ঢাকা শনিবার, ১৮ অক্টোবর, ২০২৫

সাধু-গুরু-বাউলদের মিলনমেলা লালনের আখড়াবাড়ি

সুজন কুমার কর্মকার, কুষ্টিয়া
প্রকাশিত: অক্টোবর ১৮, ২০২৫, ০৬:০৩ পিএম
লালনের আখড়াবাড়িতে সাধু-গুরু-বাউলদের মিলনমেলা। ছবি- রূপালী বংলাদেশ

কুষ্টিয়ার ছেউড়িয়া লালন সাঁইয়ের আখড়াবাড়ি পরিণত হয়েছে সত্য সুপথের সন্ধানে সাধু-গুরু-বাউলদের মিলনমেলায়।

শুক্রবার (১৭ অক্টোবর) সন্ধ্যায় এক ভিডিও বার্তায় রাষ্ট্রীয়ভাবে এর উদ্বোধন করেন সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী। অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফরিদা আখতার, সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব মফিদুর রহমান ও বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি রেজাউদ্দিন স্ট্যালিন।

কুষ্টিয়া জেলা প্রশসাক ও লালন একাডেমির সভাপতি আবু হাসনাত মোহাম্মদ আরেফীন এর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে মুখ্য আলোচক ছিলেন আন্তজার্তিক খ্যাতিমান লেখক গায়ত্রী চক্রবর্তী। বিশেষ আলোচক ছিলেন বিশিষ্ট চিন্তক ও গবেষক ফরহাদ মজহার। বক্তব্য রাখেন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক আল মামুন। আলোচনাসভা শেষে প্রয়াত সংগীতশিল্পী ফরিদা পারভীনের স্মরণে একটি তথ্যচিত্র প্রদর্শন করা হয়। পরে অনুষ্ঠিত হয় লালনের গান এবং তা চলে গভীর রাত পর্যন্ত।

এদিকে সাধু-ভক্তরা ছুটে এসেছেন লালন আখড়াবাড়ি ও মাজার প্রাঙ্গণে। এতে সারাদেশের শিল্পীসহ সকল শ্রেণি-পেশার মানুষ অংশগ্রহণ করে। আখড়াবাড়ি পরিণত হয়েছে সাধু-গুরু-বাউলদের মিলনমেলা। ‘মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি’ সত্য সুপথের সন্ধানে মানবতার দীক্ষা নিতে আত্মার টানে দেশ-বিদেশের সাধুগুরু ও ভক্তরা দলে দলে এসে আসন গেড়েছে সাঁইজির মাজারে।

জানা গেছে, বৃটিশ শাসকগোষ্ঠীর নির্মম অত্যাচারে গ্রামের সাধারণ মানুষের জীবনকে যখন বিষিয়ে তুলেছিল, ঠিক সেই সময়ই সত্যের পথ ধরে, মানুষ গুরুর দীক্ষা দিতেই মানবতার পথপ্রদর্শক হিসাবে লালন শাহর আবির্ভাব ঘটে কুষ্টিয়া কুমারখালীর ছেঁউড়িয়ায়। লালনের জন্মস্থান নিয়ে নানা জনের নানা মত থাকলেও আজও অজানা তার জন্মরহস্য। তিনি ছিলেন নিঃসন্তান। আর্থিক অসংগতির কারণে তিনি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা লাভ করতে পারেননি। তবে তিনি ছিলেন স্বশিক্ষায় শিক্ষিত। যৌবনকালে পূর্ণ লাভের জন্য তীর্থ ভ্রমণে বেরিয়ে তার যৌবনের রূপান্তর ও সাধন জীবনে প্রবেশের ঘটনা ঘটে বলে জানা যায়। তীর্থকালে তিনি বসন্ত রোগে আক্রান্ত হলে তার সঙ্গীরা তাকে প্রত্যাখ্যান করে। পরে মলম শাহর আশ্রয়ে জীবন ফিরে পাওয়ার পর সাধক সিরাজ সাঁইয়ের সান্নিধ্যে তিনি সাধক ফকিরি লাভ করেন। 

প্রথমে তিনি কুমারখালীর ছেউড়িয়া গ্রামের গভীর বনের একটি আমগাছের নিচে সাধনায় নিযুক্ত হন। পরে স্থানীয় কারিকর সম্প্রদায়ের সাহায্য লাভ করেন। লালন ভক্ত মলম শাহ আখড়া তৈরির জন্য ষোল বিঘা জমি দান করেন। দানকৃত ওই জমিতে ১৮২৩ সালে লালন আখড়া গড়ে ওঠে। প্রথমে সেখানে লালনের বসবাস ও সাধনার জন্য বড় খড়ের ঘর তৈরি করা হয়। সেই ঘরেই তার সাধন-ভজন বসত। ছেউড়িয়ার আখড়া স্থাপনের পর থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত শিষ্যভক্তদের নিয়ে থাকতেন। তিনি প্রায় এক হাজার গান রচনা করে গেছেন।

১৮৯০ সালের ১৭ অক্টোবর ভোরে এই মরমী সাধক দেহত্যাগ করেন এবং তার সাধন-ভজনের ঘরের মধ্যেই তাকে সমাহিত করা হয়। লালন সাঁইয়ের সৃষ্টির কীর্তি আজ বিশ্বে সর্বজনীন। ছড়িয়েছে বিশ্বে, হচ্ছে উন্নতর গবেষণা। লালন সাঁই জাত-ধর্মের সীমাবদ্ধতার বাইরে মানুষকে সবার ওপর তুলে ধরেছেন। লালন তার গানের ভেতর দিয়ে সমাজের অসঙ্গতি, কুপ্রথা সকল জাতপাতের ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। লালন শাহর অমরত্বের জন্যই কুষ্টিয়ার ছেউড়িয়া এখন বিশ্ব মরমীর তীর্থ কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। লালন সাঁই বাঙালির চেতনায় এক অবিস্মরণীয় কালপুরুষ। তার গানের মাঝেই লুকিয়ে আছে সৃষ্টির রহস্য। সৃষ্টিকর্তার সাথে আত্মিক সম্পর্ক তার গানের মূলমন্ত্র। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষকে একই স্রোতধারায় আনার জন্য আমরণ কাজ করেছেন এই মরমী সাধক।