মর্জিনা খাতুন, কবিতা খাতুন, বেদানা খাতুন, লিপিকা অধিকারী আর আছিয়া খাতুনের মতো ২০-২৫ জন মধ্য ও কম বয়েসি নারী সকালে ঘুম ভাঙতেই চলে আসেন ঝিনাইদহের বিভিন্ন মাছ বাজারে। সঙ্গে আনেন একটি করে মাছ কাটার বঁটি, প্লাস্টিকের মগ আর বস্তা। সকাল থেকে বেলা সাড়ে ১০টা থেকে ১১টা বাজলেই আবার তাদের ছুটি, চলে যান যার যার বাড়িতে। তারা ছোট-বড় সব আকারের মাছই কেটে থাকেন। আকার বা সাইজ অনুযায়ী তারা মাছ কাটেন, প্রতি কেজিতে ৪০ থেকে ৫০ টাকা পান। আর তা দিয়ে হাল ধরেন নিজের সংসারের।
ঝিনাইদহ শহরের ফায়ার সার্ভিস রোড বা ওয়াপদা মোড়ে কথা হয় মর্জিনা, কবিতা, বেদানা, লিপিকা আর আছিয়ার সঙ্গে। তারা জানালেন, নিজেদের সংসার থাকলেও পরিবারের জন্য তারা মাছ কাটেন না; কাটেন তাদের খরিদ্দারদের জন্য, যারা তাদের টাকা দিয়ে থাকেন। আলাপকালে তারা জানালেন, তাদের অনেকেরই নিজের সংসার থাকলেও স্বামী নেই, কেউবা আবার স্বামী পরিত্যক্তা। ফলে নিজের বা সন্তানের জীবন বাঁচাতে সকালে ৩-৪ ঘণ্টার জন্য অন্যর মাছ কুটে আড়াইশ থেকে তিনশ টাকার মতো যা পান, তা দিয়ে চালিয়ে নেন সংসার।
লিপিকা অধিকারীর মতে, রিকশাভ্যানচালক স্বামীর সংসারে তিনি যা পান, তা দিয়ে ‘প্যালা’ দেন। ওই টাকাটায় তার ছেলে আর মেয়ের লেখাপড়ার খরচ অনেকটাই চলে যায়। তা ছাড়া, মাঝেমধ্যে ওদের স্কুলের টিফিন এবং জামাকাপড় কিনতেও কাজে লাগে। ফলে স্বামীর ঘাড়ে চাপ পড়ে কম, বললেন লিপিকা অধিকারী।
কবিতা খাতুন ও বেদানা খাতুন জানালেন, রুই, কাতলা, আইড়, বাউস, ইলিশ, মাগুর, শিং ও টেংরা পুঁটির মতো ছোট-বড় দামি মাছ আবার তেলাপিয়া আর পাঙাসের মতো কম দামের মাছ কাটলেও নিজের জন্য মাছ তাদের খুব কমই কেনা জোটে। সামান্য যা পান তা দিয়ে মাছ কেনা তাদের কাছে স্বপ্নের মতোই মনে হয়, জানালেন কবিতা ও বেদানা খাতুন। তাদের মতে, মাছ কোটার দরদাম ঠিক করার পরও একশ্রেণির মানুষ দুই টাকা কম না দিয়ে শান্তি পান না। তাই তারা অনেক সময় বঞ্চিত হন।
বাজারে মাছ কিনে বাজার থেকেই কেটে নিয়ে যান চাকরিজীবী মহসিন মোল্যা। তিনি অনেকটা রসিকতা করেই বললেন, ‘আমাদের বাড়ির লোকজন (স্ত্রী) আবার মাছ কাটতে পছন্দ করেন না। তাই বাজার থেকেই টাকা খরচ করে কেটে-কুটে নিয়ে যেতে হয়।’
আরেক ক্রেতা মহানন্দ দাস জানালেন, তার স্কুলশিক্ষক স্ত্রী সকালে তাড়াহুড়া করে স্কুলে যান বিধায় আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও মাছ কুটতে পারেন না। ফলে বাজার থেকেই তিনি বাধ্য হয়ে কেটে নিয়ে যাচ্ছেন। অবশ্য ছুটির দিনে তার স্ত্রী মাছ কুটতে স্বাচ্ছন্দবোধ করেন, জানালেন মহানন্দ দাস।
মাছ ব্যবসায়ী সুনিল ও নিত্য কুমার জানালেন, কিছু অভাবী মহিলা বাজারে মাছ কেটে থাকেন বিধায় অনেক মানুষই এখন তাদের ওপর নির্ভরশীল। এতে একদিকে যেমন ওই সব মানুষ উপকৃত হচ্ছেন, পরিশ্রমী নারীরাও তাদের সংসার চালাতে আবদান রাখছেন। তবে তাদের অনেকেরই নিজের সংসার বলতে তেমন কিছু নেই। এতে মাছ ব্যবসায়ীরাও উপকৃত হচ্ছেন, উল্লেখ করে সুনিল ও নিত্য কুমার জানালেন, বাজার থেকে মাছ কেটে নিয়ে যাওয়ার সুবিধা থাকায় তাদের মতো ব্যসায়ীরাও কমবেশি উপকৃত হচ্ছেন, বেশি বেশি বিক্রি হচ্ছে। তবে শহরের বড় বড় ব্যবসায়ী ও চাকুরেদের বউ (স্ত্রী) বা শহরের মহিলারা বাড়িতে নিজে মাছ কাটাকাটি করা অনেক সময় অসম্মানের ব্যাপার মনে করেন। মানুষ প্রয়োজনীয় মজুরি দিতে অনেক সময় অস্বীকার করেন, জানালেন ওই দুই মাছ ব্যবসায়ী।
আপনার মতামত লিখুন :