রবিবার, ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


জুবায়ের দুখু

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২১, ২০২৫, ০৬:০৪ পিএম

তরুণরা বইবিমুখ হওয়ায় রাজনীতিতে ‘জ্ঞানহীনতা’ বাড়ছে? 

জুবায়ের দুখু

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২১, ২০২৫, ০৬:০৪ পিএম

বইয়ের তাক। ছবি- সংগৃহীত

বইয়ের তাক। ছবি- সংগৃহীত

একটা সময় ছিল, যখন বইপড়া কেবল জ্ঞান অর্জন নয়, বরং জীবন পাল্টে দেওয়ার এক হাতিয়ার হিসেবেও বিবেচিত হতো। সেই সময়ে বই ছিল সমাজ পরিবর্তনের নীরব কাণ্ডারি, জ্ঞানের সেতুবন্ধন, আত্মউন্নয়নের বাহন। কিন্তু আজ, একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকের শেষে এসে, আমাদের সামনে বড় এক প্রশ্ন, মানুষ কি আর আগের মতো পড়ে না? এবং তার প্রভাব কি রাজনীতির বুদ্ধিবৃত্তিক মানে পড়ছে?

আজকের দিনে বইপাঠের হার নিয়ে যত গবেষণা হচ্ছে, ততই উদ্বেগ বাড়ছে। যুক্তরাষ্ট্রের একটি সাম্প্রতিক সমীক্ষায় দেখা গেছে, গত ২০ বছরে আনন্দের জন্য বই পড়া দুই-পঞ্চমাংশ হ্রাস পেয়েছে। যুক্তরাজ্যেও পরিস্থিতি তথৈবচ—২০২৪ সালে ৪০ শতাংশ ব্রিটিশরা কোনো বইই পড়েননি বা শোনেননি।

তরুণ প্রজন্মের কথা বললে পরিস্থিতি আরও উদ্বেগজনক। এমনকি সাহিত্যের ছাত্রদের মধ্যেও ‘ব্লিক হাউস’-এর মতো ক্লাসিক উপন্যাসের জটিল বাক্য কাঠামো, রূপক কিংবা আইনি পরিভাষা বুঝে ওঠা দুঃসাধ্য হয়ে উঠছে এসব ছাত্রদের কাছে। এক শিক্ষার্থী তো ‘হুইস্কার্স’ শব্দটিকে বিড়ালের সঙ্গে যুক্ত করে ফেলেন! প্রশ্নটা সেখানে নয়, তারা সাহিত্যপ্রীতিহীন। বরং বাস্তবতা আরও গভীর ধারণা করা হচ্ছে, তারা ভাষা ও জটিল চিন্তার অভ্যাস হারিয়ে ফেলেছে।

এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, পড়ার অভ্যাস ও জটিল গদ্যের প্রতি সহিষ্ণুতা হারালে চিন্তাশীল রাজনীতির অবসান ঘটে। যেমন, যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতিদের ভাষণের পাঠযোগ্যতা বিশ্লেষণে দেখা গেছে, জর্জ ওয়াশিংটন: রিডেবিলিটি স্কোর ২৮.৭ (স্নাতকোত্তর স্তর), ডোনাল্ড ট্রাম্প: স্কোর ৯.৪ (মাধ্যমিক স্তর)।

এর মানে এই নয় যে, সরল গদ্য মানেই খারাপ। বরং চ্যালেঞ্জটা হলো, রাজনীতির ভাষা যত বেশি সংক্ষিপ্ত হয়, চিন্তার জটিলতাও ততটাই হ্রাস পায়। অধ্যাপক জোনাথন বেটের ভাষায়, ‘জটিল গদ্য না পড়তে পারলে আপনি জটিল চিন্তাও করতে পারবেন না।’

ভিক্টোরিয়ান যুগে স্কটিশ মেষপালকেরা দেওয়ালের ফাটলে বই রেখে দিতেন, যেন অন্য রাখালরা সেগুলো পড়ে আত্মউন্নয়নের পথ খুঁজে পায়। বইপড়ার মধ্য দিয়ে আত্মোন্নতির যে সংস্কৃতি তারা গড়ে তুলেছিল, তারই ফলাফল, র‍্যামসে ম্যাকডোনাল্ডের মতো একজন রাখাল ব্রিটেনের প্রথম লেবার প্রধানমন্ত্রী হয়ে উঠেছিলেন।

আজ বইয়ের দাম আগের তুলনায় অনেক সস্তা হলেও পাঠক নেই। একসময় যে বইয়ের দাম ছিল উটের তিন-চতুর্থাংশ, তা এখন অনলাইনে ফ্রি পাওয়া যায়। কিন্তু কে পড়ছে?

