জাতীয় সংসদ নির্বাচন এখনো অনেক দূর। তাই বলে বসে থাকার পাত্রও নন মনোনয়নপ্রত্যাশীরা। তারা মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন। বর্তমানে দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল ও আগামীতে সরকার গঠনের প্রধান দাবিদার বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশীরা নির্বাচনি মাঠে সবচেয়ে বেশি সরব।
তারা দলের শীর্ষ কমান্ডের মনোযোগ আকর্ষণ করতে নেমেছেন ময়দানে। নিজেদের নির্বাচনি এলাকায় যাচ্ছেন নিয়মিত। রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ ছাড়াও যোগ দিচ্ছেন সামাজিক অনুষ্ঠানে। চালাচ্ছেন গণসংযোগ।
সিলেটেও এর ব্যতিক্রম হচ্ছে না। দেশের সবচেয়ে আলোচিত ও মর্যাদাপূর্ণ আসন সিলেট-১ ছাড়াও প্রত্যেকটিতে দলের মনোনয়নপ্রত্যাশীরা নেমেছেন কোমর বেঁধে। তাদের তৎপরতায় চাঙ্গা সিলেট বিএনপির মাঠরাজনীতি। কেন্দ্রের চাওয়াও তাই।
বিএনপির কারা প্রার্থী হতে চাইছেন, কারা মনোনয়ন পেতে পারেন সিলেটে এ নিয়ে এরই মধ্যে শুরু হয়েছে মাতামাতি। চায়ের দোকান থেকে রাজনীতির অন্দরমহলÑ সর্বত্রই এখন এই কানাঘুষা, গুঞ্জন। সিলেটের ছয়টি আসনে বিএনপির মনোনয়ন পেতে চান অন্তত তিন ডজন নেতা। তাদের মধ্যে আছেন হেভিওয়েট প্রার্থীও। এবার ৬টি আসনেই জয়ের সবচেয়ে বেশি সম্ভাবনা থাকায় শেষ পর্যন্ত সবাই মনোনয়নের জন্য জোর তৎপরতা চালাবেন।
বিএনপির একাধিক সূত্র জানিয়েছে, হেভিওয়েট অনেক প্রার্থীকে শেষ পর্যন্ত সংসদ নির্বাচনের টিকিট না দিয়ে অন্যভাবে তাদের মূল্যায়ন করা হতে পারে।
সূত্র জানায়, এবার মুখ দেখে নয়, মনোনয়ন দেওয়ার ক্ষেত্রে দলের প্রতি অতীতে তার ভূমিকা ও ত্যাগের বিষয়টি গুরুত্ব দেওয়া হবে। যারা দলের বিপদের সময়ে নিরাপদ দূরত্বে ছিলেন, এখন সুবিধাজনক সময়ে এসে আবার কাছে ভিড়েছেন তারা দলে গুরুত্ব পেলেও সংসদের টিকিট পাওয়ার ব্যাপারে তাদের কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হবে। চোরাচালান, চাঁদাবাজি, দখলবাণিজ্য, আওয়ামী লীগের সাথে সুসম্পর্ক এমন বিষয়ে নাম জড়িত থাকলে তাদের ভুগতে হবে সীমাহীন। বলা হচ্ছে, দলীয় মনোনয়ন প্রদানের বেলায় এসব বিষয় অযোগ্যতা হিসেবে বিবেচনা করা হবে।
তবে ২-১ জন ছাড়া বাকি সবাই যে নতুন মুখ আসতে চলেছেন, এটি প্রায় নিশ্চিত। পুরোনো সংসদে ছিলেন, এবারও তারা আবার সংসদে যেতে চান সিলেটে বিএনপির এমন প্রার্থী নেই। আগে প্রার্থিতা চেয়ে হেরেছেন এমন একাধিক প্রার্থী আছেন মনোনয়নপ্রত্যাশীদের তালিকায়।
অতীতের সব নির্বাচনে সিলেট বিভাগের আসনগুলোয় মনোনয়ন দেওয়ার বেলায় বিএনপি কিংবা আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী মহলে বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছেন প্রবাসীরা। এমপি হয়ে মন্ত্রীও হয়েছেন এমন কেউ কেউ। এবারের নির্বাচনেও বিএনপি তাদের প্রার্থী তালিকায় প্রবাসীদের গুরুত্ব দিতে পারে। এমন সম্ভাবনা উঁকি দিচ্ছে প্রবাসীদের আগ্রহ ও দেশে এসে গণসংযোগ অব্যাহত রাখায়।
