আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিদেশিদের হাতে চট্টগ্রাম বন্দরের বিভিন্ন স্থাপনা ও টার্মিনাল ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল।
নানা আলোচনা-সমালোচনার পরও একই পথে এগোচ্ছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।
শ্রমিক-কর্মচারীদের আন্দোলনকে উপেক্ষা করে বন্দরের সর্বোচ্চ রাজস্ব আহরণকারী নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) দুবাইভিত্তিক অপারেটর কোম্পানি ডিপি ওয়ার্ল্ডকে দেওয়ার প্রক্রিয়া চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে।
এরই মধ্যে সৌদি কোম্পানি রেড সি গেটওয়ে ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডকে (আরএসজেটিআই) দেওয়া পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনালে (পিটিসি) অপারেশনাল কার্যক্রম শুরু হয়েছে।
শুক্রবার (২ মে) প্রেস সচিব শফিকুল আলম চট্টগ্রাম সফরে গিয়ে বিষয়টি আরও স্পষ্ট করেছেন।
তিনি বলেছেন, সেপ্টেম্বরের মধ্যেই চট্টগ্রাম বন্দরের এনসিটিসহ বিভিন্ন প্রকল্পে বিদেশি বিনিয়োগের প্রক্রিয়া শেষ করতে চায় সরকার। এই বন্দরে বিদেশি বিনিয়োগের মাধ্যমে বাংলাদেশকে ম্যানুফ্যাকচারিং হাব হিসেবে গড়ে তোলার ইচ্ছা রয়েছে প্রধান উপদেষ্টার।
জানা যায়, এর পরদিনই শনিবার (৩ মে) প্রথমবারের মতো এই টার্মিনালে আমদানি পণ্য নিয়ে ভিড়েছে বিদেশি জাহাজ। বন্দরের বে-টার্মিনাল এবং লালদিয়ার চরও বিদেশিদের হাতে ছেড়ে দেওয়ার বিষয়ে বিদেশি কোম্পানিগুলোর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা চলছে।
বর্তমানে নিউমুরিং টার্মিনালটি ৯৫০ মিটার দীর্ঘ, যেখানে একসঙ্গে চারটি সমুদ্রগামী কনটেইনার জাহাজ এবং একটি অভ্যন্তরীণ ছোট জাহাজ নোঙর করতে পারে।
টার্মিনালটিতে রয়েছে ১৪টি গ্যান্ট্রি ক্রেন, যেখানে দরকার ১২টি। এ ছাড়া কন্টেইনার নামানোর পর পরিবহনের জন্য প্রয়োজনীয় সব আধুনিক যন্ত্রপাতিও রয়েছে।
বার্ষিক গড় কন্টেইনার হ্যান্ডলিং সক্ষমতা ১০ লাখ ইউনিট হলেও গত বছর দেশীয় অপারেটর সেটি ছাড়িয়ে ১২.৮১ লাখ কনটেইনার হ্যান্ডল করেছে।
গত অর্থবছরে এই বন্দর আয় করেছে প্রায় ১,২১৬ কোটি টাকা। সব খরচ বাদ দিয়ে প্রকৃত আয় ছিল ৫৭৪ কোটি টাকা, অর্থাৎ প্রতি কনটেইনারে বন্দরের আয় ছিল গড়ে ৪৭ ডলার। এত লাভজনক ও কার্যকর ব্যবস্থাপনার মধ্যেও কেন টার্মিনালটি বিদেশিদের হাতে তুলে দেওয়া হবে- প্রশ্ন শ্রমিকদের।
২০০৭ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত এই একটি টার্মিনালেই ১ কোটি ১৮ লাখ ৬৩ হাজার টিইইউএস (২০ ফুট সমমানের) কন্টেইনার হ্যান্ডলিং হয়েছে। এই টার্মিনালে বর্তমানে যে পরিমাণ ইক্যুইপমেন্ট আছে, তা দিয়ে আগামী ১৫ বছর চালানো যাবে।
গত রোববার (৪ মে) বন্দরের নিউমুরিং কন্টেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) বিদেশিদের হাতে তুলে না দেওয়ার দাবি জানান চট্টগ্রাম মহানগর জামায়াতের আমির শাহজাহান চৌধুরী।
এ ছাড়া জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দল, বন্দর শ্রমিক ফেডারেশন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছে। তারা এনসিটিসহ লাভজনক টার্মিনাল বিদেশিদের হাতে তুলে দেওয়ার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় এবং মন্ত্রণালয়ে স্মারকলিপিও পাঠায়।
চট্টগ্রাম মহানগর জামায়াতের আমির শাহজাহান চৌধুরী বলেন, বিদেশি বিনিয়োগ আমরাও চাই। দেশের উন্নয়নের জন্য বিদেশি বিনিয়োগ অপরিহার্য। কিন্তু সে বিনিয়োগ হোক গ্রিন ফিল্ডে।
তিনি আরও বলেন, দেশের বিভিন্ন স্থানে ইকোনোমিক জোনগুলোতে বিদেশিরা এসে বিনিয়োগ করছে। ঠিক তেমনি আমাদের বে টার্মিনাল থেকে শুরু করে সীতাকুণ্ড-মীরসরাই ও মাতারবাড়িতে প্রচুর বিনিয়োগের সুবিধা রয়েছে। সেখানে বিনিয়োগ আসুক। আমাদের নিজস্ব অর্থায়নে তৈরি করা লাভজনক ও স্বয়ংসম্পূর্ণ এনসিটি টার্মিনাল কেন বিদেশিদের দেওয়া হবে, তা বোধগম্য নয়।
