বাংলাদেশে পানির প্রাচুর্য থাকলেও নিরাপদ পানির অভাব একটি বিরাট সমস্যা। শহর থেকে শুরু করে গ্রাম, সব জায়গায়ই পানির উৎসে ব্যাকটেরিয়া, আর্সেনিক বা অন্যান্য দূষণকারীর উপস্থিতি বড় চিন্তার কারণ।
দূষিত পানি ব্যবহারের ফলে ডায়রিয়া, টাইফয়েড, হেপাটাইটিসসহ নানা পানিবাহিত রোগ ছড়িয়ে পড়ে। যা বিশেষ করে শিশু ও বয়স্কদের জন্য মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি করে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও UNICEF-এর এক প্রকাশনায় বলা হয়েছে, বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ৬ কোটি ৮৩ লাখ মানুষ নিরাপদভাবে প্রক্রিয়াজাত পানির সুবিধা পায় না।
তাই নিজ ব্যবস্থায় নিজের এবং পরিবারের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় পানি বিশুদ্ধ করা সবসময়ই অপরিহার্য। ঘরে বসে সহজ কিছু পদ্ধতিতে পানি বিশুদ্ধ করা সম্ভব। চলুন, এখন দেখে নিই ৯টি কার্যকর পানি বিশুদ্ধকরণের পদ্ধতি।
১. ফিল্টার (Water Filter)
পানি বিশুদ্ধ করার একটি সহজ ও কার্যকর পদ্ধতি হলো ওয়াটার ফিল্টার ব্যবহার করা। আধুনিক ফিল্টারগুলো বিভিন্ন ধরনের দূষণ যেমন বালু, কাদা, ব্যাকটেরিয়া এমনকি আর্সেনিক বা ক্লোরিনও দূর করতে সক্ষম।
অনেক ফিল্টারে কার্বন ফিল্টার ও রিভার্স অসমোসিস (RO) প্রযুক্তি থাকে, যা পানিকে স্বচ্ছ, নিরাপদ এবং স্বাদযুক্ত করে তোলে।
ফিল্টার ব্যবহার করলে আপনি শুধু পানি বিশুদ্ধই করছেন না, বরং পরিবারের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় একটি দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগও করছেন। এটি ব্যবহার করা সহজ এবং রক্ষণাবেক্ষণেও তুলনামূলকভাবে খরচ কম হয়।
২. ফুটিয়ে পানি বিশুদ্ধকরণ
পানি বিশুদ্ধ করার আরেকটি সহজ ও প্রচলিত পদ্ধতি হলো ফুটিয়ে ব্যবহার করা। পানি ফুটালে এতে থাকা ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস এবং অন্যান্য ক্ষতিকারক জীবাণু দূর হয়। অভিজ্ঞদের মতে, পানি কমপক্ষে ৫–১০ মিনিট ফুটানো হলে তা জীবাণুমুক্ত হয়।
ফুটিয়ে পানি ব্যবহার করলে, বিশেষ করে শিশুরা ও বয়স্করা অনেক ধরণের পানিবাহিত রোগ থেকে রক্ষা পায়। তবে মনে রাখতে হবে, পানি ফুটিয়ে আর্সেনিক বা ভারী ধাতু দূর সম্ভব নয়। এজন্য ফুটানো পানি কখনো কখনো ফিল্টার বা অন্যান্য পদ্ধতির সঙ্গে মিলিয়ে ব্যবহার করা নিরাপদ।
৩. ক্লোরিন ট্যাবলেট বা ব্লিচিং
পানি জীবাণুমুক্ত করার জন্য ক্লোরিন ট্যাবলেট বা দৈনন্দিন ব্যবহারের ব্লিচিং লিকুইড একটি দ্রুত ও কার্যকর পদ্ধতি। ছোট গ্রাম্য এলাকা বা ভ্রমণের সময় এটি খুবই উপকারী।
