যে কোনো মুহূর্তে ভেঙে যেতে পারে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটি। রাকিব-নাছিরের বর্তমান নেতৃত্বে দুঃসময়ের ত্যাগী নেতাকর্মীদের অবমূল্যায়ন, নিষ্ক্রিয়, ‘মাই ম্যান’ ও অছাত্রদের পদায়ন এবং ছাত্রলীগের বেশ কিছু নেতাকর্মীকে কমিটিতে পদায়নসহ বিভিন্ন অভিযোগে ভরপুর সংগঠনটি।
এ ছাড়া ছাত্রদলের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক ও সাংগঠনিক সম্পাদকের আধিপত্য, দ্বন্দ্ব ও কমিটি বাণিজ্যের অভিযোগের কারণে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সম্প্রতি ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটি ভেঙে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
সম্প্রতি গণমাধ্যমে বিতর্কিত মন্তব্য করে আলোচনায় আসেন রাকিব। দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের পরও রাকিব-নাছিরের ঘনিষ্ঠ হওয়ায় বেশ কিছু নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি বলেও অভিযোগ রয়েছে। ফাঁকা তিনটি পদের মধ্যে দুটিতে পদায়ন হলেও একজন সভাপতি, আরেকজন সম্পাদকের ঘনিষ্ঠ বলেই অভিযোগ রয়েছে।
সূত্রমতে, কমিটির মেয়াদ পূর্ণ না করে দুই বছর মেয়াদি কমিটি কেন ভাঙা হবে, তা নিয়ে রয়েছে পক্ষে-বিপক্ষে মত। নতুন কমিটির রূপরেখাও দিচ্ছেন কেউ কেউ। তবে বর্তমান কেন্দ্রীয় কমিটির শীর্ষ নেতারা বলছেন, সংগঠনে এমন কোনো আলোচনা না থাকলেও তার পরও দল চাইলে কমিটি ভাঙতেই পারে। তবে সম্প্রতি ছাত্রদল বিতর্কিত একটি সংগঠন হয়ে উঠছে এবং ছাত্রদলের মধ্যে একক আধিপত্য লক্ষ করা গেছে, যার কারণে অনেকেই দল থেকে নিজেকে গুটিয়ে ফেলতে চাইছেন। এ জন্য ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ছাত্রদলকে নতুনরূপে সংস্কারের চিন্তা করছেন।
এ ছাড়া সম্প্রতি ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সভাপতি রাকিবুল ইসলাম রাকিবের পদ হারানোর যে গুঞ্জন ছড়িয়েছে, তা বিভিন্ন মহলে আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। যদিও এসব বিষয়ে সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দীন নাছির বলেন, ছাত্রদলের সভাপতি শারীরিকভাবে অসুস্থ। এ অবস্থায় তাকে নিয়ে গুজব ছড়িয়েছে, যা ‘উদ্দেশ্যমূলক ও বিভ্রান্তিকর প্রপাগান্ডা’।
তিনি বলেন, ‘টানা অনেক দিন বৃষ্টিতে ভিজে দলীয় কর্মসূচি পালন করায় বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের সভাপতি রাকিবুল ইসলাম রাকিব ঠান্ডা-জ্বরে আক্রান্ত হন। এ জন্য তিনি কোনো কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করতে পারেননি। আমি তার সুস্থতা কামনা করছি।’
ছাত্রদলের একাধিক নেতা জানান, সংগঠনে বিভিন্ন দুর্নীতি ও অনিয়মের কারণে সভাপতি রাকিবকে কিছুদিন রেস্ট নিতে বলেছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। তবে দলটির একটি বিশেষ সূত্র রূপালী বাংলাদেশকে জানায়, ঈদের পরেই ছাত্রদলকে নতুন রূপে সাজাতে নির্দেশনা দিয়েছেন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান এবং আগামী নির্বাচনের আগেই কমিটি ভেঙে দেওয়া হবে। তবে সম্প্রতি সভাপতি রাকিবকে নিয়ে যে গুঞ্জন উঠেছে, তার অধিকাংশ সঠিক। সংগঠনকে নিজের মনে করে বর্তমান কমিটির নেতারা ত্যাগীদের অবমূল্যায়ন করছেন, যে কারণে রাকিবকে তিন মাসের সময় দিয়েছেন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। বর্তমান কমিটির সুপার ফাইভ পদে যারা রয়েছেন, তাদের বয়স একটু বেশি হওয়ার সুবাদের তারা নতুন কমিটি থেকে বাদ পড়তে পারেন।
নতুন কমিটি ঘিরে তোড়জোড়!
ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটির সূত্রে জানা যায়, সংগঠনের নেতাকর্মীদের মধ্যে কমিটি ভাঙার আলোচনা এখন তুঙ্গে। খোদ তারেক রহমান ব্যক্তিগতভাবে সম্ভাব্য প্রার্থীদের ওপর নজরদারি রাখতে বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছেন বলে জানা গেছে। তবে কমিটি ভেঙে ফেলার আলোচনা শুনেই তোড়জোড় শুরু করেছেন বেশ কিছু নেতাকর্মী। এর মধ্যে আলোচনায় শীর্ষে রয়েছে সভাপতি পদপ্রত্যাশী সাতজনের নাম।
তারা হলেন- ২০০৮-০৯ সেশনের বর্তমান কমিটির সহসভাপতি ইজাজুল কবির রুয়েল। রুয়েল দীর্ঘদিনের রাজপথের ত্যাগী ছাত্রনেতা। আরেকজন হলেন কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি মঞ্জুরুল আলম রিয়াদ। রিয়াদ রাজপথে ও রাজনীতিতে বেশ সক্রিয়। এই পদে তৃতীয় যার নাম শোনা যাচ্ছে, তিনি হলেন সহসভাপতি এইচ এম আবু জাফর। জাফরকে সবাই পছন্দ করলেও লবিং লাইনে দুর্বল থাকার সুবাদে কিছুটা পিছিয়ে আছেন। যদিও বিগত দিনে তিনি সংগঠনের জন্য সবকিছু বিলিয়ে রাজপথে সক্রিয় থেকেছেন। এ ছাড়া সভাপতি পদপ্রার্থী হলেন বর্তমান কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি আরিফুল ইসলাম আরিফ। আরিফ হাসিনা পতনের আন্দোলনে সম্মুখসারির যোদ্ধা ছিলেন। হামলা-মামলা তার নিত্যদিনের সঙ্গী ছিল। ত্যাগী নেতাদের মূল্যায়ন করলে তার নাম ও উঠে এসেছে।
অন্যদিকে সহসভাপতি শাফি ইসলাম ও খোরশেদ আলম সোহেল বেশ আলোচনায় রয়েছেন। তারা দুজনই রাজপথে বেশ সক্রিয় এবং নির্যাতিত ছাত্রনেতা হিসেবে বিভিন্ন মহলে পরিচিত। তবে ২০০৭-০৮ সেশনের আনোয়ার পারভেজের নামও আলোচনায় রয়েছে। তার বাড়ি বগুড়া জেলায়।
বিএনপি ও ছাত্রদলের কেন্দ্রে কমিটির একটি বিশ্বস্ত সূত্র জানায়, বর্তমান কমিটির সুপার ফাইভ পদে যারা রয়েছেন তারা কেউ নতুন কমিটিতে না আসতে পারে। যদি পুরাতন নেতাদের মধ্যে নতুন কমিটিতে কেউ আসে তাহলে যার নামটি আলোচনা রয়েছেন তিনি হলেন। সভাপতি প্রত্যাশী সবচেয়ে আলোচিত জনপ্রিয় ছাত্রনেতা বর্তমান কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক আমানউল্লাহ আমান।
ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক পদেও পাঁচজনের নাম উঠে এসেছে। তারা হলেন- ২০০৯-১০ সেশনের কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মমিনুল ইসলাম জিসান, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ফারুক হোসেন, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মোস্তাফিজুর রহমান, প্রচার সম্পাদক শরিফ প্রধান শুভ ও মো. তরিকুল ইসলাম তারিক।
