ঢাকা সোমবার, ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

উত্তাল খাগড়াছড়ি, সন্দেহজনক ভূমিকায় ‘ইউপিডিএফ’

খাগড়াছড়ি প্রতিনিধি
প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২৯, ২০২৫, ১০:৩৭ এএম
খাগড়াছড়ি ও গুইমারায় সহিংসতা। ছবি - সংগৃহীত

খাগড়াছড়িতে ফের অশান্তির আগুন জ্বলে উঠেছে। একটি মারমা কিশোরীকে দলবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগে শুরু হওয়া এই উত্তেজনা এখন প্রাণঘাতী সংঘর্ষে রূপ নিয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে ‘জুম্ম ছাত্র-জনতা’র সংঘর্ষে এ পর্যন্ত তিনজনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত হওয়া গেছে। আহত হয়েছেন সেনাবাহিনীর এক মেজরসহ ১৩ সেনাসদস্য, পুলিশের তিন সদস্যসহ অন্তত আরও ৩০ জন। এ ঘটনায় ওই জেলাজুড়ে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে।

এর আগে গত ২৩ সেপ্টেম্বর রাতে খাগড়াছড়ি সদর উপজেলায় মারমা সম্প্রদায়ের ওই কিশোরীকে ধর্ষণের অভিযোগ ওঠে। এরপর থেকেই জেলাজুড়ে উত্তেজনা বাড়তে থাকে। সেনাবাহিনীর সহায়তায় পুলিশ ২৪ সেপ্টেম্বর গ্রেপ্তার করে শয়ন শীল নামে ১৯ বছর বয়সি এক তরুণকে, যাকে ইউপিডিএফের সন্দেহভাজন সদস্য হিসেবে চিহ্নিত করেছিল। কিন্তু এতে উত্তেজনা থামেনি। বরং এরপর থেকেই খাগড়াছড়ি পরিণত হয় বিক্ষোভের এক মঞ্চে।

ঘটনার পেছনে সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্র দেখছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। আইএসপিআরের বিবৃতি অনুযায়ী, ইউপিডিএফ ও এর অঙ্গসংগঠনগুলো পরিকল্পিতভাবে নারী ও স্কুলগামী শিশুদের নাশকতামূলক কাজে জড়াতে বাধ্য করছে এবং পার্বত্যাঞ্চলে দাঙ্গা উসকে দিতে বহিরাগত সন্ত্রাসীদের দেশীয় অস্ত্রসহ আনছে। ইতোমধ্যে বিজিবির কাপ্তাই ব্যাটালিয়ন চেকপোস্টে ইউপিডিএফের পরিবাহিত বিপুল দেশীয় অস্ত্র জব্দ করা হয়েছে।

তারা আরও দাবি করেছে, গত বছরের ১৯ সেপ্টেম্বর মামুন হত্যাকে কেন্দ্র করে ইউপিডিএফ এবং এর সহযোগী সংগঠনগুলো দীঘিনালা ও রাঙামাটিতে সাম্প্রদায়িক অস্থিরতা সৃষ্টির চেষ্টা করেছিল। সেই ঘটনার এক বছর পূর্তি উপলক্ষে চলতি বছর ফের উত্তেজনা সৃষ্টি করা হয়েছে। একইসঙ্গে দেশি ও প্রবাসী ব্লগারদের মাধ্যমে ‘বাঙালি জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে’ উসকানিমূলক প্রচারের অভিযোগও তোলা হয়েছে।

সেনাবাহিনীর মতে, সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের ধাওয়া করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়েছে তারা। একই সঙ্গে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে প্রমাণসহ আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের প্রস্তুতি চলছে বলে জানায় আইএসপিআর।

