কবি রায়হান উল্লাহর কাছে কবিতা প্রাণের চেয়ে বেশি কিছু। বলা চলে জীবনের ডায়েরি কিংবা দিনলিপি। ‘মায়াপথিক’ তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ। এতে তিনি বস্তুগত-অবস্তুগত বিষয়, সমসাময়িক বিবিধ নিয়মবহির্ভূত ক্রিয়াকলাপ, ইতিহাস-ঐতিহ্যের চালচিত্রসহ বিভিন্ন খুঁটিনাটি বিষয় সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিশ্লেষণের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন। যা তার দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতার ফসল। সর্বোপরি প্রাধান্য পেয়েছে পথিকের প্রস্থানের এবং মৃত্যুপথযাত্রার অমোচনীয় কালো দাগের কথা। মৃত্যুই যে আসল ঠিকানা, সেটি বারবার স্মরণ করিয়েছেন কবি। ‘মায়াপথিক’ ক্ষণস্থায়ী কিছু নয়, চিরকালীন পথের যাত্রাপথ।
‘মায়াপথিক’ মুক্তগদ্য এবং পদ্যের নব ঢঙের ব্যতিক্রমধর্মী একটি বই। বইয়ের পাতায় পাতায় মেলবন্ধনের অভাব ঘুচিয়েছেন। ছন্দের ঝংকার আছে। রূপক, কল্পনা, বাস্তবতা এবং অলঙ্কাকারের আবেশ সৃষ্টির দক্ষতার পরিচয় রেখেছেন। শব্দচয়নে কবি বেশ পারদর্শিতা তথা পাণ্ডিত্য ফলিয়েছেন। তবে মুক্তগদ্যের আধুনিক কবিতা আর আধুনিক কবিতাগুলোর মধ্যে অভিন্নতা না রেখে বইটি হলে মোটেও অনুচিত হতো না। বইটির আনন্দপাঠে পাঠকমাত্রই মুগ্ধ হয়েছি। নতুন পাঠকের ক্ষেত্রে বইটি অন্যরকম সুধাময়ী হবে। বইয়ের মধ্যে সমাজ-সংসারের সম্মিলিত আলো-অন্ধকারের ভেরিয়েবল রিকগনিশন আছে। আলো ছড়ানোর ব্যবস্থা রয়েছে।
মায়াপথিক নিরীক্ষা ও গবেষণালব্ধ চিন্তার জটিল সমীকরণ! সরলতার পথে বিচরণ। মায়া বাদ দিলে মায়াময় পৃথিবীর আর কী থাকে! পথিকই পৃথিবী, পথিকই মানুষ, পথিকই পথ, পথই পথিক। পথিকই অজানার অনুসন্ধানী এক যাত্রী। ‘মায়াপথিক’ সুন্দর এই পৃথিবীর অনন্যতার চলমান এক নাম। যা কবি রায়হান উল্লাহর আবহমান চিন্তাফসলের নিবিড় পরিচর্যার শ্রেষ্ঠত্বের অমূল্য এক ধন। মায়াপথিক যেন পৃথিবীর নিয়ম-কানুন বাস্তবায়নের কলাকৌশল অবলম্বন করার হাতিয়ার। কবি রায়হান উল্লাহ তা ভালো করেই বুঝেছেন। বোঝানোর চেষ্টাও করেছেন। সেই বুঝটাই সহজ-সরল ভাবে কবিতাগুলোয় ছাপ রেখেছে। কবিতা পড়লেই তা স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান। একটু চিন্তা করলেই বোঝা যায় কবিতার বিষয়বস্তু।
