চলছে বর্ষাকাল। ঝড়ছে অঝোরে বৃষ্টি। এই বৃষ্টিতে যারা দৈনন্দিন কাজে বাধ্য হচ্ছেন বাইরে বের হতে, তাদেরকে অনেক সময় বৃষ্টির পানিতে ভিজতে হচ্ছে। কারও বেশি, কারও বা কম। আবার এমন অনেক আছেন, যারা বৃষ্টিতে ভিজলে আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে উঠেন।
কেউ দল বেঁধে খেলতে নামেন, তা সেটা ফুটবল হোক বা ক্রিকেট। আবার অনেকে পরিবারের সদস্যদের সাথে করে ছাদে উঠেন বৃষ্টির শীতল পানিতে নিজেকে একটু ভিজিয়ে নিতে। এতে যেমন আনন্দ বা মজা আছে, আবার উল্টোটাও কিন্তু ঘটতে পারে।
এই রিমঝিম বৃষ্টির পানি আপনাকে অসুস্থও করে তুলতে পারে। তাই আসুন আজকের আলোচনায় একটু জেনে নেওয়া যাক বর্ষাকাল বা বৃষ্টিতে আপনাকে কোন কোন বিষয়ে একটু সতর্ক থাকতে হবে এবং সেটা কেন।
বর্ষাকালে আবহাওয়া ঠান্ডা এবং আর্দ্র থাকে, যার ফলে মানুষ আবহাওয়ার চাপ কম অনুভব করে। এবং সহজেই ফুসফুসে নানাবিধ সংক্রমণের ঝুঁকিতে পড়তে পারে।
আর তাই আমি মনে করি, শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণের প্রকৃতি সম্পর্কে জানা থাকলে এবং তা মেনে চললে এই ভাইরাস বা সংক্রমন নামের পোকামাকড়গুলি আপনার থেকে দূরে থাকবে। চারটি দীর্ঘস্থায় রোগের প্রতি আমাদের সতর্ক থাকা উচিত, কারণ এগুলি সাধারণত বৃষ্টির সাথে দেখা দেয়।
১. সাধারণ সর্দি। এটি করোনাভাইরাসের মতো ভাইরাস সংক্রমণ, কাশি বা হাঁচির মাধ্যমে ভাইরাস শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে বা সংক্রামিত ব্যক্তির সংস্পর্শে এরা আসা-যাওয়া করে।
একবার সংক্রামিত হলে এটি প্রায় দুই-তিন দিন ধরে ইনকিউবেশনে থাকে, যা হাঁচি, রক্তক্ষরণ, নাক দিয়ে পানি পড়া, হালকা জ্বর এবং তারপরে কাশি হিসাবে প্রকাশ পায়।
এখন বলছি এই লক্ষণ দেখা দিলে কী চিকিৎসা নিতে পারেন। প্রচুর কুসুম গরম পানি পান করুন। যদি জ্বর বেড়ে যায় এবং আরও কাশি, কফ, শ্বাসকষ্ট, বা ক্ষুধা হ্রাস পায়, তাহলে অনুগ্রহ করে আপনার ডাক্তারের সাথে দেখা করুন। একই সাথে ঘন ঘন হাত ধুবেন। মাস্ক পরুন এবং সংক্রামিত ব্যক্তির সাথে ব্যক্তিগত জিনিসপত্র ভাগ করা এড়িয়ে চলুন।
২. আরেকটি বিষয়ে বলছি। আপনি আক্রান্ত হতে পারেন ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসেও। এই ফ্লু ভাইরাস সাধারণত নাকের শ্লেষ্মা নিঃসরণ বা কফের মতো শ্লেষ্মা নিঃসরণে থাকে। তাই যদি কোনো সংক্রামিত ব্যক্তি দুর্বল বায়ু চলাচল স্থানে থাকেন, তাহলে তারা সহজেই কাশি বা হাঁচির মাধ্যমে অন্যদের কাছে ভাইরাস সংক্রমণ করতে পারে।
সংক্রমণের পর লক্ষণগুলি দেখা দিতে প্রায় দুই-তিন দিন সময় লাগে। এর লক্ষণ হচ্ছে উচ্চ জ্বর, মাথাব্যথা, পেশী ব্যথা, ক্লান্তি, কাশি, গলা ব্যথা, নাক দিয়ে পানি পড়া এবং রক্তক্ষরণ। এই লক্ষণগুলোর প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে আলোচনা করা যাক। প্যারাসিটামলের মতো জ্বর কমানোর ওষুধ গ্রহণ করুন। তবে সঠিক রোগ নির্ণয়ের জন্য যত তাড়াতাড়ি সম্ভব একজন ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করুন।