উত্তপ্ত পার্বত্য জনপদ

‘জুম্ম ছাত্র-জনতা’ ব্যানারে ধর্ষণের প্রতিবাদে শুরু হয় সড়ক অবরোধ কর্মসূচি। ২৭ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হওয়া এই অনির্দিষ্টকালের অবরোধে অচল হয়ে পড়েছে খাগড়াছড়ির সঙ্গে চট্টগ্রাম, রাঙামাটি, সাজেকসহ দেশের অন্যান্য অঞ্চলের সড়ক যোগাযোগ। টায়ার জ্বালিয়ে, গাছ ফেলে ও রাস্তা কেটে প্রতিবাদ জানাতে থাকেন বিক্ষোভকারীরা।

এই সময়ের মধ্যে বিভিন্ন জায়গায় সেনাবাহিনী ও পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায় অবরোধকারীরা। ২৭ ও ২৮ সেপ্টেম্বরের সহিংসতায় রামসু বাজার এলাকায় টহলরত সেনাদলের ওপর ইট-পাটকেল ছোড়া হয়। এতে তিন সেনাসদস্য আহত হন। পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে ২৮ সেপ্টেম্বর সকাল সাড়ে ১০টার দিকে, যখন সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রণে আসতে গেলে বিক্ষোভকারীরা দেশীয় অস্ত্র, লাঠিসোটা ও গুলতি নিয়ে হামলা চালায়।

আইএসপিআরের বিবৃতি অনুযায়ী, ওই সময় পাহাড় থেকে ইউপিডিএফের (মূল) সশস্ত্র সদস্যরা স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র দিয়ে আনুমানিক ১০০–১৫০ রাউন্ড গুলিবর্ষণ করে। এতে আরও অনেক সাধারণ মানুষ গুলিবিদ্ধ হন।

মৃত্যুর ঘটনা ও প্রতিক্রিয়া

গতকাল রোববার সন্ধ্যা নাগাদ গুইমারা থেকে তিনজনের মরদেহ খাগড়াছড়ি সদর হাসপাতালে পৌঁছায়। পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি আহসান হাবিব পলাশ বলেন, ‘নিহতদের বয়স ২০ থেকে ২৫ বছরের মধ্যে। মৃত্যুর কারণ নির্ধারণে ময়নাতদন্তের অপেক্ষায় আছে প্রশাসন।’

হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, মরদেহের শরীরে গুলির চিহ্ন রয়েছে। আহত আরও চারজন চিকিৎসাধীন।

এ ঘটনার পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে গভীর দুঃখপ্রকাশ করে জানানো হয়, দুষ্কৃতকারীদের হামলায় তিন পাহাড়ি নিহত হয়েছেন এবং ১৩ সেনা সদস্য, পুলিশ ও সাধারণ মানুষ আহত হয়েছেন। তদন্ত করে দোষীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছে মন্ত্রণালয়।

‘জুম্ম ছাত্র-জনতা’র দাবিগুলো

অবরোধ কর্মসূচির নেতৃত্বে থাকা ‘জুম্ম ছাত্র-জনতা’ তাদের সামাজিক মাধ্যমে দাবি করে, তাদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের ওপর বর্বরোচিত হামলা হয়েছে। তারা সেনাবাহিনী ও স্থানীয় বাঙালিদের বিরুদ্ধে বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও গুলিবর্ষণের অভিযোগ তুলেছে। নিহতের সংখ্যা তাদের ভাষ্যমতে চারজন।

তাদের প্রধান দাবিগুলো 

১। আলোচনা শুরু থেকে পরবর্তী সময়ে পর্যন্ত যেকোনো ধরনের হামলা, সহিংসতা বা ভীতি প্রদর্শন রোধে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ আইনগতভাবে বাধ্য থাকবে এবং সেই নিশ্চয়তা প্রদান করবে।

২। ধর্ষণ মামলার অবশিষ্ট দুই আসামিকে অবিলম্বে গ্রেপ্তার করে যথাযথ ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রয়োগ করতে হবে। এরই মধ্যে গ্রেপ্তারকৃত আসামি চয়নশীলের বিচার ত্বরান্বিত করে দণ্ড কার্যকর করতে হবে এবং তা সরকারি গেজেটে বিজ্ঞাপন হিসেবে প্রকাশ করতে হবে। ভুক্তভোগীকে পর্যাপ্ত আর্থিক ক্ষতিপূরণ প্রদান এবং পূর্ণাঙ্গ পুনর্বাসন (rehabilitation) নিশ্চিত করতে হবে।

