জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) বহু প্রতীক্ষিত জাকসু (জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ) নির্বাচন নিয়ে ফল ঘোষণায় বিলম্ব এবং নানা অনিয়মের অভিযোগ ঘিরে চরম অনিশ্চয়তা ও উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছে ক্যাম্পাসজুড়ে। ভোটগ্রহণের এক দিন পরও নির্বাচন কমিশন কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে চূড়ান্ত ফল ঘোষণা না হওয়ায় সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে হতাশা ও ক্ষোভ ক্রমেই বাড়ছে।
বৃহস্পতিবার (১১ সেপ্টেম্বর) দিনব্যাপী ভোটগ্রহণের পর শুক্রবার (১২ সেপ্টেম্বর) গভীর রাত পর্যন্ত কেন্দ্রীয় সংসদের ভোট গণনা চললেও ফল কবে ঘোষণা করা হবে- সে বিষয়ে স্পষ্ট কিছু জানাতে পারেনি নির্বাচন কমিশন। এর মধ্যে গতকাল শুক্রবার দুপুরে নির্বাচন কমিশন অফিসে দায়িত্ব পালনরত পোলিং কর্মকর্তা, প্রীতিলতা হলের শিক্ষিকা জান্নাতুল ফেরদৌস হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করলে পরিবেশ আরও বিষণ্ন হয়ে পড়ে।
বর্জন ও অভিযোগ
নির্বাচনে অংশ নেওয়া পাঁচটি প্যানেল- ছাত্রদল, ছাত্রশিবির, বাগছাস, শিক্ষার্থী ঐক্য ফোরাম এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ভোট গ্রহণের দিনই প্রশাসনের ‘পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ’ ও ‘অনিয়মের’ অভিযোগ তুলে নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেন। এদের অভিযোগ, প্রশাসন একটি নির্দিষ্ট প্যানেলকে বিজয়ী করার চেষ্টা করছে এবং ফল প্রকাশে বিলম্ব করে প্রক্রিয়াটি প্রশ্নবিদ্ধ করছে।
পদত্যাগ ও বিস্ফোরক মন্তব্য
বিএনপিপন্থি শিক্ষক ফোরামের সভাপতি ও নির্বাচন কমিশনার মাফরুহী সাত্তার গতকাল শুক্রবার রাত ৯টায় পদত্যাগ করে সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড ছিল না। কমিশন আমার মতামত আমলে নেয়নি এবং অনেক গুরুতর অনিয়ম ঘটেছে, যা পুরো প্রক্রিয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।’
শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের তীব্র ক্ষোভ
ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক এবং রিটার্নিং কর্মকর্তা সুলতানা আক্তার ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘ভোট গণনার ধীরগতির কারণে আমার সহকর্মীর মৃত্যু হয়েছে। নির্বাচন কমিশনের অব্যবস্থাপনাই দায়ি। আমি এর বিচার দাবি করছি।’
শেখ রাসেল হলের শিক্ষার্থী মো. রবিন বলেন, ‘প্রশাসনের কিছু অদক্ষতা ছিল, তবে জালিয়াতির প্রমাণ আমরা দেখিনি। ছাত্রদল বুঝতে পেরেছিল তাদের ফল খারাপ আসবে, তাই তারা বর্জন করেছে।
শিবির ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের অভিযোগ
শিবির সমর্থিত প্যানেলের জিএস প্রার্থী মাজহারুল ইসলাম অভিযোগ করেন, বিএনপিপন্থি শিক্ষকদের একটি অংশ পরিকল্পিতভাবে ফল প্রকাশে বিলম্ব ঘটাচ্ছে এবং নির্বাচন বানচালের পাঁয়তারা করছে। তার ভাষায়, ‘ওএমআর বাতিল করে হাতে ভোট গণনায় নেওয়ার সিদ্ধান্তও ছিল পক্ষপাতদুষ্ট।’
বিতর্কিত ওএমআর বাতিল
জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের অভিযোগ ছিল, ওএমআর মেশিন ও ব্যালট জামায়াতপন্থি একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তৈরি করা হয়েছে। এ অভিযোগের পর নির্বাচন কমিশন ওএমআর মেশিন বাদ দিয়ে ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে ভোট গণনার সিদ্ধান্ত নেয়, যা ভোট গণনায় সময় বাড়িয়ে দেয় কয়েক গুণ।
৫টি হলের অনানুষ্ঠানিক ফল
সর্বশেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত ২১ হলের ভোট গণনা সম্পন্ন হয়েছে। এর মধ্যে পাঁচ হলের ভিপি ও জিএস পদে নির্বাচিতদের তথ্য পাওয়া গেছে। অনানুষ্ঠানিকভাবে এগুলো প্রকাশ করা হয়নি। মীর মশাররফ হোসেন হলের ভাইস প্রেসিডেন্ট (ভিপি) পদে জয়ী হয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী জুবায়ের শাবাব। তিনি ১৫১ ভোট পেয়েছেন। জিএস পদে জয় পেয়েছেন শাহরিয়া নাজিম রিয়াদ। তাঁর প্রাপ্ত ভোট ১৯২। এজিএস পদে জয় পেয়েছেন আরাফাত। তিনি পেয়েছেন ১৭৯ ভোট। শহীদ সালাম-বরকত হলে ভিপি পদে নির্বাচিত হয়েছেন মারুফ, জিএস পদে মো. মাসুদ রানা। ১০ নম্বর ছাত্র হলে (সাবেক মুজিব হল) ভিপি পদে আসিফ মিয়া, জিএস পদে মেহেদি হাসান, এজিএস পদে নাদিম মাহমুদ নির্বাচিত হয়েছেন। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম হলে ভিপি পদে মো. রাকিবুল ইসলাম, জিএস পদে আলী আহমদ এবং এজিএস পদে লাবিব নির্বাচিত হয়েছেন। আ ফ ম কামালউদ্দিন হল সংসদে ভিপি পদে জয় পেয়েছেন দর্শন বিভাগে জিএম রায়হান কবীর ও জিএস পদে আবরার শাহরিয়ার। আল বেরুনী হলে ভিপি পদে নির্বাচিত হয়েছেন মুনতাসির খান অর্পণ।
অনিশ্চয়তা ও শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা
প্রতিবারের মতো এবারও নির্বাচনকে ঘিরে প্রশাসনের অব্যবস্থাপনা, পক্ষপাতের অভিযোগ ও শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের দ্বন্দ্ব পুরো প্রক্রিয়াকে বিতর্কিত করে তুলেছে। শিক্ষার্থীরা চাইছে একটি স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ ও দায়িত্বশীল প্রশাসনিক আচরণ- যাতে আগামীতে এমন পরিস্থিতির পুনরাবৃত্তি না ঘটে।