ঢাকা শুক্রবার, ১২ ডিসেম্বর, ২০২৫

‘গোবেকলি তেপে’ কী, কেন আজও রহস্যময়

ফিচার ডেস্ক
প্রকাশিত: ডিসেম্বর ১২, ২০২৫, ১০:৪৮ এএম
গোবেকলি তেপে। ছবি - সংগৃহীত

দক্ষিণ-পূর্ব তুরস্কের উরফা- প্রাচীনতার গন্ধে ভরা এক পুরনো শহর। এখান থেকে মাত্র ছয় মাইল দূরে একটি অদ্ভুত গোল পাহাড়। নাম- গোবেকলি তেপে, অর্থ- ‘পাহাড়ের পেট’। আজকের পৃথিবীতে যেটি প্রত্নতত্ত্ববিদদের চোখে নিছক একটি প্রত্নস্থল নয়, বরং এমন এক আবিষ্কার যা মানবসভ্যতার পুরো ইতিহাসই উল্টে দিতে পারে। কিন্তু এই মহামূল্যবান আবিষ্কারের গল্প শুরু হয়েছিল খুবই সাধারণভাবে। গত শতাব্দীর ষাটের দশকে ইস্তানবুল বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃতত্ত্ব বিভাগের কয়েকজন ছাত্র গবেষণার কাজে গিয়েছিলেন ওই এলাকায়। পাহাড়ের ঢালে কিছু চুনাপাথরের ফলক দেখে তারা ধারণা করেছিলেন- এটি হয়তো কোনো মধ্যযুগীয় সমাধিক্ষেত্রের ধ্বংসাবশেষ। কৌতূহল থাকলেও গভীরে যাওয়ার মতো তাগিদ তখন তাদের হয়নি। নোটবুকে দুটি লাইন লিখেই ফিরে গিয়েছিলেন তারা। কে জানত, ছাত্রদের চোখ এড়িয়ে গেলেও পৃথিবীর প্রাচীনতম ধর্মীয় স্থাপনার ছাপ সেই টিলার বুকে লুকিয়ে আছে?

প্রায় তিন দশক পরে ভাগ্য আবার সেই ভুলে যাওয়া পাহাড়ের দিকে নজর ফেরাল। ১৯৯০-এর দশকের গোড়ায় জার্মান প্রত্নতত্ত্ববিদ ক্লাউস শ্মিট এই ছাত্রদের পুরনো রিপোর্ট হাতে পেয়ে বুঝলেন, এখানে এমন কিছু আছে যা হয়তো আমাদের জানা ইতিহাসেরও আগে জন্ম নিয়েছে। ১৯৯৪ সালে তিনি উরফায় এসে দাঁড়ালেন রহস্যময় টিলার সামনে। প্রথম দর্শনেই তার মনে হলো- এটি কোনো সাধারণ সমাধিক্ষেত্র নয়, বরং পুরো পাহাড়টাই যেন মানুষের হাতে গড়া। তিনি ও তার দলবল খনন শুরু করতেই একের পর এক স্তম্ভ বের হতে লাগল। প্রতিটি বিশাল, ১০ থেকে ১৫ ফুট উঁচু, কিছু কিছু আবার ২০ টন ওজনের। এই স্তম্ভগুলো দাঁড়িয়ে আছে বৃত্তাকারে, মাঝে দু’টি বড় ‘টি’-আকৃতির স্তম্ভ- যেন প্রাচীন কোনো ক্যাথেড্রালের কোর মন্দির। সবচেয়ে আশ্চর্য, এসব স্থাপনার চারদিকে কোথাও মানুষের দৈনন্দিন বসবাসের চিহ্ন নেই। নেই ঘরের অবশিষ্টাংশ, রান্নার চুলা বা আবর্জনা। অর্থাৎ, এটি বসতি নয়- বরং মানুষের ভক্তি, আচার এবং বিশ্বাসের কেন্দ্র।

যা আরও বিস্ময়কর, এই স্থাপনার বয়স প্রায় ১১,০০০ বছর। অর্থাৎ, ইংল্যান্ডের স্টোনহেঞ্জ নির্মিত হওয়ারও ছয় হাজার বছর আগে এখানে দাঁড়িয়েছিল মানুষের হাতের তৈরি মন্দির। তখন মানুষ ছিল শিকারি-সংগ্রাহক। তারা ছোট ছোট যাযাবর দলে ঘুরে বেড়াত। স্থায়ী বাসস্থান, কৃষিকাজ বা বড় সামাজিক কাঠামোর ধারণা তখনো জন্মায়নি। অথচ সেই সময়েই শত শত মানুষ একত্র হয়ে এতো বিশাল পাথর কেটে, টেনে এনে, নিখুঁতভাবে স্থাপন করেছে- এটি কল্পনাকেও ছাড়িয়ে যায়। কোনো মেটাল টুলস নেই, চাকা নেই- কিন্তু আছে শিল্প, স্থাপত্যবোধ, সংগঠন আর এক অদ্ভুত ধর্মীয় উন্মেষ।

প্রত্নতত্ত্ববিদদের মতে, এত বড় নির্মাণকাজে ৫০০ থেকে এক হাজার মানুষের লাগাতার শ্রম লাগত। অর্থাৎ, গোবেকলি তেপে শুধু মন্দিরই নয়, মানুষের সমন্বিত সমাজ গঠনের প্রথম আঁচ এখান থেকেই পাওয়া যায়।