‘মায়াপথিক’ কবি রায়হান উল্লাহর প্রথম কাব্যগ্রন্থ। যাকে তিনি সন্তানজ্ঞান করেছেন। এ গ্রন্থের ৫৬টি কবিতার মধ্যে প্রথম কবিতাটির শিরোনাম বা নামকবিতা ‘মায়াপথিক’। এখানে তিনি বোঝাতে চেয়েছেন পৃথিবীর পথিক সূচনালগ্ন থেকে যে যাত্রা শুরু করেছেন, তা চিরন্তন সত্য; অনন্তকালের পথে এগিয়ে চলেছে। কবি সেই পথেরই পথিক! তিনি তার সৃষ্টিকর্মের মাধ্যমে হাজার বছর বেঁচে থাকার অতৃপ্ত বাসনার কথা বলেছেন। কবিতার শেষাংশে বলেছেন, ‘পথকে নদী ভেবে, নদীকে পথ। জীবনের প্রয়োজনে, সময়ের আয়োজনে, মায়ার সৃজনে। আমি মায়াপথিক।’ কবি এখানে দর্শন, ভাব, কল্পনা, চিন্তা-ভাবনার সুকোমল প্রগতিশীল চলমানতার আর বাস্তবতার একটা মিথস্ক্রিয়ার যৌক্তিক সমন্বয় করেছেন।
করোনাকাব্য-১ এ কবি আক্ষেপ করে বলেছেন মানুষের দৈনন্দিন জীবনের অতিরঞ্জিতের কথা। মূল্যবোধ নীতি-নৈতিকতার অবক্ষয়ের কথা; অধরাকে ধরার কথা। যার ফলশ্রুতিতেই কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের মতো হৃতসর্বস্ব সময়ের স্রোতে ভেসেই চলেছে। তিনি অপরিসীম চাহিদার ভয়ংকর পরিণতির ছাপ ফেলেছেন কবিতায়। এখানে বাস্তববাদী হয়েছেন কবি। ভাববাদীও বলা চলে।
রায়হান উল্লাহ তার ‘কিছুই পারিনি আমি’ কবিতায় চিরন্তন সত্য নিরূপণ করেছেন। অলৌকিকতা, অবাস্তবতা, অলীকতা বর্জন করেছেন। এমনকি অকার্যকর আবেগকে নর্দমায় নিক্ষেপ করেছেন। কবি প্রগতিশীল চিন্তার অধিকারী। তিনি তা অস্বীকার করেননি।মায়াপথিকের কবি বোধের রাজ্যে বিচরণ করে যেন শব্দবোমা ফাঁটিয়েছেন। কবি বলেছেন, ‘তবুও কেন জ্যোৎস্নার বিভ্রম!’ চারদিকে এত আলো, এত সৌন্দর্য; তবু কেন সম্পূর্ণভাবে কদর্যতা বিশ্রীরকম অন্ধকারের চলমান পথ! কবিতায় কবি মানুষ নিজেকে আজও সঠিকভাবে চিনতে পারার অক্ষমতার কথা বলেছেন।
পথই জীবনের শিক্ষক। তাই তো কবি করোনাকাব্য-২ এ চমৎকারভাবে বিষয়টি উপস্থাপন করেছেন। কবি বলেছেন, ‘পথই দেখায় ভালোবাসার সরণি,/ পথই শেখায় আলো আশার ধরণি।’ ‘বিহ্বল কথোপকথন’ কাব্যে প্রেমিক-প্রেমিকা, সংসার, স্বজনকে মিলিয়েছেন বেলা-অবেলায়। ‘দ্রষ্টব্য রোমন্থন’ কবিতায় অন্যরকম ইতিহাস, ঐতিহ্য, সমাজবাস্তবতার ঘূর্ণিচক্র সম্বলিত কবিকে দেখি। করোনাকাব্য-৭ এ তিনি উপস্থাপন করেছেন, ‘ভালোবাসা ভেসে যায়, সহাস্য মন,/ দূরীভূত মায়া গীত গায়, মনসা/ চরাচর ধূলিময়, কী আয়োজন/ তারপর তুমুল ভয়, বিবমিষা!’
