শেরপুরের শ্রীবরদী উপজেলার গড়জরিপা ইউনিয়নের গড়জরিপা উত্তরপূর্বপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চিত্র যেন দেশের শিক্ষা খাতের অব্যবস্থাপনার একটি প্রতিচ্ছবি। বছরের পর বছর ধরে মাত্র ৫ থেকে ৬ জন শিক্ষার্থী নিয়ে চলছে বিদ্যালয়ের পাঠদান কার্যক্রম, অথচ সেখানে কর্মরত রয়েছেন ৫ জন শিক্ষক।
স্থানীয়দের অভিযোগ, প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগ ও বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের যোগসাজশে চলছে সীমাহীন অনিয়ম এবং সরকারি অর্থের অপচয়।
গত ৭ জুলাই দুপুরে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বিদ্যালয়ের ক্লাসে উপস্থিত শিক্ষার্থী মাত্র ৫ জন। অন্যদিকে প্রধান শিক্ষক মো. আব্দুল হালিমসহ তিনজন নারী শিক্ষক ছিলেন স্কুলে। এক নারী শিক্ষককে ঘুমিয়ে থাকতে দেখা যায় ক্লাসরুমে পাতা মাদুরে, আরেকজন ছিলেন অনুপস্থিত। এমন দৃশ্য দেখে এলাকাবাসী হতবাক ও ক্ষুব্ধ। তাদের প্রশ্ন—৫ জন ছাত্রের জন্য ৫ জন শিক্ষক কেন? এবং তারা ঠিক কীসের বেতন নিচ্ছেন?
প্রধান শিক্ষক অবশ্য দাবি করেন, ওইদিন সকালে আরও ১১ জন শিক্ষার্থী উপস্থিত ছিল। তবে বিদ্যালয়ের দীর্ঘদিনের চিত্র বলছে, এমন উপস্থিতি বড়জোর সাময়িক। বছরজুড়ে শিক্ষার্থী সংকটই নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিদ্যালয়টি ২০১০ সালে যাত্রা শুরু করে কোনো স্থায়ী অবকাঠামো ছাড়াই, একটি টিনের চালা আর একটি সাইনবোর্ডকে কেন্দ্র করে। এরপর ২০১৩ সালে জাতীয়করণ করা হয়, যদিও তখন থেকেই শিক্ষার্থী সংকট প্রকট ছিল। করোনা মহামারির পর ২০২২ সাল থেকে বিদ্যালয়ে নিয়মিতভাবে ৮ থেকে ১০ জন শিক্ষার্থী উপস্থিত থাকত। এখন সে সংখ্যাও নেমে এসেছে ৫-৭ জনে। সকাল ও বিকেলের আলাদা সেশনে ক্লাস হলেও শিক্ষার্থী সংখ্যা এতই কম যে, কার্যত পাঠদান কার্যক্রম নিয়েই প্রশ্ন উঠেছে।
সবচেয়ে বিস্ময়কর তথ্য হলো, এই বিদ্যালয়ের আধা কিলোমিটারের মধ্যেই রয়েছে আরেকটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। অথচ সরকার প্রণীত ‘প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন ও জাতীয়করণ নীতিমালা ২০১৩’ অনুযায়ী এক কিলোমিটারের মধ্যে দ্বিতীয় কোনো বিদ্যালয় স্থাপন বা জাতীয়করণ নিষিদ্ধ। এই নীতিমালা কীভাবে উপেক্ষিত হলো তার কোনো জবাব নেই প্রশাসনের কাছে।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, বিদ্যালয়ে কার্যত কোনো পাঠদান নেই। শিক্ষকরা নিয়মিত উপস্থিত হলেও কেউ ক্লাস নেন না, কেউ ঘুমিয়ে সময় কাটান, কেউ বা আসেনই না। প্রাথমিক শিক্ষা অফিসাররা এসব জানেন, কিন্তু চোখ বুজে থাকেন। ফলে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সবাই লাভবান হচ্ছেন—সরকারি টাকার বিনিময়ে।
শিক্ষকরা অবশ্য দাবি করেন, তারা নিয়মিত ক্লাস নিতে চেষ্টা করেন। সহকারী শিক্ষিকা জাকিয়া সুলতানা, হেলেনা খাতুন ও রওশন আরা রিপা বলেন, ‘শিক্ষার্থী সংখ্যা খুবই কম, কেউ সময়মতো আসে না, আবার ঝরে পড়ে।’ প্রধান শিক্ষক হালিম বিষয়টি ব্যাখ্যা করে বলেন, ‘এলাকাটি অত্যন্ত দারিদ্র্যপীড়িত। অনেক অভিভাবক সন্তানদের স্কুলে না পাঠিয়ে কাজে পাঠান। কেউ কেউ অটোরিকশা চালায়, কেউ যায় স্থানীয় মাদ্রাসায়।’
কুরুয়া ক্লাস্টারের দায়িত্বপ্রাপ্ত সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা গোলাম মোস্তফা বলেন, ‘তিনি সম্প্রতি দায়িত্ব নিয়েছেন এবং বিদ্যালয়টির এমন দুরবস্থা সম্পর্কে অবগত ছিলেন না। তবে তিনি জানান, প্রধান শিক্ষককে মহাসমাবেশ আয়োজনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে এবং যদি শিক্ষার্থী সংকট না কাটে, তবে বিদ্যালয়টি বন্ধ করার চিন্তা করা হচ্ছে।’
উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার মো. তৌফিকুল ইসলাম জানান, ঘটনাটি তিনি আগে জানতেন না। সাংবাদিকদের মাধ্যমেই প্রথম জানতে পারেন। ইতোমধ্যে একজন সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তাকে পাঠানো হয়েছে এবং প্রতিবেদন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও আশ্বস্ত করেন তিনি। তবে যোগসাজশের অভিযোগ অস্বীকার করেন।
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. সায়েদুল ইসলাম বিষয়টি আরও খোলাসা করে বলেন, ‘এ ধরনের বিদ্যালয় দেশের অনেক জায়গাতেই আছে। বাস্তবতা বিবেচনায় বদল আনতে হবে। শুধু জাতীয়করণ বা শিক্ষক নিয়োগ করলেই দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। যেখানে শিক্ষার্থী নেই, সেখানে বিদ্যালয় একীভূত করা কিংবা বন্ধ করা উচিত। তদন্ত করে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’