এর মধ্যে জিসান ও ফারুকের নাম বিভিন্ন মহলে আলোচনার শীর্ষে রয়েছে। তারা রাজনীতিতে বেশ চাঙা। জিসান ও ফারুক ৫ আগস্টে সরকারপতনের আন্দোলনে ব্যাপক ভূমিকা রাখেন। অনেকেই ৫ আগস্টের আন্দোলনে সরাসরি নেতৃত্ব না দিলেও ফারুক ও জিসানের ভূমিকা ছিল শীর্ষে। ফারুক ক্লিন ইমিজের ছাত্রনেতা হিসেবে বিভিন্ন মহলে পরিচিত। এ ছাড়া সম্পাদক পদে তৃতীয় নাম শোনা যাচ্ছে, তিনি হলেন মোস্তাফিজুর রহমান। মোস্তাফিজুর সাংগঠনিক পদেও আলোচনায় আছেন। এ ছাড়া এই পদে প্রচার সম্পাদক শরিফ প্রধান শুভও বেশ আলোচনায় আছেন। অনেকেই শুভকে এই পদে যোগ্য মনে করছেন। পাশাপাশি সাধারণ সম্পাদক পদে এগিয়ে রয়েছেন যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মো. তরিকুল ইসলাম তারিক, তিনি ১০-১১ সেশনের।
এ ছাড়া সাংগঠনিক সম্পাদক পদে যাদের নাম শোনা যাচ্ছে, তারা হলেন ২০১০-১১ সেশনের কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাসুম বিল্লাহ, রাজু আহমেদ, সোহেল রানা ও ইব্রাহিম খলিল। এর মধ্যে রাজু এগিয়ে রয়েছেন। সবাই ধারণা করছেন, রাজু হলেন বিএনপি নেতা রুহুল কবির রিজভী আহমেদের স্নেহশীল। এ ছাড়া সাংগঠনিক সম্পাদক করে ভিপি মোস্তাফিজুর রহমানও আলোচনার শীর্ষ রয়েছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কেন্দ্রীয় কমিটিতে পদবঞ্চিত ঢাবি ছাত্রদলের সাবেক এক নেতা অভিযোগ করে বলেন, ছাত্রদল কেন্দ্রীয় সংসদের বর্তমান কমিটিতে পদায়নের ক্ষেত্রে ন্যূনতম কোনো মানদণ্ড অনুসরণ করা হয়নি। নির্দিষ্ট অঞ্চলের নেতা তৈরি করা হয়েছে, যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দলের পদধারী নেতা, সরকারি চাকরিজীবী, ব্যাংকার ছাত্রদলের পদ পেয়েছেন। ছাত্রদল কেন্দ্রীয় সংসদে এমন অনেকে নেতৃত্বে এসেছেন, যাদের প্রথম রাজনৈতিক পদ ছাত্রদল কেন্দ্রীয় সংসদের সহসাধারণ সম্পাদক, সহসাংগঠনিক সম্পাদক।
তিনি বলেন, পূর্বে ওই নেতাদের কোনো রাজনৈতিক পদ ছিল না। তাদের পরিচয় তারা সভাপতি-সম্পাদকের লোক। কেন্দ্রীয় কমিটি পূর্ণাঙ্গ করার সময় কেন্দ্র থেকে বলা হয়েছিল, ছাত্রদলের যেসব নেতাকর্মী ২৮ অক্টোবরের পর সরকারের বিরুদ্ধে রাজপথে মিছিল-মিটিংয়ে অংশগ্রহণ করেছেন, তাদের অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। কিন্তু আমরা তার সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র কমিটিতে দেখলাম। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দীর্ঘদিনের রাজপথে রক্ত, শ্রম, ঘাম দেওয়া কর্মীদের বঞ্চিত করে সভাপতি-সম্পাদকের নিজ এলাকার গ্রুপের অগ্রাধিকার দেওয়া হলো।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বর্তমান কমিটির এক যুগ্ম সম্পাদক বলেন, বর্তমান শীর্ষ দুই নেতৃত্ব কমিটির অনেকেরই ফোন ধরেন না। যাদের ফোন ধরেন না, তারা তো নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করতে পারেন না। তাহলে তারা কেন বর্তমান নেতৃত্বের প্রতি আস্থা রাখবেন?