তিনি বলেন, ফ্যাসিস্ট সরকার পালিয়ে গেলেও বিভিন্ন স্থানে ঘাপটি মেরে থাকা তাদের লোকজন, বর্তমান সরকারকে বিভ্রান্তিকর বিভিন্ন তথ্য দিয়ে দেশের রাজস্ব ভান্ডার শেষ করার চেষ্টা করছে। দেশের সার্বভৌমত্বের ওপর আঘাত হানার জন্য এনসিটি বিদেশিদের হাতে তুলে দেওয়ার অপচেষ্টা চালানো হচ্ছে। এমন ষড়যন্ত্র জামায়াত বাস্তবায়ন করতে দেবে না।
চট্টগ্রাম বন্দরের শ্রমিক কর্মচারী ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক শেখ নুরুল্লাহ বাহার বলেন, ‘এরই মধ্যে পতেঙ্গা কন্টেইনার টার্মিনাল বিদেশিদের হাতে চলে যাওয়ায় সেখানে বন্দরের শ্রমিক-কর্মচারীদের কাজ করার সুযোগ সংকুচিত হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘একই ভাবে এনসিটি দিয়ে দেওয়া হলে বন্দরের অন্তত ৭ হাজার শ্রমিক-কর্মচারী জীবিকা হারাবেন। এনসিটির আশপাশে নৌবাহিনীর সামরিক ঘাঁটিসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা রয়েছে, এখানে বিদেশিদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা হলে দেশের সার্বভৌমত্ব হুমকিতে পাড়বে।’
এদিকে, ২৪ এপ্রিল বন্দর দিবস উপলক্ষে আয়োজিত মতবিনিময় সভায় চট্টগ্রাম বন্দর চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এসএম মরিুজ্জামান সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, এনসিটি বিদেশিদের হাতে দেওয়ার বিষয়টি এখনো চূড়ান্ত হয়নি, আলোচনা চলছে। তবে বিদেশি অপারেটর নিয়োগ দেওয়া হলে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে বন্দরের সেবার মান ও দক্ষতা বাড়বে এবং বড় অঙ্কের আর্থিক লাভ হবে
কারো চাকরি যাবে না জানিয়ে তিনি বলেন, ‘পতেঙ্গা কন্টেইনার টার্মিনাল বিদেশি প্রতিষ্ঠানের হাতে দেওয়ার পরও সেখানে বাংলাদেশি জনবল কাজ করছে। উপরের লেভেলে বিদেশিরা কাজ করছেন।’
আন্দোলনে থাকা নেতাদের একজন বলেন, ‘দেশের টাকায় জেটি নির্মিত হলো। যন্ত্রপাতিও কেনা হয়েছে দেশের টাকায়। বন্দর ও দেশীয় প্রতিষ্ঠান মিলে টার্মিনালটি ভালোভাবে পরিচালনা করছে। বন্দরের সবচেয়ে বেশি আয় হচ্ছে এই টার্মিনাল থেকে। ১৭ বছর পর এই টার্মিনাল কেন এখন বিদেশিদের হাতে তুলে দিতে হবে?’
তিনি বলেন, ‘বিদেশিরা যদি বিনিয়োগ করতে চায়, তাহলে বে টার্মিনালে আসুক, যেখানে আমরা কোনোকিছুই করিনি। এখানে নয়।’
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম শুক্রবার চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে সরকারের পরিকল্পনা তুলে ধরেন।
তিনি বলেন, ‘বন্দরকে সামনে রেখে বাংলাদেশকে ‘ম্যানুফ্যাকচারিং হাব’ হিসেবে গড়ে তুলতে চান প্রধান উপদেষ্টা। এ জন্য বন্দরে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ানোর মাধ্যমে এর সক্ষমতাও বাড়ানোর পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘বন্দর ঘিরে মিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ আসবে। যেসব কোম্পানি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ৬০ থেকে থেকে ৯০টি বন্দর হ্যান্ডলিং করছে তাদের সঙ্গেই আলোচনা চলছে। সেপ্টেম্বরের মধ্যে এ কাজ শেষ করতে চায় সরকার।’
প্রেস সচিব আরও বলেন, ‘তরুণদের জন্য প্রচুর কর্মসংস্থান তৈরি করতে হবে। বাংলাদেশ ম্যানুফ্যাকচারিং হাব হলে শুধু দেশের ১৮ কোটি মানুষের জন্য নয়; পুরো রিজিওনের ৩০-৪০ কোটি লোক এর সুফল ভোগ করবে। চট্টগ্রামের লালদিয়া, বে টার্মিনাল, পতেঙ্গা টার্মিনাল, মাতারবাড়ী সমুদ্রবন্দরসহ পুরো অঞ্চলটাই বন্দরের উপযোগী।’
তিনি জানান, চট্টগ্রাম বন্দর ও আশপাশের টার্মিনালগুলোর সক্ষমতা ১ দশমিক ২৭ মিলিয়ন টিইইউএস (২০ ফুট দীর্ঘ) কন্টেইনার। এ সরকারের পরিকল্পনা হচ্ছে ২০৩০ সালের মধ্যে এই সক্ষমতা ৭৮ লাখ ৬০ হাজার টিইইউএসে নিয়ে যাওয়া। অর্থাৎ ছয়গুণ বাড়ানো। বাংলাদেশকে ইকোনমিক হাব, ম্যানুফ্যাকচারিং হাব করতে হলে চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা বৃদ্ধিই হচ্ছে এক নম্বর পূর্বশর্ত।
আপনার মতামত লিখুন :