ঢাকা বৃহস্পতিবার, ০৩ জুলাই, ২০২৫

স্ত্রীর কিডনিতে নতুন জীবন পেয়ে পরকীয়ায় জড়ালেন স্বামী!

রূপালী ডেস্ক
প্রকাশিত: জুলাই ৩, ২০২৫, ০৯:২৯ এএম
উম্মে সাহেদীনা টুনি ও মোহাম্মদ তারেক। ছবি- সংগৃহীত

ভালোবাসার আত্মত্যাগের এক নির্মম প্রতিদান। নিজের কিডনি দিয়ে স্বামীকে বাঁচালেন স্ত্রী, আর সুস্থ হতেই সেই স্বামী জড়িয়ে পড়লেন পরকীয়া ও অনলাইন জুয়ার নেশায়। শুধু তাই নয়, স্ত্রীকে মারধর করে বাড়ি থেকে বের করে দিয়ে এখন প্রেমিকার সঙ্গে সংসার করছেন তিনি। হৃদয়বিদারক এ ঘটনাটি ঘটেছে সাভারের কলমা এলাকায়।

ভুক্তভোগী স্ত্রী উম্মে সাহেদীনা টুনি (৩৫) এখন বিচারের আশায় আদালতের দ্বারস্থ হয়েছেন। তার স্বামী মোহাম্মদ তারেক নারী নির্যাতন মামলায় এক মাস কারাভোগের পর বর্তমানে জামিনে রয়েছেন।

২০০৬ সালে পারিবারিকভাবে বিয়ে হয় মালয়েশিয়া প্রবাসী তারেকের সঙ্গে কলেজপড়ুয়া টুনির। সংসারে এক পুত্রসন্তানের জন্মের পরপরই জানতে পারেন, তারেকের দুটি কিডনিই প্রায় অচল। শুরু হয় ডায়ালাইসিস, চিকিৎসা, আর একের পর এক বিপর্যয়।

তবে, ভালোবাসার বাঁধন বড়ই শক্ত। টুনি স্বামীর হাত শক্ত করে ধরেন এবং উন্নত চিকিৎসার জন্য তারেককে ভারতে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।

পরিকল্পনামাফিক তারেকের চিকিৎসা শুরু হয় ভারতে। কয়েক বছর পর চিকিৎসকরা জানান, রোগীকে বাঁচাতে হলে অতি দ্রুত কিডনি প্রতিস্থাপন করতে হবে। তখন স্ত্রী টুনিই এগিয়ে আসেন। নিজের কিডনি দিয়ে তিনি স্বামীকে প্রাণে বাঁচান। টুনি ভেবেছিলেন, এবার হয়তো তার কষ্টের জীবনের সমাপ্তি ঘটেছে। কিন্তু তারেকের এমন কর্মকাণ্ড বিষয়টিকে ভুল প্রমাণ করেছে। সুস্থ হয়েই পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়েন তারেক । ডিভোর্সি এক নারীর প্রেমে আসক্ত হয়ে পড়েন। পাশাপাশি অনলাইন জুয়ার নেশাও পেয়ে বসে তাকে।

চিকিৎসকেরা জানান, তার দুটি কিডনিই প্রায় অচল। রোগীকে বাঁচাতে হলে অতি দ্রুত ডায়ালাইসিস শুরু করাতে হবে।
তবে, স্বামীর ডায়ালাইসিসে রাজি ছিলেন না টুনি। পরিবারের সঙ্গে কথা বলে সিদ্ধান্ত নেন, উন্নত চিকিৎসার জন্য স্বামীকে ভারতে নিয়ে যাবেন। কোনো ধরনের কালক্ষেপণ না করে এক সপ্তাহের মধ্যেই স্বামীকে নিয়ে ভারতে পাড়ি জমান। তামিলনাড়ুর বিখ্যাত সিএমসি হাসপাতালে তারেকের চিকিৎসা শুরু হয়।

