সম্প্রতি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) ভেটেরিনারি অনুষদে নির্বাচন ছাড়াই ‘বাংলাদেশ ভেটেরিনারি ছাত্র সমিতি’র নতুন কমিটি গঠিত হওয়ায় চরম ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা।
কোনো ধরনের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া বা মতামত গ্রহণ ছাড়াই একতরফাভাবে সদস্য মনোনয়নের ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শুরু হয়েছে সমালোচনার ঝড়। এ নিয়ে প্রতিবাদের মুখে ছাত্র সমিতির অফিসিয়াল ফেসবুক পেজের মন্তব্য (কমেন্ট) সেকশন পর্যন্ত বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
এ ছাড়াও শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করেছেন, গত কমিটির বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ উঠলেও সেটি নিয়ে কোনো তদন্ত বা পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, ২৪ সদস্য বিশিষ্ট ওই কমিটির সভাপতি হিসেবে মনোনীত হয়েছেন ভেটেরিনারি অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. মো. বাহানুর রহমান। কোষাধ্যক্ষ হিসেবে মনোনীত হয়েছেন মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক ড. এম. আরিফুল ইসলাম। সহ-সভাপতি (ভিপি) হিসেবে মনোনীত হয়েছেন ৫ম বর্ষের শিক্ষার্থী মোরসালিন এবং সাধারণ সম্পাদক হয়েছেন একই বর্ষের শিক্ষার্থী জুলফিকার হাসান অন্তর।
জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, প্রত্যেক বর্ষ থেকে একাডেমিক ফলাফলের ভিত্তিতে চারজন করে শ্রেণি প্রতিনিধি (সিআর) নির্বাচন করা হয়। পরে এসব শ্রেণি প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে ছাত্র সমিতির কমিটি গঠন করা হয়।
এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ভেটেরিনারি অনুষদের চতুর্থ বর্ষের একজন শিক্ষার্থী বলেন, ‘স্বৈরাচার আমলে আমরা আমাদের প্রতিনিধি নির্বাচিত করতে ব্যর্থ হয়েছি। একপ্রকার সিলেকশনের মাধ্যমেই ছাত্র প্রতিনিধি নির্বাচিত হতো। সমিতিতে যারা থাকবে, তারা যদি আমাদের ভোটে নির্বাচিত হয়, তাহলে তারা আমাদের কাছে দায়বদ্ধ থাকবে। তারা আমাদের অধিকার নিয়ে কথা বলবে।
কিন্তু তথাকথিত এই ভাগ-বাটোয়ারার সমিতি কতটা ছাত্রদের কথা ভাববে, তা নিয়ে আমরা সন্দিহান। আমরা ‘লীগের আমলের সেই সিলেকশন প্রক্রিয়া’ থেকে বেরিয়ে নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখতে শিখেছি। আমাদের নিজের অবস্থান, যেখানে আমরা বেড়ে উঠছি, সেই ফ্যাকাল্টিতেই যদি অধিকার নিয়ে কথা বলতে না পারি, তাহলে নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন আমরা কীভাবে দেখব? আমরা আমাদের গণতান্ত্রিক অধিকার ফেরত চাই।’
আরেকজন শিক্ষার্থী বলেন, ‘ভেটেরিনারি ছাত্র সমিতি যেহেতু একটি ছাত্র সমিতি, তাই সেটি হওয়া উচিত শিক্ষার্থীদের প্রত্যক্ষ ভোটে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, এখানে ছাত্রদের প্রতিনিধি নির্বাচন করে দেন শিক্ষকেরা। এতে প্রতীয়মান হয় যে, ছাত্ররা শিক্ষকদের কাছে জিম্মি। ২৪-এর গণঅভ্যুত্থানের পরেও এখানকার ছাত্ররা এখনো তাদের স্বাধীনতা ফিরে পায়নি।’
