ঢাকা রবিবার, ০৬ জুলাই, ২০২৫

আকাশপাতাল খরচ!

রূপালী ডেস্ক
প্রকাশিত: জুলাই ৬, ২০২৫, ০২:৩৯ এএম

উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে আকাশ-পাতাল খরচ করেছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। গত ২০২৪-২৫ অর্থবছরে মন্ত্রণালয়ের সাতটি প্রকল্পে ১৪৩ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। পাকিস্তান, জার্মানি, অস্ট্রেলিয়া, ভুটান, ব্রুনেই ও সৌদি আরবে সাতটি চ্যান্সারি কমপ্লেক্স তৈরির জন্য আলাদাভাবে এসব প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। কিন্তু বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আওতায় জুলাই-জানুয়ারি হিসাব অনুযায়ী সাত মাসে খরচ হয় মাত্র ৪৭ লাখ টাকা। ওই সময় প্রকল্প বাস্তবায়নের হার ছিল মাত্র দশমিক ৩৩ শতাংশ। কিন্তু গত অর্থবছরের ১১ মাসের চিত্র বলছে, দেদারসে খরচ করেছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। গত অর্থবছরের জুলাই-মে সময়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে খরচ হয়েছে ৭৩ কোটি টাকা। 
অর্থাৎ শেষ চার মাসে খরচ বেড়েছে ১৮ কোটি ৫৩ লাখ টাকা। 
পরিকল্পনা কমিশন সূত্র জানিয়েছে, ২০০৭ সালে ২৯ কোটি ৮০ লাখ টাকা মূল অনুমোদিত ব্যয় ধরে ২০১০ সালের জুন মাসের মধ্যে শতভাগ বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে ‘পাকিস্তানের ইসলামাবাদে বাংলাদেশ চ্যান্সারি কমপ্লেক্স নির্মাণ প্রকল্পটি’ গ্রহণ করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। প্রকল্পের আওতায় ৮ হাজার ৮২৩ দশমিক ২১ বর্গফুট চ্যান্সারি কমপ্লেক্স নির্মাণ করা হবে।
চ্যান্সারি কমপ্লেক্সে ব্যবহারের জন্য প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র, বাসনপত্র ইত্যাদিসহ অফিস এবং বাসস্থানের জন্য বৈদ্যুতিক এবং ইলেকট্রনিক সরঞ্জাম কেনা হবে। একই সঙ্গে চ্যান্সারি কমপ্লেক্সের নিমাণের জন্য ডিজাইন ফি (পরামর্শ) প্রকল্পের অনুকূলে বরাদ্দকৃত অর্থ থেকে পরিশোধ করা হবে। বাংলাদেশ সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদে (ব্লক-৯ ও ১৫, সেক্টর জি-৫, ডিপ্লোমেটিক এনক্লেভ, ইসলামাবাদ, পাকিস্তান) এই চ্যান্সারি কমপ্লেক্সটি বার বার প্রকল্পটিতে সংশোধনী প্রস্তাব আনে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। ২০১১ সালে প্রকল্পটির মেয়াদ এক বছর ও ব্যয় বাড়িয়ে প্রথম সংশোধনী আনে মন্ত্রণালয়। এরপর ব্যয় ধরা হয় ৫১ কোটি ৭৯ লাখ টাকা। প্রকল্পটির দ্বিতীয় সংশোধনী আনা হয় ২০১৩ সালে। ব্যয় ধরা হয় ৬৪ কোটি ৫২ লাখ টাকা। প্রকল্পের তৃতীয় সংশোধনী আনা হয় ২০২০ সালে। ব্যয় বাড়িয়ে ধরা হয় ৭৯ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। প্রকল্পটির চতুর্থ সংশোধনী আনা হয় ২০২৩ সালে। সময়সীমা নির্ধারণ করা হয় গত জুন মাস। ব্যয় বাড়িয়ে ধরা হয় ৯৭ কোটি ৪২ লাখ টাকা ৫৭ হাজার টাকা। কিন্তু এবার পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দের কারণে প্রকল্পটির কাজ এখনো শেষ করতে পারেনি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এদিকে গত
বছরের ১৮ মে জার্মানির বার্লিনে বাংলাদেশ চ্যান্সারি কমপ্লেক্সের নির্মাণকাজ শুরু হয়। কাজটি পেয়েছে সুইজারল্যান্ডভিত্তিক কোম্পানি মাবকো কনস্ট্রাকশন এসএ। এটি নির্মাণে ব্যয় ধরা হয় ১৪৫ কোটি ৬৯ লাখ ৭৯ হাজার ৯৭ টাকা। আগামী দুই বছরে ভবনটির নির্মাণ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে।
অস্ট্রেলিয়ার ক্যানবেরায় বাংলাদেশ সরকারের নিজস্ব জমিতে একটি আইকনিক চ্যান্সারি ভবন নির্মাণের লক্ষ্যে ২০২১ সালে একটি প্রকল্প হাতে নেয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এটি বাস্তবায়নে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ১৪৬ কোটি ৮৭ লাখ টাকা। গত জুন মাসের মধ্যে প্রকল্পটির কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। 
ভুটানের থিম্পুতে বাংলাদেশ দূতাবাসে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য বাসস্থান ও সুবিধাজনক কাজের পরিবেশ সৃষ্টি করতে চ্যান্সারি কমপ্লেক্স এবং রাষ্ট্রদূতের বাসভবন নির্মাণে ২০১৮ সালে একটি প্রকল্প হাতে নেয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। ৪ হাজার ২১০ বর্গমিটার বাংলাদেশ চ্যান্সারি কমপ্লেক্স, রাষ্ট্রদূতের বাসভবন, অফিসার ও স্টাফ কোয়ার্টার নির্মাণে ব্যয় ধরা হয় ৩৪ কোটি ১ লাখ ৬৫ হাজার টাকা। ২০২৩ সালে প্রকল্পটির মেয়াদ এক বছর ও ব্যয় বাড়িয়ে প্রথম সংশোধনী আনে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। বাস্তবায়নে ব্যয় বাড়িয়ে ধরা হয় ৬৭ কোটি ৭১ লাখ টাকা। সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে চলতি বছরের জুন মাস।