চিকিৎসকেরা জানান, তারেকের দুই কিডনি মিলিয়ে ২৪ পারসেন্ট সচল রয়েছে। এক্ষেত্রে মেডিসিনের মাধ্যমে আরও ১০ বছর তিনি চিকিৎসা চালিয়ে যেতে পারবেন। কিন্তু এরপর কিডনি প্রতিস্থাপন করতেই হবে।

এ অবস্থার মধ্যেও সদ্য সন্তানের মা হওয়া টুনি স্বামীর হাত শক্ত করে চেপে ধরেন। অভয় দেন, এই লড়াইয়ে কখনো হাত ছেড়ে দেবেন না। যেই কথা সেই কাজ। ঢাকায় ফিরে নিজ বাড়িতেই খোলেন হোম বিউটি পার্লার, পাশাপাশি বুটিকসের কাজ শুরু করেন। মাস শেষে ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা উপার্জন করতেন। সেই টাকা ব্যয় করতেন তারেকের চিকিৎসায়। এভাবে বেশ কয়েক বছর কেটে যায়। নিজের জমানো টাকা, বিয়ের স্বর্ণালংকার বিক্রি করে স্বামীর চিকিৎসা চালিয়ে যান তিনি। চিকিৎসকদের পরামর্শমতে, টুনিকে বছরে তিনবার অসুস্থ তারেককে নিয়ে ভারতে যেতে হতো। প্রতিবার প্রায় দুই থেকে তিন লাখ টাকা খরচ হতো। যা পুরোটাই আসত নিজের আয় ও স্বর্ণালংকার বিক্রির টাকা থেকে।

অপরদিকে, অসুস্থ তারেক কোনো কাজকর্ম করতে পারতেন না। সম্পূর্ণ বেকার হয়ে পড়ায় একটা সময় পরিবারও তার ওপর থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। কেবল স্ত্রী টুনি ও একমাত্র সন্তানই তার পাশে ছিল। একপর্যায়ে খরচ সামলাতে না পেরে নিজের মায়ের পেনশনের টাকাও স্বামীর চিকিৎসায় ব্যয় করেন টুনি। ২০০৮ থেকে ২০১৮- এই ১০ বছর ভারতেই চলল তারেকের চিকিৎসা। ২০১৯-এর শুরুতে চিকিৎসকেরা জানালেন, এবার তারেককে কিডনি প্রতিস্থাপন করতে হবে। নয়তো ডায়ালাইসিস করেই বাকিটা জীবন বাঁচতে হবে।

পরিবারের বাকি সদস্যদের সঙ্গে টেস্টে মিললেও কেউ কিডনি দিতে রাজি হয়নি। পরবর্তীতে স্ত্রী টুনি সিদ্ধান্ত নিলেন, নিজের কিডনি দিয়ে হলেও স্বামীর প্রাণ বাঁচাবেন। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ২০১৯ সালের ২৬ অক্টোবর দিল্লির অ্যাপোলো হাসপাতালে চিকিৎসক কৈলাশ নাথ সিং (কেএন সিং)-এর তত্ত্বাবধানে টুনি ও তারেকের কিডনি প্রতিস্থাপন সম্পন্ন হয়।

কিন্তু সেই আত্মত্যাগের মূল্য স্বপ্নেও ভাবেননি টুনি। কিডনি প্রতিস্থাপনের পর থেকেই বদলে যেতে থাকেন তারেক। শুরু হয় স্ত্রীকে অবহেলা, গালাগাল, এমনকি শারীরিক নির্যাতন। একপর্যায়ে ঢাকায় গিয়ে পরকীয়ায় জড়ান তিনি। প্রেমে জড়ান এক ডিভোর্সি নারী তাহমিনার সঙ্গে। টুনিকে মারধর করে বাড়ি থেকে বের করে দিয়ে সেই প্রেমিকার সঙ্গেই সংসার শুরু করেন তিনি।