কারণ এই ইনফ্লুয়েঞ্জা ব্রঙ্কাইটিসের কারণ হতে পারে, বিশেষ করে ঝুঁকিপূর্ণ রোগীদের। যেমন, শিশু, বয়স্ক, ডায়াবেটিস রোগী, দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি, হৃদরোগ এবং গর্ভবতী মহিলারা। এই রোগ প্রতিরোধের জন্য বছরে অন্তত একবার ফ্লু টিকা নিন।
বিশেষ করে, এটা বেশি প্রয়োজন উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ গ্রুপের ব্যক্তিদের জন্য—যেমন, ৬ মাস থেকে ৫ বছর বয়সি শিশু, ৬৫ বছরের বেশি বয়সি বয়স্ক ব্যক্তি, গর্ভবতী মা, হৃদরোগ, কিডনি রোগ, ডায়াবেটিস, ক্যান্সারের মতো দীর্ঘস্থায়ী রোগে আক্রান্ত রোগী, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকা রোগী এবং স্থুলতা।
৩. এবার একটু ভিন্ন বিষয়ে আসা যাক। বর্ষাকালে কিন্তু ঘরে মশার উপদ্রব বাড়ে। ফলে ডেঙ্গুর আশংকা দেখা দেয়। এমনিতেই এখন আপনার চাপাপাশে ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়েছে। মনে রাখবেন, ডেঙ্গুও কিন্তু ভাইরাস সংক্রমণ।
সংক্রামিত এডিস ইজিপ্টি, যা সাধারণত মশা নামে পরিচিত। এরা মানুষের মধ্যে ভাইরাস সংক্রমণ করতে পারে। তারা স্থির জলে বৃদ্ধি পায় এবং দিনের বেলায় সক্রিয় থাকে।
একবার সংক্রামিত হলে ২ থেকে ৭ দিনের মধ্যে লক্ষণগুলি আক্রান্তের মাঝে দেখা দিতে শুরু করবে। এর লক্ষণগুলো নিশ্চয় অনেকেই জানেন। অতিরুক্ত জ্বর, মাথাব্যথা, শারীরিক ব্যথা, ক্ষুধামন্দা, বমি বমি ভাব, বমি হতে পারে। কারও কারও ত্বকের নিচে একাধিক ছোট লাল ফুসকুড়ি হতে পারে।
এই লক্ষণ দেখা দিলে প্যারাসিটামলের মতো জ্বর কমানোর ওষুধ গ্রহণ করুন। তবে কখনোই অ্যাসপিরিন বা এনএসএআইডি, যেমন, আইবুপ্রোফেন গ্রহণ করবেন না। আরেকেটি কথা হলো, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব একজন ডাক্তারের সাথে দেখা করুন। রক্ত পরিক্ষা করিয়ে নিশ্চিত হোন, আপনি ডেঙ্গু আক্রান্ত কি না।
আর সবার জন্যই বলছি। সংক্রামিত পানি এড়িয়ে চলুন এবং এর উৎস, বিশেষ করে স্থির বা আবদ্ধ পানির উৎস নির্মূল করুন। ৯ থেকে ৪৫ বছর বয়সি পূর্বে সংক্রামিত রোগীদের এবং যারা আগে সংক্রামিত হননি তাদের জন্য টিকা দেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছি।
৪. আরও কিছু বিষয় নিয়ে কথা বলা যেতে পারি। তাদের মধ্যে একটি হচ্ছে শ্বাসযন্ত্রের সিনসিশিয়াল ভাইরাস। শিশু এবং প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে এই রোগ সংক্রমণ হতে পারে। তবে এটি ২ বছর বয়স থেকে শুরু করে প্রাক-বিদ্যালয়ের শিশুদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দেখা যায়।
সংক্রমণ
সংক্রামিত ব্যক্তির নাক থেকে নিঃসৃত শ্লেষ্মা, লালার মতো সরাসরি যোগাযোগ। কাশি বা হাঁচি থেকে শ্বাসনালীর মাধ্যমে এই রোগের সংক্রমণ হতে পারে।
