আজ এলাম শ্রীমঙ্গল থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত প্রায় শতবর্ষের পুরোনো একটি খ্রিষ্টান সমাধিতে। শতাধিক বছর ধরে জেমস ফিনলে চা কোম্পানি এই সিমেট্রি রক্ষণাবেক্ষণ করছে। কোম্পানির একজন কর্মকর্তা আমাকে ঘুরিয়ে দেখালো সমাধিটি। আমি অনেক্ষণ এই স্মৃতিবিজড়িত সমাধি এলাকাজুড়ে ঘুরলাম কোথাও কোলাহল নেই, সুনসান-নিথর নীরবতা।
ইতিহাস ঘেঁটে জানতে পারি ব্রিটিশ সময়ে ১৮৫৪ সালে সিলেটের মালনিছড়ায় চা বাগান প্রতিষ্ঠার পর ১৮৮০ সালে শ্রীমঙ্গলে ব্রিটিশরা বাণিজ্যিকভাবে চা চাষ শুরু করে, তখন থেকে এখানে অনেক ব্রিটিশ অবস্থান করে। সুদূর বৃটেন থেকে এখানে টি প্লান্টার্সদের আগমন ঘটে। তৎকালীন সময়ে যেসব ব্রিটিশ এবং তাদের স্ত্রী-পুত্র, স্বজন মারা যান তাদেরকে এই ডিনস্টন সিমেট্রিতে শায়িত করা হয়। পাহাড়ঘেরা চিরসবুজ চা বাগানের মাঝখানে অবস্থিত এ সিমেট্রিতে ব্রিটিশদের কবর রয়েছে ৪৬টি। জহির জেমস ফিনলে টি কোম্পানি সূত্রে জানতে পারে, জেমস ডিনস্টন চা বাগানের এ সিমেট্রিতে সর্বপ্রথম সমাহিত করা হয় রবার্ট রয়বেইলি নামের এক ব্রিটিশ নাগরিককে।
৩৮ বছর বয়সে ১৮৮৫ সালের ৩০ আগস্ট তিনি ডিনস্টন চা বাগানে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ১৮৯৬ সালের জুন মাসে শিশু উইলিয়াম জন ও ডেভিড সহাবির মৃত্যু হলে তাদের এখানে সমাহিত করা হয়। ১৯১৮ সালের ১৮ মে জর্জ উইলিয়াম পিটারের সহধর্মিণী মেরি এলিজাবেথ পিটার মারা গেলে তাকে এখানে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয়। স্ত্রীর মৃত্যুর এক বছরের মধ্যে ১৯১৯ সালের ২ অক্টোবর জর্জ উইলিয়াম পিটারও পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নেন। ডিনস্টন সিমেট্রির নীরবতায় পাষাণ কবরের একই আচ্ছাদনে একই কবরে স্ত্রীর কবরের পাশে তাকে সমাহিত করা হয়।
১৮৯৬ সালের জুলাই মাসে জাহাজযোগে নিজ দেশে যাওয়ার পথে মারা যান রামসান্টার। ১৯০২ সালের এপ্রিলে পানিতে ডুবে মারা যান এফডব্লিউ এলান। এ দু’জনের মরদেহ পাওয়া যায়নি। স্মৃতি রক্ষার্থে তাদের বন্ধুরা ডিনস্টন সিমেট্রিতে দু’টি প্রতীকী কবর তৈরি করে। আরও কিছু ইতিহাস খোঁজ করে, ১৯১৯ সালের ২০ জানুয়ারি শ্রীমঙ্গলের দারগাঁও চা বাগানে মারা যান অ্যাডওয়ার্ড ওয়ালেস। এদিন ছিল তার ২৫তম জন্মদিন। কলেরায় আক্রান্ত হয়ে ১৯৩৭ সালের শুরুর দিকে হান্ট নামের একজন ব্রিটিশ নাগরিক তিনিও এই সিমেট্রিতে শায়িত আছেন।
১৯৩৯ সালের বিশ্বযুদ্ধের সময় আমেরিকার একটি বিমান মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার শমসেরনগর বিমানবন্দর থেকে উড্ডয়ন কিংবা অবতরণের সময় শ্রীমঙ্গলের উদনাছড়া চা বাগানে বিধ্বস্ত হয়। এ দুর্ঘটনায় নিহত বিমানের দু’জন চালকের মরদেহ ডিনস্টন সিমেট্রিতে সমাহিত করা হয়। পরে আমেরিকার সামরিক বাহিনী দু’বিমান চালকের মৃতদেহ কবর থেকে উঠে নিজ দেশে নিয়ে যায়। এটি একটি শুধু একটা সমাধি না এটি একটি ইতিহাস এখানে আছে ব্রিটিশ সময়ের ২০০ বছরের নানা গল্প এখানের বাবুরা এক সময় এই অঞ্চল শাসন করত। তাদের কেউ নিজ দেশে চলে গেছে কেউ এখানে শায়িত। এখানকার প্রতিটি মানুষ যদি কথা বলত তাহলে আমি এখানে সারা দিন তাদের সময়ের ইতিহাস শুনতাম।
আপনার মতামত লিখুন :