টুনি বলেন, বিভিন্ন সময় কাজের অজুহাতে ঢাকায় গিয়ে সময় কাটাত তারেক। একসময় জানতে পারি, তাহমিনা নামের একজন ডিভোর্সি নারীর সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে পরকীয়ায় লিপ্ত সে। তারেকের মোবাইল ঘেঁটে এসবের প্রমাণও পাই। বিষয়টি নিয়ে জিজ্ঞাসা করলে, সে নির্যাতনের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দেয়। একপর্যায়ে আমাকে পুরো বাড়ি তার নামে লিখে দিয়ে ডিভোর্স দেওয়ার জন্য চাপ দেয়।

বিষয়টি প্রথমে স্থানীয়ভাবে মীমাংসার চেষ্টা হলেও শেষ পর্যন্ত সাভার থানায় নারী নির্যাতনের অভিযোগ করেন টুনি। পরে ঢাকার জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে যৌতুক ও নারী নির্যাতনের মামলা দায়ের করেন তিনি। গত এপ্রিল মাসে তারেক গ্রেপ্তার হন এবং এক মাস কারাভোগের পর জামিনে মুক্তি পান। মুক্তি পেয়েই ফের প্রেমিকার সঙ্গে বসবাস শুরু করেন তিনি।

টুনি বলেন, তার জন্য আমি নিজের জীবনকেও হুমকির মুখে ফেলেছি। আজ চিকিৎসকেরা বলছেন আমার শরীরে জটিলতা বাড়ছে। কিন্তু সেই মানুষটাই আমাকে ঘরছাড়া করেছে। এমনকি অপারেশনের দাগে লাথি মেরেছে।

তিনি আরও বলেন, আমি চাই, আমার মতো আর কোনো নারীর জীবন এমন অন্ধকারে না যাক। ভালোবাসার সুযোগ নিয়ে কেউ যেন আর এমন প্রতারণা করতে না পারে।

এক প্রতিবেশী বলেন, বিয়ের পর থেকেই টুনি আপা তার স্বামীর জন্য সবকিছু করেছেন। নিজের কিডনি দিয়ে জীবন দিয়েছেন, আর আজ তাকেই ঘর ছাড়া করা হয়েছে। এটা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।

এ প্রসঙ্গে টুনির মা বলেন, পারিবারিকভাবে আমাদের আর্থিক অবস্থা সচ্ছল ছিল। তারেকের চিকিৎসায় প্রতি বছর গড়ে ৮ থেকে ১০ লাখ টাকা খরচ হতো। সেই টাকা টুনি কখনো আমাদের থেকেও নিয়ে যেত। আমার পেনশনের পুরো অর্থ তারেকের চিকিৎসায় খরচ করেছি। একটি ফ্ল্যাট বিক্রি করে টুনিদের থাকার জন্য বিল্ডিং তুলে দিয়েছিলাম। সেই বাড়ির অর্ধেক মেয়ের নামে আর বাকি অর্ধেক তারেকের নামে। অথচ আজ সেই বাড়ি নিজের নামে লিখে দেওয়ার জন্য আমার মেয়েকে নির্যাতন করছে, পরকীয়া প্রেমিকার সঙ্গে থাকছে।

টুনির আইনজীবী নেহার ফারুক বলেন, তারেকের বিরুদ্ধে নারী নির্যাতনের অভিযোগের পাশাপাশি প্রতারণা ও সম্পত্তি আত্মসাতের অভিযোগ আনা যেতে পারে। চার্জশিট হাতে পেলেই জামিন বাতিলের আবেদন করা হবে।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ইশরাত হাসান বলেন, এটি কেবল নারী নির্যাতনের নয়, মানবদেহের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সংযোজন আইনের লঙ্ঘনও হতে পারে। স্ত্রীকে ঠকিয়ে কিডনি নিয়েছেন, এটি গুরুতর অপরাধ। আদালত চাইলে সুরক্ষা আদেশ দিয়ে ভিকটিমকে ঘরেও নিরাপদ রাখার ব্যবস্থা করতে পারেন।