WHO ও UNICEF-এর নির্দেশনা অনুযায়ী, ছোট মাত্রায় ক্লোরিন ব্যবহার করলে পানি নিরাপদ হয় এবং স্বাদও কম পরিবর্তিত হয়।
সাধারণত প্রতি ৩ লিটার পানিতে একটি ক্লোরিন ট্যাবলেট বা ১০ লিটার পানিতে ব্লিচিং মিশিয়ে ৩০ মিনিট অপেক্ষা করলে, ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাস প্রায় ৯৯% পর্যন্ত দূর হয়।
তবে এটি পানি বিশুদ্ধ করলেও, আর্সেনিক বা ভারী ধাতু দূর করতে সক্ষম নয়। তাই দূষিত অঞ্চলে এই পদ্ধতি সাধারণত ফিল্টার বা ফুটানো পানির সঙ্গে মিলিয়ে ব্যবহার করা উত্তম।
যারা অন্তঃসত্তা অথবা থাইরয়েড রোগে ভুগছেন, তাদের ক্লোরিন বা ব্লিচিং দিয়ে বিশুদ্ধ করা পানি পান করা এড়িয়ে চলা উচিত।
৪. পটাশ বা ফিটকিরি
পটাশ বা ফিটকিরি (Potash Alum) ব্যবহার করে পানি বিশুদ্ধ করা একটি প্রাচীন পদ্ধতি। সাধারণভাবে, পানি কাদাযুক্ত বা ঝাপসা থাকলে কিছু পরিমাণ পটাশ মিশিয়ে নিলে পানি স্বচ্ছ হয়ে যায়।
পদ্ধতি:
-
পানিতে প্রয়োজনীয় পরিমাণ পটাশ মিশান। (১ লিটার পানিতে ০.৫ গ্রাম বা ১ চিমটি ফিটকিরি)
-
কয়েক মিনিট ভালোভাবে নাড়ুন।
-
পানি ২–৩ ঘণ্টা এভাবেই রেখে দিন। এতে ময়লা ও কাদা ধীরে ধীরে তলানিতে জমে যাবে।
-
পানি স্বচ্ছ হয়ে গেলে উপরের অংশ আলাদা করে ছেঁকে ব্যবহার করুন।
ফিটকিরি মূলত কাদা ও নরম কণা জমাট বাধতে সাহায্য করে, যা পরে ছাঁকনি বা ফিল্টারের মাধ্যমে সরানো যায়।
এটি ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাস পুরোপুরি দূর করতে পারে না, তাই এই পদ্ধতি সাধারণত ফুটানো পানি বা ফিল্টারের সঙ্গে মিলিয়ে ব্যবহার করা উত্তম।
৫. সৌর পদ্ধতি (Solar Disinfection)
সৌর পদ্ধতি বা SODIS (Solar Water Disinfection) হল একটি সহজ ও প্রাকৃতিক পদ্ধতি, যা সূর্যের UV রশ্মি ব্যবহার করে পানি জীবাণুমুক্ত করে।
পদ্ধতি:
-
স্বচ্ছ প্লাস্টিক বা কাচের বোতলে পানি ভরে রাখুন।
-
বোতলটি সরাসরি রোদে ৬–৮ ঘণ্টা রাখুন।
-
এতে করে পানি জীবাণুমুক্ত হয়ে যায়।
৬. আল্ট্রাভায়োলেট রশ্মি (UV)
UV রশ্মি ব্যবহার করে পানি জীবাণুমুক্ত করা একটি আধুনিক পদ্ধতি। অতিবেগুনি রশ্মি পানির মধ্যে থাকা ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস এবং প্রোটোজোয়া ধ্বংস করে। তাছাড়া, পানি স্বচ্ছ ও নিরাপদ করে তোলে।
পদ্ধতি:
-
UV ডিভাইস বা স্টিকটি পানির ট্যাঙ্কে প্রবেশ করান।
-
নির্দিষ্ট সময় (সাধারণত কয়েক মিনিট) UV রশ্মির মাধ্যমে পানি জীবাণুমুক্ত হয়।
