পৃথিবীতে এমন কিছু কবিতা থাকে, যার পঙ্কতিগুলো পড়লে মনে হয়, কবি যেন জানতেন তার চলে যাবার সময় এসে গেছে। ইরানের তরুণ কবি পারনিয়া আব্বাসি যেন তেমনই একজন। মাত্র ২৩ বছর বয়সে তার জীবন থেমে গেছে এক ইসরায়েলি বিমান হামলায়, কিন্তু রয়ে গেছে তার কবিতা, যা এখন প্রতিধ্বনিত হচ্ছে অন্তর্জালে আর ইরানের দেয়ালে দেয়ালে।
‘আমি পুড়ি,
আমি মুছে যাই,
নিভে যাওয়া তারার মত
তোমার আকাশে…’
এই কবিতাটি ছিল তার ডায়েরির এক কোণে লেখা। বন্ধুরা বলেন, সেটিই ছিল তার শেষ লেখা। তিনি কি ভেবেছিলেন, কয়েক দিন পরই নিজেই পরিণত হবেন সেই ‘নিভে যাওয়া তারা’য়?
অনেকটা যেমন রবীন্দ্রনাথের কবিতা ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’র এই অংশটি পারনিয়ার পঙ্ক্তির মতোই উদাত্ত কণ্ঠে মৃত্যুকে আহব্বান জানায়:
‘আজি এ দীনের চরণ-তলে
ধুলার মাঝে লুটাই চুপে চুপে,
আশার রাঙা পলাশগুলি
পাতিয়া গেল বুকের উপর থুপে থুপে।’
পারনিয়া আব্বাসি শুধু কবি নন। তিনি ছিলেন একজন ইংরেজি শিক্ষক ও ব্যাংক মেল্লি'র একজন কর্মকর্তা। কাজভিন আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি অনুবাদে স্নাতক সম্পন্ন করে সদ্য স্নাতকোত্তরে সুযোগ পাওয়া এক প্রতিশ্রুতিশীল তরুণী। তেহরানের সত্তারখান এলাকায় একটি আবাসিক ভবনে পরিবারের সঙ্গে থাকতেন তিনি।
সেই ভবনেই ১২ জুন রাতে ইসরায়েলি মিসাইল এসে আঘাত হানে। ধ্বংসস্তূপ থেকে পারনিয়ার দেহটাই প্রথম বেরিয়ে আসে। এরপর তার ছোট ভাই পারহাম, যিনি একজন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র, আর তারপর তার বাবা-মা। শব হয়ে বেরিয়ে আসে একে একে পুরো পরিবার।
একই ভবনে বসবাসকারী পরমাণুবিজ্ঞানী ও অধ্যাপক ড. আবদুলহামিদ মিনুশেহর এই হামলার লক্ষ্য ছিলেন বলে ধারণা করা হয়। ফলে পারনিয়ার পরিবার সম্ভবত অনিচ্ছাকৃত হামলার শিকার হয়েছেন।
‘তুমি আর আমি একদিন শেষ হয়ে যাব
কোনো এক জায়গায়
সেই সময়
সবচেয়ে সুন্দর কবিতাটিও থেমে যাবে।’
এই পঙ্কতিগুলোর লেখিকা পারনিয়া ছিলেন ইরানের তরুণ প্রজন্মের কবিদের মধ্যে একটি উদীয়মান নাম। তার কবিতা ছাপা হয়েছিল ‘ভজন-এ-দুনিয়া’ নামের একটি সাহিত্যপত্রিকায়।
তার বন্ধুদের স্মৃতিচারণায় উঠে আসে, তিনি কেবল কবিতা লিখতেন না-জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে শব্দে প্রকাশ করার চেষ্টা করতেন।
তার এক বন্ধু আরভিন আবেদি বলেন, ‘যুদ্ধে কেবল সৈনিক নয়, কবিরাও মরে। মানুষ তা মানতে চায় না। কিন্তু পারনিয়ার মৃত্যু প্রমাণ করে-যুদ্ধ সবার জীবনেই আগুন নামিয়ে আনে।’
পারনিয়া চেয়েছিলেন একদিন কোল্ডপ্লে’র কনসার্ট দেখতে। চেয়েছিলেন ইতালিয়ান শিখতে। বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে পাহাড়ে গিয়ে ক্যাম্পিং করতে ভালোবাসতেন। আরও ভালবাসতেন সূর্যমুখী ফুল।
প্রাণচঞ্চল এই তরুণীর স্বপ্ন ছিল অজস্র। আর এখন-সবই ছাই। তার প্রিয় গোলাপি বিছানায় পড়ে আছে একরাশ রক্ত আর চুলের গোছা।
তার শেষ লেখার পংক্তিগুলো পড়ে এখন কেবলই মনে হয়- পারনিয়া যেন নিজের জন্যই লিখেছিলেন। এই যুদ্ধ শুধু একটি ভবন গুঁড়িয়ে দেয়নি, চিরতরে চুপ করিয়ে দিয়েছে এক সম্ভাবনাময় কণ্ঠ।
ইরানি জনগণ, বন্ধু ও সাহিত্যপ্রেমীরা এখন তার সেই পঙ্কতিগুলো আঁকড়ে ধরেছেন। সেই পঙ্কতিগুলোতে, যেখানে জীবন মিশে আছে মৃত্যুর কাব্যে। পারনিয়া বেঁচে নেই, কিন্তু তার সৃষ্ট চরণগুলো তার প্রতিভার সাক্ষী হয়ে থেকে যাক ইরানিদের হৃদয়ে।
তথ্যসূত্র: ওয়াশিংটন পোস্ট, হাম-মিহান, মাকতুব, ভজন-এ-দুনিয়া