ঢাকা মঙ্গলবার, ২১ অক্টোবর, ২০২৫

প্রকৃতির কোলে মুখ লোকাতে পছন্দ করতেন ওমর আলী

রূপালী সাহিত্য
প্রকাশিত: অক্টোবর ২০, ২০২৫, ০৯:১৫ পিএম
এআই দিয়ে ছবিটি বানানো।

বাঙালি সাহিত্যের জগতের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হয়ে আছেন কবি ওমর আলী। তিনি কোনোদিনও শহুরে কোলাহলে মিশে যেতে চাননি, বরং প্রকৃতির কোলে, গ্রামীণ বাংলার মাটির গন্ধে সিক্ত হয়ে নিজেকে ধারণ করেছেন। তার কবিতায় বাংলার গ্রামের সৌন্দর্য, মানুষের সরলতা, প্রকৃতির কোমলতা ফুটে ওঠে, যা আমাদের মনকে এক অচেনা বিশ্বে নিয়ে যায়। যদিও কলকাতা ও ঢাকার মতো রাজধানী কেন্দ্রিক সাহিত্য পরিবেশ থেকে দূরে থাকায় তার নাম অনেক সময় ‘আড়ালে’ থেকে যায়, তবু তার কবিতার গভীরতা ও স্বকীয়তা কখনো লুকায় না।

১৯৩৯ সালের ২০ অক্টোবর পাবনার চরশিবরামপুরে কবি ওমর আলীর জন্ম। স্কুলজীবনের শুরু থেকেই তার কবিতা ঢাকা ও কলকাতার পত্রপত্রিকায় প্রকাশ পেতে থাকে। শিক্ষাজীবনে তিনি মেধাবী ছাত্র ছিলেন এবং ঢাকা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের পর শিক্ষকতা পেশা বেছে নেন। পাবনা শহরে থাকাকালীন তিনি শিক্ষকতা ও টিউশনি করতেন, কিন্তু প্রকৃতির প্রতি তার আকর্ষণ ছিল অবিচল। ছুটি পেলেই গ্রামের প্রকৃতিতে হারিয়ে যেতেন তিনি।

ওমর আলীর সাহিত্যিক পথচলা শুরু হয় প্রাথমিক বয়সেই,  আর সেই বয়স থেকেই তার কবিতাগুলো পত্রিকায় প্রকাশ পেত। ১৯৬০ সালের দশকে তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘এ দেশে শ্যামল রঙ রমণীর সুনাম শুনেছি’ প্রকাশিত হয়, যা পাঠক ও সমালোচকদের হৃদয় জয় করে নেয়। এরপর বহু কাব্যগ্রন্থ, উপন্যাস ও ছড়া প্রকাশিত হলেও তার কবিতার মৌলিকতা ও সরলতাই সর্বদাই আকর্ষণীয় ছিল। তিনি আধুনিক কবিতার ধারা অনুসরণ করলেও নাগরিক জীবনের কৃত্রিমতা ও ভোগসর্বস্বতার প্রতি তার বিরাগ প্রকাশ পায় তার কবিতায়। সেই বিরাগ কখনো সরল কাব্যরূপে, আবার কখনো শ্লেষের ছলে।

কবি ওমর আলীর কবিতায় প্রধান থিম ছিল প্রেম, প্রকৃতি ও গ্রামীণ জীবন। তিনি নারীর সৌন্দর্য, গ্রামবাংলার ঐতিহ্য ও মাটির গন্ধকে শিল্পমাধুর্যে তুলে ধরেন। তার কবিতায় যেমন জীবনানন্দের ছোঁয়া পাওয়া যায়, তেমনি তিনি নিজস্ব সুরে বাংলা কবিতাকে সমৃদ্ধ করেছেন। তার কাব্য রচনায় উপমা ও উৎপ্রেক্ষার ব্যবহার অসাধারণ, যা পাঠককে গভীরভাবে অনুভব করাতে সক্ষম।

শিক্ষক ও সাহিত্যিক হিসেবে তার জীবন ছিল সাদামাটা, সরল এবং প্রকৃতির প্রতি গভীর টানযুক্ত। শহরের চাঞ্চল্য থেকে দূরে থেকে তিনি নিজের কবির মনটিকে সুরক্ষিত রাখতে চেয়েছিলেন। এই কারণেই হয়তো তিনি দীর্ঘ সময় ধরে শহুরে সাহিত্য বৃত্ত থেকে দূরে থেকেছেন এবং প্রান্তের কবি হিসেবেই স্মরণীয় হয়েছেন।

ওমর আলী তার জীবদ্দশায় বাংলা একাডেমি পুরস্কার পেয়েছিলেন ১৯৮১ সালে এবং মৃত্যুর পর মরণোত্তর একুশে পদকে ভূষিত হন। তার কবিতা শুধু বাংলা সাহিত্যের জন্যই নয়, আমাদের মননের গভীরে প্রকৃতির মমতা ও মানবিকতার এক অনন্য ভাষ্য। শতাব্দীতে এমন কবি বিরল, যিনি প্রান্তে থেকেও মানুষের মনে আলো জ্বালাতে সক্ষম হয়েছেন।