লন্ডনের একাধিক দলীয় সূত্র জানিয়েছে, সিলেটের ছয় আসনের মধ্যে অন্তত ২টি আসনে বিএনপির টিকিটে ধানের শীষ নিয়ে সংসদে যাওয়ার লড়াই করতে দেখা যেতে পারে দুই প্রবাসীকে। যারা জিয়া পরিবার তথা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের অত্যন্ত কাছের মানুষ হিসেবে পরিচিত। আছেন এক নারীও। যিনি সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হয়ে সংসদে যেতে পারেন বিএনপির টিকিটে।
মর্যাদাপূর্ণ সিলেট-১ আসন নিয়ে আলোচনা সারা বাংলাদেশে। বলা হয়, সিলেট-১ যার, সরকার তার। স্বাধীনতা-পরবর্তী সব নির্বাচনেই এটি সত্যে পরিণত হয়েছে। ফলে এই মিথের ওপর এখন রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থা প্রায় শতভাগ। সেজন্য সব দলই হযরত শাহজালাল রহ. হযরত শাহপরান রহ.-এর পুণ্যভূমি সিলেট-১ (সিলেট সিটি করপোরেশন এলাকা ও সিলেট সদর) আসনে খুব যাচাই-বাছাই করে সেরা প্রার্থীর হাতে দলের প্রতীক তুলে দেয়। যাতে সিলেট-১ হাতছাড়া হবার সাথে সাথে সরকারই হাতছাড়া হয়ে না যায়। এ জন্য এ আসনে সিলেট বিএনপি আশা করছে ডা. জোবাইদা রহমানকে। তবে তিনি প্রার্থী হচ্ছেন না, এটা প্রায় নিশ্চিত।
এ আসনে সর্বশেষ নির্বাচনি বিএনপির প্রার্থী ছিলেন খন্দকার আব্দুল মুক্তাদির। যিনি দলের চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের অন্যতম সদস্য ও সিলেট বিএনপির শীর্ষ নীতিনির্ধারকদের একজন। দলীয় পেশিশক্তির কারণে গেল নির্বাচনে তিনি পরাজিত হলেও লড়েছেন শক্তভাবে। লন্ডনে জিয়া পরিবারের ঘনিষ্ঠতা খন্দকার পরিবারের। সেই সুবাদে তিনি এতদিন একক প্রার্থী হিসেবে দলের হয়ে মাঠ চষে বেড়াচ্ছিলেন। কিন্তু তার সাথে সম্প্রতি এসে ভাগ বসিয়েছেন সিলেটের জনপ্রিয় নেতা আরিফুল হক চৌধুরী। যিনি সিলেট সিটি করপোরেশনের একাধিক বারের নির্বাচিত মেয়র। তবে দলীয় মহল থেকে বলা হচ্ছে, আরিফুল হক চৌধুরীকে অন্য কোথাও দিয়ে বা মেয়র পদে আবার টিকিট দিয়ে সিলেট-১ এ ধানের শীষ তুলে দেওয়া হবে খন্দকার আব্দুল মুক্তাদিরের হাতে। এখন পর্যন্ত এই সুর শোনা যাচ্ছে সর্বত্র। সূত্র মতে, আরিফুল হক চৌধুরীকে সিলেটের অন্য আরেকটি আসনে প্রার্থী করা হতে পারে।
সিলেট-২ আসনে বিএনপির একসময়ে সংসদ সদস্য ছিলেন এম ইলিয়াস আলী। গুমের শিকার হওয়ায় তার শূন্যতা এখন বিশ্বনাথ ও ওসমানীনগর উপজেলা নিয়ে গঠিত সিলেট-২ আসনে। তার অনুপস্থিতিতে অতীতে বিএনপির টিকিটে প্রার্থী হয়েছিলেন ইলিয়াসপত্নী তাহসিনা রুশদির লুনা। তবে আইনি মারপ্যাঁচে তার প্রার্থিতা বাতিল হয়ে গেলে তিনি লড়তে পারেননি। এবার তিনি প্রার্থী। একই আসনে মনোনয়নপ্রত্যাশী আরও দুজন। তাদের একজন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা, লন্ডনে জিয়া পরিবারের নিকটজন হুমায়ুন কবির। অপরজন ছাত্রদলের প্রাক্তন নেতা এবং যুক্তরাজ্য বিএনপির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক জসিম উদ্দিন সেলিম।