বই পড়ার সময়টা এখন মূলত দখল করে নিচ্ছে স্ক্রিন। ইনস্টাগ্রাম, টিকটক, ইউটিউব—এসব যেন মানুষের মনোযোগ ভোগ করছে পোকামাকড়ের মতো। অথচ বইয়ের সঙ্গের সম্পর্কটা সহজ ছিল না কোনোদিনই। প্রাচীন গ্রিক কবি ক্যালিমাকাস যেমন বলেছিলেন, ‘বড় বই মানেই বড় মুশকিল।’

অথচ আজ, সেই ‘মুশকিল’ এড়িয়ে মানুষ নিজেকে এমন এক পরিসরে নিয়ে এসেছে, যেখানে দ্রুততায় ভরা, তথ্যবিচ্ছিন্ন, আবেগতাড়িত বক্তব্যই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। রাজনীতি এর ছায়া এড়াতে পারেনি।

কেউ কেউ মনে করেন, সাহিত্যপ্রীতি হারানো মানেই রাজনীতি হালকা হয়ে যাওয়া। একসময় এথেন্সে একজন নাগরিক যখন ভাঙা টেরাকোটার টুকরোয় ভোট দিচ্ছিলেন, তখন সেটা সম্ভব হচ্ছিল কারণ তার ছিল পড়ার যোগ্যতা। আধুনিক রাজনীতিতে আমরা কী দেখতে পাচ্ছি? সোশ্যাল মিডিয়ার ২৮০ অক্ষরের বর্ণনায় গঠিত ‘নীতি’ বা ‘অভিমত’।

কীভাবে একজন নাগরিক পরিপূর্ণভাবে রাজনৈতিক চিন্তায় অংশ নেবেন, যদি তার পাঠ-অনুশীলনই না থাকে? তাই বিশ্লেষকদের অভিমতে, রাজনীতিতে পরিপূর্ণ অবদান রাখতে পাঠ জরুরি বিষয়।

প্রচীন দার্শনিকরা বলেন, বইপড়া একধরনের শ্রেণিগত সাম্য তৈরি করতে পারে। যেখানে ধনী-গরিব নির্বিশেষে কেউ নিজে চাইলেই প্রবেশ করতে পারে জ্ঞানের রাজ্যে। কিন্তু যখন সেই প্রবেশের আকাঙ্ক্ষাই হারিয়ে যায়, তখন তৈরি হয় নতুন বৈষম্য—চিন্তার বৈষম্য।

আজ যারা বই পড়ে, তারা যেন এক বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতির প্রতিনিধি। অথচ বই পড়া শুধু জ্ঞানের অধিকার নয়, এটা রাজনৈতিক জড়তা কাটানোর পথ, আত্মজ্ঞান ও আত্মউন্নয়নের সিঁড়ি এবং অনেকের জন্য বাঁচার একমাত্র আশ্রয়।

চার্লস ডিকেন্সের ‘গ্রেট এক্সপেকটেশনস’-এর জো যেমন বলেছিলেন, ‘আমাকে একটি ভালো বই দাও… আর আরামদায়ক একটা জায়গায় বসিয়ে দাও, এর চেয়ে বেশি কিছু আমি চাই না।’

পরিশেষে বলা যায়, আমরা যখন বই পড়ার সেই আনন্দ ভুলে যাব, তখন এই দুনিয়াটাও ‘ব্লিক হাউস’-এর মতোই রুক্ষ আর ধোঁয়াটে হয়ে উঠবে।

Link copied!