বাজারের অনেক আধুনিক ফিল্টারে এখন এই UV পিউরিফিকেশন প্রযুক্তি পাওয়া যায়। এই পদ্ধতি কোন ধরনের রাসায়নিক ব্যবহার ছাড়াই পানি নিরাপদ করে। তাই স্বাদ বা গন্ধ প্রায় অপরিবর্তিত থাকে।
তবে মনে রাখতে হবে, UV কেবল জীবাণু দূর করতে সক্ষম; আর্সেনিক বা ভারী ধাতু দূর করতে এটি কার্যকর নয়।
৭. আয়োডিন (Iodine)
আয়োডিন ব্যবহার পানি জীবাণুমুক্ত করার জন্য একটি দ্রুত এবং সহজ উপায়।
১ লিটার পানিতে ২ শতাংশ আয়োডিনের দ্রবণ মেশান। অথবা ১ লিটার পানিতে ২টি আয়োডিন ট্যাবলেট এবং বেশি ঘোলা পানির জন্য ৩টি ট্যাবলেট দিন। এরপর পানি কমপক্ষে ৩০ মিনিট ঢেকে রাখুন।
তবে দীর্ঘমেয়াদে বা বেশি পরিমাণ পানি বিশুদ্ধ করতে এই পদ্ধতি সুবিধাজনক নয়। তাই এটি সাধারণত ছোট পরিবার বা জরুরি অবস্থার জন্য ব্যবহার করা উত্তম
আর, এই কাজটি শুধুমাত্র দক্ষ কারও মাধ্যমে করা উচিত। কারণ পানি ও আয়োডিনের মাত্রা সঠিক না হলে তা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।
আয়োডিন দিয়ে বিশুদ্ধ করা পানি একটানা ৩ সপ্তাহের বেশি খাওয়া উচিত নয়। কারণ এতে থাইরয়েডজনিত সমস্যা হতে পারে। এছাড়া, অন্তঃসত্তা নারী ও থাইরয়েড রোগীরা আয়োডিন পদ্ধতিতে বিশুদ্ধ করা পানি এড়িয়ে চলবেন।
৮. অ্যাক্টিভেটেড চারকোল (Activated Charcoal)
অ্যাক্টিভেটেড চারকোল পানি বিশুদ্ধ করার জন্য একটি কার্যকর প্রাকৃতিক ফিল্টার মাধ্যম। এটি পানিতে থাকা অণুজীব, রাসায়নিক, রঙ এবং গন্ধ শোষণ করতে সক্ষম।
ফলে পানি স্বচ্ছ, পরিষ্কার এবং স্বাদযুক্ত হয়। ব্যবহার প্রক্রিয়াও খুবই সহজ।
চারকোল ফিল্টারের মাধ্যমে পানি ছেঁকে নিলে পানিতে থাকা ক্ষতিকারক উপাদানগুলো দূর হয়ে যায়।
তবে এই পদ্ধতি ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাস পুরোপুরি দূর করতে পারে না। তাই এটি ফিল্টার করা বা ফুটানো পানির সঙ্গে মিলিয়ে ব্যবহার করা উচিত।
৯. বালু-নুড়ি ফিল্টার (Sand and Gravel Filter)
বালু-নুড়ি ফিল্টার হল পানি বিশুদ্ধ করার জন্য একটি প্রাকৃতিক ও আদিম পদ্ধতি । এতে বিভিন্ন স্তরের বালি, নুড়ি ও ছোট পাথরের স্তর ব্যবহার করে পানি ছাঁকা হয়।
প্রথমে পানি উপরের স্তরে ঢালা হয়, যা বালির মাধ্যমে ধীরে ধীরে নিচে নামে। এই সময় পানি থাকা বড় কণা, কাদা এবং অন্যান্য অম্লীয় পদার্থ আটকে যায়।
প্রক্রিয়াটি ঘরে বা বাইরে সহজেই করা যায়। এই পদ্ধতিও ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাস পুরোপুরি দূর করতে পারে না। তবে ফুটানো বা ফিল্টারের পানির সঙ্গে মিলিয়ে এটি নিরাপদ পানি নিশ্চিত করতে পারে।