এর লক্ষণ সাধারণত প্রকাশ পায় সংক্রমণের প্রায় ৩ থেকে ৫ দিন পর । শিশুদের জ্বর, কাশি, কফ, নাক দিয়ে পানি পড়া দেখা দিতে পারে। যদি তীব্র হয়, তাহলে ক্রমাগত কফের সাথে কাশি দিতে পারে এবং ক্লান্ত হয়ে পড়তে পারে।
এই রোগের চিকিৎসা হচ্ছে প্যারাসিটামলের মতো জ্বর কমানোর ওষুধ খাওয়া। তাপ দূর করার জন্য আর্দ্র তোয়ালে দিয়ে শরীর মুছে নিন। যদি অবস্থার উন্নতি না হয়, তাহলে হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা সহায়তা নেওয়া ভালো।
বিশেষ করে ঝুঁকিপূর্ণ রোগীদের জন্য, যেমন বয়স্ক রোগী, ডায়াবেটিস বা কিডনি রোগের মতো দীর্ঘস্থায়ী রোগের রোগী, অথবা ২ বছরের কম বয়সি শিশুদের জন্য। গুরুতর অবস্থার বিকাশের সম্ভাবনা রয়েছে।
মনে রাখবেন টিকার বিষয়টাও। ছোট শিশুদের মধ্যে এখনও কোনো কার্যকর টিকা নেই। যদি তাদের জ্বর হয়, তাহলে স্কুল এবং শিশু যত্ন কেন্দ্রগুলিতে এর বিস্তার রোধ করার জন্য বাইরে না গিয়ে যতক্ষণ না তারা সুস্থ হয় ততক্ষণ বাড়িতে থাকাই ভালো।
কখন এটি দীর্ঘস্থায়ী হয়?
এই অবস্থাগুলোকে দীর্ঘস্থায়ী করে তোলে এমন লক্ষণগুলি হলো সাধারণ সর্দি বা ইনফ্লুয়েঞ্জা সংক্রমণের পরে ৩ সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে অবিরাম কাশি থাকে। অনেক সময় ব্রঙ্কিয়াল হাইপাররসপন্সিভনেস হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, যখন ভাইরাল সংক্রমণের পরে ব্রঙ্কাস সহজেই উদ্দীপিত হতে পারে। এর ফলে রোগীর ৩-৪ সপ্তাহ ধরে দীর্ঘস্থায়ী কাশি হতে পারে।
আজকের আলোচনার শেষদিকে চলে আসছি। এবার জেনে নিন, শুধু সতর্কতা আর ঘরোয়া চিকিৎসা নয়, কখন চিকিৎসকের চিকিৎসার পরামর্শ নেবেন। যদি আপনি নিচে বর্ণিত লক্ষণগুলির মধ্যে কোনোটি অনুভব করেন, তাহলে আমি মনে করি, অবিলম্বে একজন ডাক্তারের সাথে দেখা করুন। এবার লক্ষণগুলো জেনে নিন।
তীব্র জ্বর, যা জ্বর কমানোর ওষুধ দিয়েও কমছে না, শ্বাসকষ্টসহ অনেক বেশি কাশি। অক্সিজেন স্যাচুরেশন ৯৫%-এর কম। দীর্ঘস্থায়ী কাশি, যা ৩ সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে আছে। এগুলো দেখা দিলে অবহেলা না করে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
শেষ করার আগে একটা কথা না বললেই নয়, বর্ষাকালে প্রতিরোধমূলক কিছু ব্যস্থার কথা বলছি। তাজা রান্না করা স্বাস্থ্যকর খাবার খান। নিজেকে উষ্ণ রাখার জন্য পোশাক পরুন। প্রতিদিন পর্যাপ্ত পানি পান করুন। নিয়মিত ব্যায়াম করুন। কমপক্ষে ৬-৮ ঘণ্টা ঘুমান।
বৃষ্টি বা বন্যার মধ্য দিয়ে হেঁটে যাওয়া এড়িয়ে চলুন। বৃষ্টিতে ভিজে গেলে বাড়িতে ফিরে আসার সাথে সাথে গোসল করুন এবং চুল ধুয়ে ফেলুন। মশা এবং জমে থাকা পানিযুক্ত জায়গাগুলি এড়িয়ে চলুন। সংক্রমণ এড়াতে ঘন ঘন হাত ধুয়ে নিন। ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন। নিরাপদে থাকুন।
লেখক: ডা. জাকিয়া ফেরদৌসী খান, এমবিবিএস, এমপিএইচ, কমিউনিটি মেডিসিন বিশেষজ্ঞ