ঢাকা সোমবার, ১৩ অক্টোবর, ২০২৫

বিদ্যালয়ের কক্ষে প্রধান শিক্ষকের সংসার, মাঠ গোচারণ ভূমি

হাসানুজ্জামান হাসান, কালীগঞ্জ
প্রকাশিত: অক্টোবর ১৩, ২০২৫, ১২:৪১ পিএম
বিদ্যালয়ের একটি কক্ষকে সরকারি অর্থে সংস্কার করে নিজের সংসার গড়ে তুলেছেন হাতীবান্ধা সহর উদ্দিন সরকার সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক ইমরান আলী। ছবি- রূপালী বাংলাদেশ

বিদ্যালয়ের একটি কক্ষকে সরকারি অর্থে সংস্কার করে নিজের সংসার গড়ে তোলার অভিযোগ উঠেছে লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা সহর উদ্দিন সরকার সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক ইমরান আলীর বিরুদ্ধে। আর বিদ্যালয়ের মাঠ পরিণত হয়েছে গোচারণ ভূমিতে।

জানা গেছে, হাতীবান্ধা উপজেলা সদরে ১৯৪৬ সালে সহর উদ্দিন সরকার উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। যা গত ২০১৮ সালের ১১ এপ্রিল জাতীয়করণ হয়। প্রায় ৯ একর কৃষিজ ও কিছু বাণিজ্যিক স্থাপনা সম্পদের এ প্রতিষ্ঠানে বার্ষিক আয় প্রায় অর্ধকোটি টাকার ওপর। গত ২০২৩ সালের ২২ নভেম্বর বিদ্যালয়টিতে সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন ইমরান আলী। এরপর প্রতিষ্ঠানের প্রধান শিক্ষক রেজাউল করিম প্রধান গত বছরের সালের ৩০ সেপ্টেম্বর অবসর গ্রহণ করলে সহকারী শিক্ষক ইমরান আলী ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণের পর থেকে প্রতিষ্ঠানকে দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত করেছেন বলে স্থানীয়দের অভিযোগ। সরকারি এ প্রতিষ্ঠানটির কৃষিজ ও বাণিজ্যিক জমি ভবন থেকে আদায় করা অর্থ সরকারি কোষাগারে জমা না করে প্রতিষ্ঠানের বিএম শাখার (বেসরকারি) একটি ব্যাংক হিসাব নম্বরে জমা করে নিজের একক স্বাক্ষরে উত্তোলন করেন। সরকারি প্রতিষ্ঠানের ব্যয় পরিচালনা বিধির ২ এর ৪ এবং ৫ নম্বর উপধারায় ৩ সদস্যের একটি অভ্যন্তরীণ অডিট কমিটি করতে বলা হয়েছে। কিন্তু দীর্ঘদিনেও এ প্রতিষ্ঠানে এসংক্রান্ত কোনো কমিটি করা হয়নি।

যার কারণে, ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক ইমরান আলী একক সিদ্ধান্তে বিদ্যালয়টি পরিচালনা করে দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত করেছেন বলে স্থানীয়দের দাবি।

শুধু তাই নয়, ইমরান আলী ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক হলেও নিজে নিজেকে 'ভারমুক্ত' করে সরাসরি প্রধান শিক্ষক দাবি করছেন। প্রধান শিক্ষকদের অনার বোর্ডেও ভারপ্রাপ্ত শব্দটি লেখেননি তিনি। যা নিয়ে চলছে নানা সমালোচনা।

বিদ্যালয়টির একটি পুরনো ভবন সংস্কার করতে ঠিকাদার নিয়োগ করে গণপূর্ত অধিদপ্তর। সেই সংস্কার কাজে ঠিকাদারকে বাগিয়ে বিদ্যালয়ের একটি রুমে করেছেন নিজের আবাসন ব্যবস্থা। সেখানে অত্যাধুনিক সুযোগ সুবিধা দিয়ে রুমটি সাজিয়ে নিয়ে বসবাস করছেন ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক ইমরান আলী। সরকারি ভাবন বা আবাসনে বসবাস করলে বিধিমতো বাড়িভাড়া কর্তন করার নিয়ম থাকলেও এখানে তা মানা হচ্ছে না।

একই সাথে সরকারি এ প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত অর্থ আদায় করার অভিযোগও রয়েছে অভিভাবকদের। সম্প্রতি ১৬৭ জন শিক্ষার্থীর অষ্টম শ্রেণির রেজিস্ট্রেশন ফি আদায়েও জনপ্রতি প্রায় ৫৫ টাকা অতিরিক্ত আদায়ের অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগ রয়েছে, বিগত এসএসসি পরীক্ষার্থীদের কাছ থেকে ফরম পূরণের সময় জোরপূর্বক জনপ্রতি দুই হাজার টাকা কোচিং ফি আদায় করা হয়। 