স্তম্ভগুলোর গায়ে খোদাই করা আছে বিভিন্ন জীবজন্তুর প্রতিকৃতি- শিয়াল, সিংহ, সাপ, বিচ্ছু, শকুন, বুনো শূকর। আশ্চর্যের বিষয় হলো, এসব প্রাণীর বেশিরভাগই ভয়ংকর বা হিংস্র। প্রত্নতাত্ত্বিক ইয়ান হোডারের মতে, এটি হতে পারে ভয় জয় করার প্রতীকী প্রচেষ্টা- এক ধরনের আচারবিধির কেন্দ্র।

আবার কেউ কেউ বলেন, শকুনের উপস্থিতি ইঙ্গিত দেয় এটি মৃতদের আত্মাকে আকাশে পাঠানোর অনুষ্ঠানস্থল হতে পারে। কারণ খননকাজে স্তম্ভঘেরা এলাকায় মানুষের হাড়ও পাওয়া গেছে। আর এই জায়গাটি পাহাড়ের মাথায় এমনভাবে তৈরি যে মনে হয় মৃতরা যেন ‘শিকারিদের স্বর্গ’- অতীতের সবুজ উপত্যকার দিকে তাকিয়ে আছে।

গবেষকরা দেখতে পান, এখানকার মাটি অত্যন্ত পাথুরে হলেও চুনাপাথর এত নরম ছিল যে সহজেই চকমক পাথরের হাতিয়ার দিয়ে কেটে আকার দেওয়া সম্ভব। প্রাচীন নির্মাতারা কয়েকশো গজ দূরে পাহাড়ের নিচ থেকে পাথরের ব্লক কেটে তুলে, দুই-তিন টন ওজন কাঁধে করে বা স্লেজ টেনে পাহাড়ের গায়ে নিয়ে গিয়ে দাঁড় করাতেন। একেকটি মন্দির বৃত্ত তৈরি হয়ে গেলে তারা তা মাটি দিয়ে ঢেকে ফেলতেন। পরের প্রজন্ম আবার নতুন বৃত্ত বানাত। এমন করে শত শত বছর ধরে টিলা ধাপে ধাপে আরও উঁচু হয়েছে। সবচেয়ে অদ্ভুত হলো- এই মানুষরা নিজেরাই তাদের মন্দির মাটির নিচে পুঁতে রেখে গিয়েছিল। যেন জানত- এগুলো ভবিষ্যতের কারো কাছে পৌঁছবে।

ক্লাউস শ্মিটের মতে, গোবেকলি টেপে আমাদের ধারণা পুরো বদলে দেয়। এতদিন আমরা ভাবতাম- মানুষ প্রথমে কৃষি শিখেছে, তারপর স্থায়ী বসতি তৈরি করেছে, তারপর ধর্ম বা মন্দির তৈরির মতো জটিল সংগঠন তৈরি হয়েছে। কিন্তু গোবেকলি টেপে ঠিক উল্টো চিত্র দেখায়। এখানে মানুষের ধর্মীয় সমাবেশই প্রথম বড় সামাজিক সংগঠন তৈরি করেছে। আর এই বৃহৎ সমাবেশে খাদ্য যোগাতে গিয়ে মানুষকে বাধ্য হয়েই শস্য বপন, পশুপালনের দিকে যেতে হয়েছে। অর্থাৎ-ধর্ম আগে, কৃষি পরে। মন্দির আগে, গ্রাম পরে। এ তত্ত্ব মানবসভ্যতার অধ্যায়ে এক অভাবনীয় মোড় এনে দিয়েছে।

পরবর্তী গবেষণায় দেখা গেছে- গোবেকলি তেপের আশপাশে ছোট ছোট বসতির অস্তিত্ব ছিল। সম্প্রতি উরফার আরও কয়েকটি জায়গায় একই ধরনের মেগালিথিক কাঠামো পাওয়া গেছে। ধারণা করা হচ্ছে, গোবেকলি তেপে ছিল পুরো অঞ্চলের কেন্দ্রীয় আচারস্থল, আর আশপাশে ছিল ছোট ছোট প্রাচীন বসতি- যাদের বয়স এগারো হাজার বছরেরও বেশি হতে পারে। যদি এ সত্য হয়, তবে মানবসভ্যতার ইতিহাসের পাতা নতুন করে সাজাতে হবে নিঃসন্দেহে।

২০১০ সালের পর গোবেকলি তেপে বিশ্বজুড়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে আসে। ইউনেসকো একে বিশ্ব ঐতিহ্য ঘোষণা করেছে। প্রতিদিন হাজার হাজার পর্যটক ছুটে আসেন দেখতে পৃথিবীর প্রথম মন্দিরের সম্ভাব্য জন্মস্থান। তবে এই স্বীকৃতি দেখার আগেই, ২০১৪ সালে, ক্লাউস শ্মিট মারা যান। কিন্তু তার মৃত্যুর পরও খনন থেমে নেই। প্রত্নতত্ত্ববিদরা এখনো মাটি থেকে তুলে আনছেন অজানা ইতিহাসের নতুন পর্ব, নতুন প্রশ্ন, নতুন রহস্য।

গোবেকলি তেপে এখন আর শুধু প্রত্নস্থল নয়- এ যেন সময়ের দরজা। এখানে দাঁড়ালে মনে হয়, হাজার বছর আগের মানুষ যেন কানে কানে বলছে- সভ্যতা শুধু ইতিহাসের পাঠ্যবইয়ে লেখা নয়; তার শিকড় আরও গভীরে, আরও দুর্বোধ্য, আরও বিস্ময়কর।