তৃতীয় বর্ষের এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘ছাত্রলীগের আমলে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ভোটাধিকার হরণ করে ছাত্র সমিতি গঠন করা হতো। ‘জুলাই বিপ্লব’-এর পরও সেই ১৭ বছরের ফ্যাসিবাদী স্টাইলেই তথাকথিত ছাত্র সমিতি (যা আসলে শিক্ষক সমিতি বলা যায়) গঠন করা হয়েছে, যেখানে সাধারণ শিক্ষার্থীদের কোনো মতামত নেওয়া হয়নি। আমরা সাধারণ শিক্ষার্থীরা এই অনির্বাচিত ছাত্র সমিতিকে দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করছি। অতিদ্রুত সাধারণ শিক্ষার্থীদের প্রত্যক্ষ ভোটে ছাত্র সমিতি গঠনের দাবি জানাচ্ছি।’
বাকৃবি শাখা ছাত্রদলের সদস্যসচিব মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে ক্যাম্পাসে ‘নো পলিটিক্স’-এর সুযোগ নিয়ে আমাদের শ্রদ্ধেয় কিছু শিক্ষক, যারা ফ্যাসিবাদ আমলে বিরোধী দলের নেতিবাচক সমালোচনা করতেন এবং দলীয় কর্মসূচিতে যাদের কম সময়ই দেখা যেত, তারাই এখন গণতন্ত্রহীন বাংলাদেশ পুনঃপ্রতিষ্ঠার ব্যর্থ প্রচেষ্টায় নিয়োজিত। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলো নির্বাচন ছাড়াই ভেটেরিনারি ছাত্র সমিতি গঠন। এই ইস্যুতে ছাত্রদল সাধারণ শিক্ষার্থীদের পক্ষেই রয়েছে।’
বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির বাকৃবি শাখার সভাপতি ফখরুল ইসলাম বলেন, ‘এটি একটি দুঃখজনক ঘটনা। ছাত্ররা তাদের প্রতিনিধি বেছে নেওয়ার অধিকার রাখে। দ্রুততম সময়ে বর্তমান কমিটি বাতিল করে নির্বাচন আয়োজন এবং বিগত কমিটির দুর্নীতির বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত।’
এ বিষয়ে ভেটেরিনারি অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. মো. বাহানুর রহমান বলেন, ‘৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য যখন ছিলেন, তখন ছাত্ররাই দাবি করেছিল যে মেধার ভিত্তিতে সব কিছু পরিচালনা করতে হবে। ওই সময়ের মিটিংয়ে আমি ছিলাম না। পরে আরেকটি মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হয়, ছাত্র প্রতিনিধিরা মেধার ভিত্তিতেই নির্বাচিত হবে।
তখন কোটা বনাম মেধা আন্দোলন চলছিল। সেই আন্দোলনের প্রেক্ষিতে এবং শিক্ষার্থীদের দাবির ভিত্তিতে সিন্ডিকেট সভায় সিদ্ধান্ত হয়—সকল অনুষদে শ্রেণি প্রতিনিধি নির্বাচন হবে মেধার ভিত্তিতে। অর্থাৎ, প্রত্যেক বর্ষ ও সেকশন থেকে একজন ছেলে ও একজন মেয়ে শ্রেণি প্রতিনিধি হবে এবং তাদের মধ্য থেকেই ছাত্র সমিতি গঠন করতে হবে।’
শিক্ষার্থীদের মতামত না নেওয়ার বিষয়ে ডিন বলেন, ‘তখন তো আসলে ছাত্ররাই মেধাভিত্তিক চাচ্ছিল। ছাত্ররা যে কখন কী বলছে, আমি এটা বুঝতে পারছি না। সিন্ডিকেট মিটিং অনুযায়ী মেধার ভিত্তিতে প্রতিনিধি নির্বাচন করতে হবে, এটার লিখিত কপি আমার কাছে আছে।’
‘আমাদের একটা কমিটি ছিল, ওই কমিটি ২০ জন শ্রেণি প্রতিনিধির মধ্য থেকে যারা সবচেয়ে সিনিয়র, তাদের মধ্য থেকে ভিপি, জিএস বাছাই করে, যাতে সবাই তাদের মান্য করে’, বলেন তিনি।
ফেসবুকের কমেন্ট সেকশন বন্ধের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমি কোনো পোস্ট করিনি। সম্ভবত সিআরদের মধ্য থেকে কেউ করতে পারে। আমি ঠিক জানি না।’
আগের কমিটির অর্থ আত্মসাতের বিষয়ে ডিন বলেন, ‘আগের কমিটির ভিপি-জিএসকে তো এখন আমরা পাচ্ছি না। তবে আমাদের যে শিক্ষক কোষাধ্যক্ষ ছিলেন, তার কাছে পুঙ্খানুপুঙ্খ বিল-ভাউচারের হিসাব নিয়েছি। আমরা যেটুকু দেখেছি, ছাত্রদের ব্যাপকভাবে খরচের সুযোগ নেই।’
আপনার মতামত লিখুন :