সরেজমিনে রোববার প্রতিষ্ঠানটিতে গেলে দেখা যায়, বিশাল মাঠ মাড়িয়ে শ্রেণিকক্ষে যেতে হচ্ছে শিক্ষার্থীদের। সেই মাঠে অবাধে বিচরণ করছে গরু-ছাগল। বিদ্যালয়ের মাঠটি যেন গোচারণ ভূমিতে পরিণত হয়েছে। গবাদিপশুর বিষ্ঠার দুর্গন্ধে মাঠে খেলাধুলা তো দূরের কথা চলাচল করাও কষ্টকর। অনেক সময় শিক্ষার্থীরা চলতে গিয়ে পা পিছলে পড়ে নোংরা করছে পোশাক। বিদ্যালয়ের পূর্ব পকেট গেটের পাশেই ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের স্বঘোষিত বাসস্থান।

মাঠে চলাচল করা হাতীবান্ধা ২ নম্বর মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দপ্তরি কাম নৈশপ্রহরী আহেদ আলী বলেন, এ মাঠটি দুটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ব্যবহার করে আসছে। যার চার দিকে প্রাচীর দেওয়া থাকলেও দুটি পকেট গেট দিয়ে এসব গরু ছাগল চারণ করান স্থানীয়রা। এসব বন্ধে লিখিত অভিযোগ দিয়েছি। কিন্তু কোনো প্রতিকার পাইনি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নবম শ্রেণির এক শিক্ষার্থী বলেন, গৌরবের এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এখন কর্তৃপক্ষের দায়িত্বহীনতায় দিন দিন জৌলুস হারাচ্ছে। গরু-ছাগল বিষ্ঠা মাড়িয়ে ক্লাসে যেতে হয়। গোবরের গন্ধে খেলাধুলা তো দূরের কথা চলাচলেও দুর্ভোগ পেতে হচ্ছে। এসব দ্রুত অপসরণের দাবি জানায় এ শিক্ষার্থী।

বিদ্যালয়টির সহকারী শিক্ষক শাহি সোহাম্মদ আকতারুদোজা বলেন, প্রায় সময় কলিগদের কাছে শুনি, ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক ইমরান আলী ক্লাস রুমে শিক্ষার্থীদের সামনে শিক্ষকের সঙ্গে অশালীন আচরণ করেন। তার অশালীন আচরণ থেকে মুক্তি পাননি নারী শিক্ষকও। যদিও আমার সাথে কখনও এমনটা করেননি।

বিদ্যালয়টির সহকারী শিক্ষক (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) বলেন, ভারপ্রাপ্ত প্রধান হয়ে নিজেকে ভারমুক্ত পরিচয় দিচ্ছেন ইমরান আলী। অভ্যন্তরীণ অডিট কমিটির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানের আয় ব্যয় নিরীক্ষণের ব্যবস্থা কথা বললেও তিনি কর্ণপাত করেন না। পাবলিক পরীক্ষার কেন্দ্র ফি পর্যন্ত আত্মসাৎ করেছেন। প্রতিষ্ঠানের কোনো হিসাব কাউকে দেন না। বিদ্যালয়ের একটি কক্ষ তিনি দখল করে বসবাস করছেন।

বিদ্যালয়টির ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক ইমরান আলী বলেন, দূর থেকে এসেছি একটি রুম মুসাফির হিসেবে ব্যবহার করতেই পারি! এটা কোনো অপরাধ নয়। আবাসিক নয়, বাড়ি ভাড়া কেন কর্তন হবে। আর আয় ব্যয়ের জন্য অভ্যন্তরীণ অডিট কমিটি আগামী ডিসেম্বরে গঠন করা হবে। মন্ত্রণালয় কোনো কোড বা নির্দেশনা না দেওয়ায় প্রতিষ্ঠানের আয় একটি ব্যাংক হিসাব নম্বরে জমা করা হচ্ছে। তবে হিসাব নম্বর জানতে চাইলে তিনি দেখাতে অপারগতা প্রকাশ করে বলেন, আমি সরকারি চাকরি করি একটি টাকাও আত্নসাৎ করার ইচ্ছে আমার নেই।

মাধ্যমিক উচ্চ শিক্ষা রংপুর অঞ্চলের উপপরিচালক রোকসানা বেগম বলেন, বিদ্যালয়ের রুমে বসবাস করার সুযোগ নেই। আমি নতুন যোগদান করেছি তাই বিষয়গুলো জানা নেই। তবে পুরো বিষয়টি তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দেন তিনি।