তিনি জীবনের অস্থায়িত্ব ও ভালোবাসা-মায়ার ভাঙন শেষে যে শূন্যতা ও বিরক্তি এসে ভর করে। সেই সত্যই কাব্যিকভঙ্গির বহিঃপ্রকাশ করেছেন। কবি রায়হান উল্লাহর ‘রক্তকাব্য’ নিঃসন্দেহে বিপ্লবী চেতনার কবিতা। তিনি সমাজ সচেতনতার কবি। স্বীকার না করার উপায় নেই, তার কবিতা আগামীর আলোর মুখ দেখিয়েছেন। রক্তকাব্যটিতে কবির চোখে রক্ত ঝরলেও তিনি থেমে যাননি। বরং হাসিমুখে কাব্য রচনা করেছেন।
তিনি তার কবিতার পঙক্তিতে পরাধীনতার কোনো ছাপ ফেলতে চাননি। ধ্বনি, তাল, শব্দের গতি ও ভাবের তালের একটা নিজস্বতা পরিলক্ষিত হয়েছে। কবি তার ‘বাংলাদেশের সময়’ কবিতায় প্রতীক ও চিত্রকল্পের বিচার-বিশ্লেষণ করেছেন। গ্রাম, মায়া, কাঁটাতার, কাশ্মীরের শিশু, লাল-সবুজ ইত্যাদি অনুষঙ্গ দৃশ্যমান করেছেন। এটিকে অমিত্রাক্ষর ছন্দের আধুনিক কবিতা বলা যায়।
‘জীবনের মানে’ কবিতাটিতে মানুষের জীবনযাত্রার অনিশ্চয়তা ও ব্যর্থতার বয়ান দিয়েছেন। প্রকৃতি এবং প্রকৃত লেখাটির সারমর্ম দাঁড়ায়, ভুলই জীবন। ভুলই সংসার। নিশ্চয়তা ও সফলতা বলে কিছু আছে বলে মনেই হয় না। ভুল পথের পৃথিবীর স্বচ্ছ আয়নার নামই মায়াপথিক। ‘মাটিকাব্য’ কবিতাটি অসামান্য চেতনার বহিঃপ্রকাশ। যেখানে মানুষের শিকড় মাটির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত থাকার বিষয়টি পরিষ্কারভাবে উপস্থাপন করেছেন।
এ ছাড়া সময়ের হুল, জীবন পাঠ, লাল রঙের কথা, বৃষ্টি কাব্য, মানুষ কী আর ধরবে, আমিই অমানুষ, পথিক বঙ্গবন্ধু, কৈফিয়ত, শিরোনামহীন, ওলট-পালট, মায়াজাল, আক্ষেপ, কথাচুর, ধোঁয়ার বৃত্ত এবং দৃষ্টির সীমানা কবিতাগুলো সামাজিক-মানবিক অসংগতির বিরুদ্ধেই যেন কঠোর আঘাত করেছে। কবিতাগুলো পড়লেই পাঠক সহজে উপলব্ধি করতে পারবেন।
কবি রায়হান উল্লাহ কাব্যগ্রন্থের মুখবন্ধে স্বীকার করেছেন, এ কাব্যের কোনো কবিতা প্রচলিত নিয়ম না মেনে, ধরাবাঁধা ছক না মেনে, নিয়মকানুন বা কাঠামো না মেনেই লেখা হয়েছে। বলা যায়, অনিয়মের মধ্যেও একটা নিয়ম আছে। সেটারই রূপায়ণ করার প্রচেষ্টা করেছেন। যা তাকে অনন্য উচ্চতায় পৌঁছাবে। রৌদ্রছায়া প্রকাশ থেকে ২০২৩ সালে বইটি প্রকাশিত হয়েছিল। প্রচ্ছদ এঁকেছেন মাহতাব শফি। ৬৪ পৃষ্ঠার বইটির দাম ২০০ টাকা। বইটি পাঠ করে ভালো লাগবে। সংগ্রহে রাখার মতো একটি বই।
লেখক: কবি ও শিক্ষক।