৩। ২৭ ও ২৮ সেপ্টেম্বর খাগড়াছড়ি ও গুইমারায় ঘটে যাওয়া সেনা ও সেটলারদের দ্বারা লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ও গুলিবর্ষণের ঘটনাসহ সব ঘটনার জড়িতদের বিরুদ্ধে নিরপেক্ষ, সংবেদনশীল ও আইনানুগ তদন্ত নিশ্চিত করতে হবে। এই বিষয়ে একটি অফিসিয়াল তদন্ত প্রতিবেদন আমাদের ত্রিশ (৩০) দিনের মধ্যে প্রদান করতে হবে।

৪। নিরীহ ও নিরস্ত্র ‘জুম্ম ছাত্র-জনতা’ সংগঠনের ওপর সংঘটিত বর্বরোচিত হামলা, দোকানপাট ও বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগে সৃষ্ট ক্ষতির পূর্ণ ক্ষতিপূরণ প্রদান রাষ্ট্রীয়ভাবে নিশ্চিত করতে হবে; পাশাপাশি আহত সবার সুচিকিৎসার দায়ভার জেলা/রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ বহন করবে।

৫। শান্তিপূর্ণ অবরোধ ক্ষুণ্ন করা, সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় বিনা উসকানিতে আক্রমণ চালানো এবং জুম্ম আদিবাসীদের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হলে সেসবের পূর্ণ ক্ষতিপূরণ ও ন্যায্য প্রতিকার দিতে হবে।

৬। চলমান আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে আটককৃত সব ‘জুম্ম ছাত্র-জনতা’ সদস্যকে অবিলম্বে ও নিঃশর্ত মুক্তি দিতে হবে। একই সঙ্গে ২৭ ও ২৮ সেপ্টেম্বর সংঘটিত হামলাগুলোর স্বতন্ত্র, স্বাধীন ও স্বচ্ছ তদন্ত সম্পন্ন করে দোষীদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

৭। আলোচনা টেবিলে অংশগ্রহণকারী প্রতিটি ‘জুম্ম ছাত্র-জনতা’ প্রতিনিধি এবং অন্যান্য সাধারণ জনগণ ও ছাত্রদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।

৮। ১৪৪ ধারা বাতিল করতে হবে।

উপরোক্ত দাবিগুলো বাস্তবায়ন না হলে আমরা আরও কঠোর এবং সুসংগঠিত আন্দোলনে যেতে বাধ্য হবো বলে জানিয়েছে জুম্ম ছাত্র-জনতা।

সরকার ও প্রশাসনের পদক্ষেপ

এদিকে খাগড়াছড়ির জেলা প্রশাসক এ বি এম ইফতেখারুল ইসলাম বলেন, ‘দুর্গাপূজা নির্বিঘ্নে উদযাপনের জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সর্বাত্মক চেষ্টা করছে। একইসঙ্গে সব পক্ষকে শান্ত থাকার আহ্বান জানানো হয়েছে।’

পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক উপদেষ্টা সুপ্রদীপ চাকমা মনে করেন, তৃতীয় কোনো পক্ষ অর্থায়নের মাধ্যমে এ ধরনের সহিংসতা উসকে দিচ্ছে।

তিনি বলেন, ‘যাদের বয়স কম, যারা এই আন্দোলনে আছে, তাদের পক্ষে নিজস্ব খরচে দূর-দূরান্ত থেকে এসে আন্দোলন চালানো সম্ভব নয়।’

পর্যটকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত

চলমান অবরোধের কারণে খাগড়াছড়ির সঙ্গে দেশের অন্যান্য জেলার সড়ক যোগাযোগ পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। সেনাবাহিনীর সহায়তায় গত শনিবার গভীর রাতে দুই হাজারের বেশি পর্যটককে নিরাপদে ঢাকায় ফিরিয়ে দেওয়া হয়।