জুলাই অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে মূলধারার বেশ কয়েকটি ছাত্র সংগঠন বেশ কিছু শিক্ষার্থীবান্ধব ও সাড়া জাগানো কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হয়েছে। সেই তুলনায় তেমন কোনো শিক্ষার্থীবান্ধব কর্মসূচি নেই ছাত্রদলের। বরং দিনে দিনে ক্যাম্পাসগুলোতে ছাত্রদলের জনপ্রিয়তা ও নেতাকর্মী ক্রমশ কমছে। নিজেদের সাংগঠনিক দুর্বলতা ঢাকতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র সংসদ নির্বাচন এজন্যই কৌশলে ঠেকাতে চান তারা। ফলে বর্তমান কমিটি ভেঙে নতুন কমিটি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট নেতারা।
পদ হারানোর গুঞ্জনের পর ছাত্রদলের কমিটি ভাঙা হবে এমন প্রশ্নের জবাবে কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের সভাপতি রাকিবুল ইসলাম রাকিব বিষয়টি পরিষ্কার করে কিছু বলেননি। তবে তিনি দাবি করেন, সোশ্যাল মিডিয়ায় যে খবর ছড়িয়ে পড়ে, সেটা ‘প্রোপাগান্ডা’।
এ সময় তারুণ্যের সমাবেশ অনুপস্থিত থাকার বিষয়ে ছাত্রদল সভাপতি বলেন, ‘বৃষ্টিতে ভিজে আমি ওই রাতেই প্রচণ্ড অসুস্থ হয়ে যাই। সে কারণে বেলা ১১টার প্রেস কনফারেন্স আমি মিস করি। শহিদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের শাহাদাতবার্ষিকী উপলক্ষে যে কর্মসূচি ছিল, সে দুটি কর্মসূচি আমি মিস করি। পরে আমি পার্টিকে জানিয়েছি। আমি নিজে আমার সাধারণ সম্পাদকসহ আমার যে কলিগরা রয়েছেন, তাদের কল দিয়ে বলেছি যে আগামীকালের প্রোগ্রামে আমি যাব না। আমি বিষয়টি পার্টিকেও জানিয়েছি। এটিকে ইস্যু করে পরে দেখলাম নিউজ করা হয়েছে। তবে যদি সংগঠন চায় তাহলে কমিটি ভাঙাও হতে পারে, আবার না-ও হতে পারে।
সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দীন নাছির বলেন, কমিটি ভাঙার বিষয়ে কিছু জানি না। তবে আমাদের সভাপতি অসুস্থ থাকার পর তার পদ হারানোর গুঞ্জন ওঠে। তিনি জানান, টানা অনেক দিন বৃষ্টিতে ভিজে দলীয় কর্মসূচি পালন করায় ছাত্রদলের সভাপতি রাকিব ঠান্ডা জ্বরে আক্রান্ত হন। এ জন্য তিনি কোনো কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করতে পারেননি। তাই কমিটি ভাঙার আলোচনা হচ্ছে বিভিন্ন মহলে।
এ বিষয়ে ছাত্রদলের সাংগঠনিক সম্পাদক আমানউল্লাহ আমান বলেন, ‘আমাদের সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটি ভাঙা হবে এসব বিষয়ে সঠিক তথ্য জানা নেই।’
তিনি বলেন, এখন দল যদি না চায় তাহলে তো বিষয়টি অন্য রকম।
আপনার মতামত লিখুন :