জুলাই-আগস্টে মানবতাবিরোধী গণহত্যার মামলায় ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ফাঁসির দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। পাঁচটি অভিযোগের ভিত্তিতে মোট তিনটি ধারায় তার দোষ প্রমাণিত হয়। এছাড়াও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকে মৃত্যুদণ্ড ও সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনকেও পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
বর্তমানে হাসিনা ও আসাদুজ্জামান পালিয়ে ভারতে রয়েছেন। মৃত্যুদণ্ডের পাশাপাশি তাদের দু’জনের সম্পত্তিও বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে।
গতকাল সোমবার দুপুরে আদালতকক্ষে প্রায় আড়াই ঘণ্টা ধরে ৪৫৩ পৃষ্ঠার রায় পড়ে শোনান বিচারপতিরা। জুলাই গণহত্যার দায়ে তার মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করা হয়।
এদিন আদালতে মামলার মোট পাঁচটি অভিযোগ তোলা হয় হাসিনাদের বিরুদ্ধে। এর আগে গত বছরের ১৭ অক্টোবর থেকে আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে এই সংক্রান্ত মামলা চলছে।
হাসিনার বিরুদ্ধে তোলা অভিযোগগুলো হল-
২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনের সময় ছাত্র-জনতার ওপর পুলিশকে গুলি চালানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন তিনি। হেলিকপ্টার, ড্রোন এবং প্রাণঘাতী অস্ত্র প্রয়োগ করে আন্দোলনকারীদের নির্মূল করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। এ গণহত্যায় তার নির্দেশে প্রায় দেড় হাজার মানুষকে হত্যার অভিযোগ রয়েছে।
অভিযোগে বলা হয়— উসকানিমূলক ভাষণ দেওয়া এবং বিভিন্ন সময়ে তার নানা মন্তব্য বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি খারাপ করে তুলেছে- এ কারণে ক্ষোভ বেড়ে দেশের সাধারণ মানুষের ভোগান্তি সৃষ্টি হয়েছে।
রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদকে গুলি করে হত্যার পর এ আন্দোলন পুরো দেশে ছড়িয়ে পড়ে। আন্তর্জাতিক স্তরেও বেশ সমালোচনা শুরু হয়। সেই হত্যার ঘটনাতেও হাসিনাকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। অভিযোগে উল্লেখ আছে- তার নির্দেশেই গুলি চালিয়ে আবু সাঈদকে হত্যা করা হয়।
এ ছাড়া ঢাকার চানখাঁরপুল এলাকায় আন্দোলনরত ৬ জনকে গুলি করে হত্যা করে পুলিশ। অভিযোগ বলা হয়, হাসিনার নির্দেশেই এই ৬ জনকে গুলি করে হত্যা করা হয়।
জুলাই-আগস্টের আন্দোলন চলাকালীন আশুলিয়ায় ৬ জনকে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়। অভিযোগ, সেই নির্দেশও দিয়েছিলেন পলাতক শেখ হাসিনা।
যে তিন ধারায় দোষী সাব্যস্ত
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল জানিয়েছে- মোট তিনটি ধারায় হাসিনার অপরাধ প্রমাণিত হয়েছে। প্রথমত, তিনি উস্কানিমূলক মন্তব্য দিয়েছেন, যা পরিস্থিতিকে অগ্নিগর্ভ করে তোলে।
দ্বিতীয়ত, আন্দোলন দমনের জন্য বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতার বিরুদ্ধে হেলিকপ্টার, ড্রোন এবং মারণাস্ত্র ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছেন।
তৃতীয়ত, দমন-পীড়ন ঠেকানোর ক্ষেত্রে পুলিশকে তিনি নিষ্ক্রিয় থাকার নির্দেশ দিয়েছেন।
উস্কানিমূলক মন্তব্যের অভিযোগে হাসিনাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। বাকি দু’টি ক্ষেত্রে মৃত্যুদণ্ডের নির্দেশ দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।
গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ
ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে হাসিনা ছাত্র-জনতার আন্দোলনে বল প্রয়োগ করে নির্বিচারে মানুষকে হত্যা করেছেন- এমন মন্তব্য আদালতে তুলে ধরা হয়। আন্দোলনকারীদের কথা শোনার পরিবর্তে তিনি দমন-পীড়নের নির্দেশ দিয়েছেন। সংগঠিত এই হামলাগুলোকে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ বলা হয়েছে।
জাতিসংঘের একটি প্রতিবেদন বলছে, গত বছরের ১৫ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত তিন সপ্তাহের বিক্ষোভে ১ হাজার ৪০০ জন নিহত হয়। এবং এসব মৃত্যু হাসিনার ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার প্রয়াসে ঘটেছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়- এই আন্দোলনে বেশিরভাগ মানুষ গুলিতে মারা যান। নিহতদের মধ্যে ১২–১৩ শতাংশ শিশু ছিলেন।
এদিকে ন্যায় অধিকার আদায়ে আন্দোলনকারীদের বারবার ‘রাজাকার’ বলে অপমান করেছেন হাসিনা, যা অসম্মানজনক একটি মন্তব্য বলে আদালতে বলা হয়।
এদিন আদালতকক্ষে হাসিনার ফোনালাপ পড়ে শোনানো হয়েছে। কিছু ভিডিও যাচাই করে দেখানো হয়েছে। এসব ফোনালাপ বা ভিডিও কোনোটিই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার তৈরি নয়। সেগুলোর সত্যতাও প্রমাণিত হয়েছে।
এর পর কী
হাসিনা বর্তমানে পালিয়ে ভারতে অবস্থান করছেন। তার মৃত্যুদণ্ডের রায়ের পর এরই মধ্যে ভারত সরকারের কাছে হাসিনাকে প্রত্যর্পণের জন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বার্তা পাঠানো হয়েছে।
রাষ্ট্রপক্ষ নিয়োজিত হাসিনার আইনজীবী জানিয়েছেন, এই রায়ের বিরুদ্ধে হাসিনা আপিল করতে পারবেন না, কারণ তিনি পলাতক। আপিল করতে হলে রায়ের ৩০ দিনের মধ্যে তাকে আত্মসমর্পণ করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, আপিল করতে চাইলে এই সময়ের মধ্যে হাসিনাকে পুলিশের হাতে ধরা বা যদি পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করতে পারে তবে তিনি রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের সুযোগ পাবেন।
উল্লেখ্য, অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল জানিয়েছেন, হাসিনাকে বাংলাদেশে প্রত্যর্পণের জন্য ভারত সরকারকে ফের চিঠি দেবে ঢাকা।