এ আসনে তৃণমূলে দলকে যখন কোন্দলমুক্ত, সুসংগঠিত রাখতে হিমশিম খাচ্ছেন লুনা, একাধিক বলয়ে যখন বিশ্বনাথ ও ওসমানীনগর বিএনপি বিভক্ত, তখন এই দুজনের নাম আলোচিত হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। দেশ ও লন্ডনের দলীয় ফোরামে তাদের নাম আলোচনায় আসছে। এ প্রতিবেদকের সাথে আলাপকালে তারা নিজেদের প্রত্যাশার কথা ব্যক্তও করেছেন।
সিলেট-৩ আসনে (দক্ষিণ সুরমা-ফেঞ্চুগঞ্জ ও বালাগঞ্জ) আছেন একাধিক হেভিওয়েট প্রার্থী। যুক্তরাজ্য বিএনপির সভাপতি এম এ মালেক, প্রবাসী নেতা ব্যারিস্টার এম এ সালাম রয়েছেন টিকিটের দাবিদার। সিলেট জেলা বিএনপির সভাপতি আব্দুল কাইয়ুম চৌধুরী, সিলেট জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি, ত্যাগী নেতা আবদুল আহাদ খান জামাল, জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি ও সংসদ সদস্যপ্রার্থী এমএ হকের পুত্র ব্যারিস্টার আসাদ আজিম আদনানও দলের মনোনয়ন চাইবেন। কাইয়ূম চৌধুরী ও খান জামাল সেই লক্ষ্যে নিজের আসন চষে বেড়াচ্ছেন।
কোম্পানীগঞ্জ, গোয়াইনঘাট ও জৈন্তাপুর নিয়ে গঠিত সিলেট-৪ আসনে প্রার্থী হিসেবে আলোচনার শীর্ষে মহানগর বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক বদরুজ্জামান সেলিমের নাম ঘুরপাক খাচ্ছে। তার সাথে আছেন গোয়াইনঘাট উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও জেলা বিএনপির উপদেষ্টা আব্দুল হাকিম চৌধুরী, সিলেট জেলা বিএনপির উপদেষ্টা ও যুক্তরাজ্য প্রবাসী হেলাল উদ্দিন।
সিলেট-৫ আসন জকিগঞ্জ ও কানাইঘাট উপজেলা নিয়ে গঠিত। এ আসনে জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি মামুনুর রশিদ, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও ছাত্রদল কেন্দ্রীয় সংসদের সাবেক সহ-সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান পাপলু, সাবেক উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আশিক উদ্দিন চৌধুরী তৎপরতা চালাচ্ছেন। আলোচনায় আছেন সিলেট মহানগর স্বেচ্ছাসেবক দলের আহ্বায়ক মাহবুবুল হক চৌধুরী (ভিপি মাহবুব), সিলেট জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি ইকবাল আহমদ তাপাদারও।
গোলাপগঞ্জ ও বিয়ানীবাজার নিয়ে গঠিত সিলেট-৬ আসনে নাম আছে বিএনপির আরেক হেভিওয়েট প্রার্থী বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা ড. এনামুল হক চৌধুরীর। জিয়া পরিবারের জন্য নিবেদিত ড. চৌধুরী বিএনপির নীতিনির্ধারণী ফোরামের অন্যতম সদস্য। বেগম জিয়া ও তারেক রহমানের অত্যন্ত আস্থাভাজন এই নেতার টিকিট পাওয়ার দৌড়ে রয়েছেন সবার আগে।
অনেকে বলছেন, শুধু ‘আনুষ্ঠানিকতার বাকি’ দূরত্বে রয়েছেন তিনি। এ আসনে শিল্পপতি ফয়সাল আহমেদ চৌধুরী, বিএনপির কেন্দ্রীয় সদস্য আবুল কাহের শামীম, জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক এমরান আহমদ চৌধুরী, যুক্তরাজ্য বিএনপির সাবেক সভাপতি কমর উদ্দিনের কন্যা সাবিনা খান, অভিনেতা হেলাল খান, জেলা বিএনপির শিল্প ও বাণিজ্যবিষয়ক সম্পাদক তামিম ইয়াহইয়া মনোনয়নের জন্য লড়তে পারেন।
আপনার মতামত লিখুন :