পোল্যান্ডে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ট্রাম্পপন্থী কারোল নাভরকি বিজয়ী হওয়ায় ইউরোপজুড়ে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। উদারপন্থী প্রধানমন্ত্রী ডোনাল্ড টাস্কের সরকারের সামনে এখন জটিল রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ।
নির্বাচনের মাত্র দু’দিন পর, ২ জুন টাস্ক জাতীয় সংসদে নিজের সরকারের আস্থা ভোট ডাকেন। তিনি বলেন, ‘আমরা জানি সময়টা কতটা গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু এক চুলও পিছু হটার ইচ্ছে আমাদের নেই।’
২০২৩ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকেই ইউরোপপন্থী সংস্কার বাস্তবায়নে প্রেসিডেন্ট আন্দ্রেজ দুদার বাধার মুখে পড়ছিলেন টাস্ক।
পুরোনো সরকারপন্থী বিচারপতিদের ভরপুর আদালতে বিল পাঠানো কিংবা প্রেসিডেন্টের ভেটোর কারণে সংসদে পাশ হওয়া আইনও কার্যকর হয়নি।
এবার দুদার উত্তরসূরি হিসেবে আরও দৃঢ় ট্রাম্প-ঘেঁষা অবস্থান নিয়ে এসেছেন কারোল নাভরকি। ৪২ বছর বয়সী এই রাজনীতিক পোল্যান্ডের জাতীয় স্মৃতি সংস্থার সাবেক প্রধান, একসময়কার বক্সার এবং ঘোরতর ইউরোপবিরোধী অবস্থানের জন্য পরিচিত।
তার প্রচারণায় প্রধান ছিল ‘সার্বভৌমত্ব রক্ষা’, ‘ইইউ-হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে পোল্যান্ড’ এবং অভিবাসনবিরোধী বক্তব্য।
১৮ মে অনুষ্ঠিত প্রথম রাউন্ডে নাভরকি পেয়েছিলেন ২৯.৫ শতাংশ, আর টাস্কপন্থী উদারপন্থী প্রার্থী ও ওয়ারশর মেয়র রাফাল চাসকোভস্কি এগিয়ে ছিলেন ৩১.৪ শতাংশ ভোট নিয়ে।
কিন্তু ১ জুনের রানঅফে ৫০.৯ শতাংশ ভোটে নাটকীয়ভাবে জয় পান নাভরকি। চাসকোভস্কি পেয়েছেন ৪৯.১ শতাংশ ভোট
দুই প্রার্থীর ব্যবধান মাত্র তিন লাখ। ভোটার উপস্থিতিও ছিল নজিরবিহীন, ৭১.৬৩ শতাংশ।
এই ফলাফল শুধু পোল্যান্ড নয়, পুরো ইউরোপে একটি ‘বজ্রপাতের মতো আঘাত’ হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকেরা।
দুই সপ্তাহ আগে রোমানিয়ায় মধ্যপন্থী নিকুসোর দান নির্বাচনে জিতেছিলেন, যেটি ইউরোপপন্থীদের জন্য স্বস্তিদায়ক ছিল। কিন্তু এখন সেই ধারাকে উল্টো ধাক্কা দিল পোল্যান্ড।
নাভরকির জয়েই বোঝা যাচ্ছে, ইউরোপজুড়ে দক্ষিণপন্থী, জাতীয়তাবাদী এবং ইইউ-বিরোধী শক্তির উত্থান চলছেই।
ভিক্টর অরবান (হাঙ্গেরি), রবার্ট ফিকো (স্লোভাকিয়া), এমনকি চেক প্রজাতন্ত্রেও আন্দ্রেই বাবিস ফেরার আভাস দিচ্ছেন।
অরবান এই জয়কে বলেছেন ‘চমৎকার বিজয়’, আর রোমানিয়ার কট্টর ডানপন্থী জর্জ সিমিওন ঘোষণা দিয়েছেন, ‘পোল্যান্ড জিতেছে’।
পোল্যান্ডের সংবিধান অনুযায়ী, প্রেসিডেন্ট মূলত প্রতিরক্ষা, বিদেশনীতি ও আইন ভেটোর মাধ্যমে প্রভাব বিস্তার করেন।
যদিও প্রধানমন্ত্রী পরিচালনা করেন দৈনন্দিন প্রশাসন। কিন্তু আইন ভেটোর ক্ষমতা ও জনসমর্থনের প্রভাবে প্রেসিডেন্ট হয়ে উঠতে পারেন কার্যত রাজনৈতিক ভারসাম্যের নিয়ন্ত্রক।
নাভরকি শুধু দুদার মতো নন, তার থেকেও আগ্রাসী। আর টাস্কের নেতৃত্বাধীন জোট, যদিও সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ, কিন্তু প্রেসিডেন্টের ভেটো ঠেকাতে তিন-পঞ্চমাংশ ভোটের ঘাটতি রয়েছে তাদের।
ফলে গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার এখন থেকেই মুখ থুবড়ে পড়তে পারে। এর মধ্যেই ওয়ারশ স্টক এক্সচেঞ্জে ২ শতাংশ পতন ঘটেছে।
সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা গেছে, টাস্ক সরকারের প্রতি মানুষের আস্থাও কমছে। ৪৭ শতাংশ অসন্তুষ্ট, মাত্র ৩০ শতাংশ সন্তুষ্ট।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, টাস্ক এখন ‘লেন-ডাক’ অবস্থা থেকে আর বেরোতে পারবেন না - সরকার চালাবেন, কিন্তু কিছু করতে পারবেন না।
আগস্ট ৬-এ প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেবেন নাভরকি। তার আগেই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, পোল্যান্ডের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক পথরেখা এখন ইউরোপপন্থা বনাম জাতীয়তাবাদী বিভাজনের দোলাচলে। আর এই দ্বন্দ্বের প্রতিধ্বনি ইতিমধ্যেই ছড়িয়ে পড়েছে গোটা ইউরোপজুড়ে।
আপনার মতামত লিখুন :