।
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি রাকিবুল ইসলাম রাকিব ও সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দীন নাছির রোববার তাদের বহিষ্কারাদেশ অনুমোদন দেন।
তবে ধর্ষণ-চাঁদাবাজিসহ তার বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন সবুজ আকন। আত্মপক্ষ সমর্থনে তিনি বলছেন, কিছুদিন পরে জেলা ছাত্রদলের কমিটি ঘোষণা হবে। এ নিয়ে দলীয় একটি অংশ তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। এ ছাড়া স্ত্রীর বোনের মেয়েকে ধর্ষণের অভিযোগটি পুরোপুরি ভিত্তিহীন। জমি সংক্রান্ত বিরোধীয় জেরে শ্বশুরবাড়ির লোকজন তাকে রাজনৈতিকভাবে শায়েস্তা করতে এমন অভিযোগ এনেছেন বলে দাবি করেন তিনি।
আপনার মতামত লিখুন :