ঠাকুরগাঁওয়ে তিন মাদ্রাসা ছাত্রীর নিখোঁজের ঘটনায় রহস্য আরও ঘনীভূত হচ্ছে। ৪৮ দিন পার হলেও এখনো তাদের কোনো সন্ধান মেলেনি। নিখোঁজের দিন রাতেই তারা ঠাকুরগাঁও শহরের রোড এলাকার একটি আবাসিক হোটেলে ওঠে। তবে ভোর হওয়ার আগেই হোটেল ত্যাগ করে অদৃশ্য হয়ে যায় তিনজন। এরপর থেকে তাদের কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি।
এ ঘটনায় গত ৯ সেপ্টেম্বর ঠাকুরগাঁও সদর থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা হয়।
নিখোঁজের প্রায় দুই মাস পার হলেও সন্তানদের সন্ধান না পেয়ে আহাজারি থামছে না অভিভাবকদের। প্রতিদিন তারা লিফলেট হাতে নিয়ে প্রশাসনের বিভিন্ন দপ্তরে ছুটে বেড়াচ্ছেন, তবুও মিলছে না কোনো সান্ত্বনা কিংবা নিশ্চিত খবর।
নিখোঁজ তিন শিক্ষার্থী হলো: দিনাজপুরের বীরগঞ্জ উপজেলার মুরারিপুর গ্রামের শাহজালালের মেয়ে জুঁই (১৪), একই উপজেলার গণকপয়েনর গ্রামের জাহাঙ্গীর আলমের মেয়ে জান্নাতুল ফেরদৌস তামান্না (১৬) এবং ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার গোবিন্দনগর এলাকার রবিউলের মেয়ে আয়শা সিদ্দিকা (১৩)। তারা তিনজনই ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার সালন্দর মাদ্রাসা পাড়া এলাকার ‘আয়শা সিদ্দিকা বালিকা মাদ্রাসা’র ছাত্রী।
মাদ্রাসা সূত্রে জানা যায়, গত ৮ সেপ্টেম্বর রাত ১২টার দিকে শেষবার মাদ্রাসায় দেখা যায় নিখোঁজ তিন ছাত্রীকে। ভোর ৫টার সময় তাদের ডাকতে রুমে গেলে দেখা যায়, তারা নেই। পরে দোতলার বারান্দায় মশারি ঝুলন্ত অবস্থায় দেখতে পেয়ে মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ ধারণা করে, তারা পালিয়ে গেছে।
শহরের বিভিন্ন স্থানের সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণে দেখা যায়, রাত ১টার দিকে তিন ছাত্রী একটি রিকশায় করে ঠাকুরগাঁও শহরের পুরাতন বাসস্ট্যান্ডে যায়। সেখান থেকে রিকশা বদল করে তারা ঠাকুরগাঁও রেলস্টেশনে পৌঁছায়। তবে সেদিন রাতে কোনো ট্রেন না থাকায় তারা শহরের রোড এলাকায় একটি আবাসিক হোটেলে ওঠে এবং ভোর ৪টা পর্যন্ত সেখানে অবস্থান করে।
পরে হোটেল ম্যানেজারের সহযোগিতায় তারা আবার রেলস্টেশনে যায়, কিছু সময় সেখানে অবস্থান করে পুনরায় রোড অটোস্ট্যান্ডে ফিরে আসে এবং ঠাকুরগাঁও পীরগঞ্জের উদ্দেশ্যে একটি অটোরিকশায় রওনা হয়। এরপর থেকেই তাদের আর কোনো খোঁজ মেলেনি।
রোড আবাসিক হোটেলের ম্যানেজার আসাদুজ্জামান ইমন বলেন, ‘রাত ২টার দিকে তিনজন মেয়ে এসে জানায় তারা কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেবে, ভোরেই চলে যাবে। পরে আমি তাদের ব্যাগ গাড়িতে তুলে দিই।’ তবে হোটেল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, অতিথিদের নাম-ঠিকানা রেজিস্টারে লিপিবদ্ধ করা হয় না।
নিখোঁজদের পরিবার জানায়, ‘আমরা থানায় গেছি, প্রশাসনের দপ্তরে দপ্তরে ঘুরেছি, কিন্তু কোনো সুরাহা হচ্ছে না। পুলিশ শুধু বলছে তদন্ত চলছে। ৪৮ দিনেও মেয়েদের খোঁজ না পেয়ে আমরা হতাশ। তারা কেমন আছে, কোথায় আছে—শুধু আল্লাহই জানেন। আমরা আমাদের সন্তানদের ফিরে পেতে চাই।’
নিখোঁজ তামান্নার মা আকলিমা বেগম বলেন, ‘মাদ্রাসায় অনেক শিক্ষার্থী থাকলেও কোনো নিরাপত্তা প্রহরী ছিল না। ভবনের বারান্দায় কোনো গ্রিলও নেই, ফলে সহজেই কেউ ভেতরে ঢুকতে বা বাইরে যেতে পারে। আমরা আমাদের মেয়েদের নিরাপত্তার ভরসায় সেখানে রেখেছিলাম।’
নিখোঁজ আয়শার বোন লাবনী বলেন, ‘আমরা জেনেছি মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ নিয়মিত শিক্ষার্থীদের মারধর ও নির্যাতন করত। আমার বোন নিখোঁজ হওয়ার কিছুদিন আগে জানিয়েছিল, ওখানে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে এবং দ্রুত নিয়ে যেতে বলেছিল। আমরা আনিনি, আজ সেই জন্যই হয়তো বোনকে হারাতে হলো। আমি নিশ্চিত, মাদ্রাসার নির্যাতনের কারণেই তারা পালিয়েছে।’
নিরাপত্তার ঘাটতির দায় স্বীকার করে আয়শা সিদ্দিকা মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষক হামিদা বেগম বলেন, ‘আমরা বুঝতে পারিনি এত দ্রুত এমন ঘটনা ঘটবে। আমরা মাদ্রাসার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কাজ করছিলাম। তবে আমার বিরুদ্ধে নির্যাতনের অভিযোগ ভিত্তিহীন।’
এ বিষয়ে ঠাকুরগাঁওয়ের পুলিশ সুপার শেখ জাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘তিন শিক্ষার্থী নিখোঁজের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হচ্ছে। ইতোমধ্যে একাধিক সংস্থা তদন্ত করছে। পুলিশের পক্ষ থেকে কোনো গাফিলতি নেই।’
ঠাকুরগাঁও জেলা প্রশাসক ইশরাত ফারজানা বলেন, ‘ছাত্রীদের নিখোঁজের পরই পুলিশ সুপারসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অবহিত করা হয়েছে। আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি তাদের খুঁজে বের করার। আশা করছি, দ্রুতই তারা পরিবারের কাছে ফিরে আসবে।’