২০১৭ সালে ব্রুনাইয়ের বন্দরসেরি বেগওয়ান বাংলাদেশ চ্যান্সারি কমপ্লেক্স ও হাইকমিশনারের বাসভবন নির্মাণ প্রকল্পটি হাতে নেয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ব্যয় ধরা হয় ৮৯ কোটি টাকা। সময়সীমা নির্ধারণ করা হয় গত জুন মাস। কিন্তু গত মাসের মধ্যে এটি বাস্তবায়ন হয়নি। এ ছাড়া সৌদি আরবের জেদ্দায় বাংলাদেশ চ্যান্সারি কমপ্লেক্স নির্মাণ প্রকল্প ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে হাতে নেয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। প্রকল্পটির ব্যয় ধরা হয় ৪৪ কোটি ৫৯ লাখ টাকা। ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরের মধ্যে প্রকল্পটি বাস্তবায়নে সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু পরের মাস অক্টোবরে প্রকল্পটির সংশোধনী এনে যুক্ত করা হয় রাজধানী রিয়াদে বাংলাদেশ হাউস (রাষ্ট্রদূত ভবন) নির্মাণ প্রকল্পটি। এতে ব্যয় ধরা হয় ২২৬ কোটি ২৯ লাখ টাকা।
সব মিলিয়ে দুই প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যয় ধরা হয়েছে ২৭০ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। দ্বিতীয় সংশোধনীতে সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে চলতি বছরের জুন মাস। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে এই সাত প্রকল্পে মোট ১৪৩ কোটি টাকা বরাদ্দ রয়েছে। কিন্তু অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে, জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত খরচ হয়েছে মাত্র ৪৭ হাজার টাকা। অর্থাৎ গত ছয় মাসে মোট বরাদ্দের মাত্র শূন্য দশমিক ৩৩ শতাংশ খরচ করতে পেরেছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। ক্ষমতার পট পরিবর্তনের পর নানামুখী সংকটে উন্নয়ন প্রকল্পে স্থবিরতা তৈরি হয়েছে বলে মনে করেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, গত বছরের জুলাই-আগস্টের আন্দোলন; ক্ষমতার পট পরিবর্তন এবং ঠিকাদার ও প্রকল্প পরিচালকদের খুঁজে না পাওয়া সব কিছুর প্রভাব পড়েছে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে। গত অর্থবছরের শেষ সময়ে মন্ত্রণালয়ের সাতটি প্রকল্পের কাজ আবার শুরু হয়েছে। পেমেন্ট দেওয়া হচ্ছে, তাই খরচ বেড়েছে। তিনি বলেন, আগের আওয়ামী লীগ সরকার অর্থ লোপাটের জন্য শুধুই সময় ও ব্যয় বাড়িয়েছে। যার খেসারত দিতে হচ্ছে বর্তমান প্রকল্প বাস্তবায়নে।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) সূত্রে জানা গেছে, গত ২০২৪-২৫ অর্থবছরে মন্ত্রণালয়ের সাতটি প্রকল্পে সর্বমোট ১৪৩ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। কিন্তু বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আওতায় জুলাই-জানুয়ারি হিসাব অনুযায়ী সাত মাসে খরচ হয় মাত্র ৪৭ লাখ টাকা। ওই সময় প্রকল্প বাস্তবায়নের হার ছিল মাত্র দশমিক ৩৩ শতাংশ। কিন্তু গত অর্থবছরের ১১ মাসের চিত্র বলছে, দেদারসে খরচ করেছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। গত অর্থবছরের জুলাই-মে সময়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে খরচ হয়েছে ৭৩ কোটি টাকা। অর্থাৎ শেষ চার মাসে খরচ বেড়েছে ১৮ কোটি ৫৩ লাখ টাকা। 
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা মনে করেন, জুলাই-আগস্টের আন্দোলন; ক্ষমতার পট পরিবর্তন এবং ঠিকাদার ও প্রকল্প পরিচালকদের খুঁজে না পাওয়া সব কিছুর প্রভাব পড়েছে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে। ফলে গত দেড় দশকের মধ্যে সবচেয়ে কম এডিপি বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে এগোতে হচ্ছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষক তৌফিকুল ইসলাম খান বলেন, আর্থিক সক্ষমতা বিবেচনা করে প্রকল্প নেওয়া উচিত। ব্যাংক থেকে বিরাট অঙ্কের অর্থ ঋণ করে প্রকল্প বাস্তবায়ন করা উচিত নয়। তিনি আরও বলেন, বর্তমান এডিপিতে বহু প্রকল্প রাজনৈতিক বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। আবার কিছু প্রকল্প শুরুর দিকে আছে, যদিও সেগুলোর তেমন একটা প্রয়োজন নেই। এ ধরনের প্রকল্প এডিপি থেকে বাদ দেওয়া উচিত। বরং বিদেশি সহায়তাপুষ্ট প্রকল্প ও শেষের দিকে থাকা প্রকল্প বাস্তবায়নে বেশি মনোযোগ দেওয়া উচিত।