রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কার আনতে ঐকমত্য কমিশনের প্রথম ধাপের আলোচনা শেষ হয়েছে। এতে বেশ কয়েকটি সংস্কার প্রস্তাবে একমত হয়েছেন অধিকাংশ রাজনৈতিক দল। তবে কিছু গুরুত্বপূর্ণ ও মৌলিক সংস্কারে মতপার্থক্য দেখা দিয়েছে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে।
এরমধ্যে প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ, ক্ষমতা, নির্বাচন পদ্ধতিসহ গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি সংস্কার প্রস্তাবে প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি একমত হতে পারেনি। এ কারণে সংস্কার উদ্যোগের সফলতা নিয়েও নানা প্রশ্ন দেখা যাচ্ছে।
গত ১৯ মে প্রথম পর্যায়ের বৈঠক শেষ করেছে ঐকমত্য কমিশন। প্রথম পর্যায়ের আলোচনার ফলাফল বিশ্লেষণ করে দলগুলোর সঙ্গে শিগগিরই দ্বিতীয় পর্যায়ের আলোচনা শুরু হবে আগামী মাসে।
কমিশনের সাথে বৈঠকে অন্তত ১০টি মৌলিক সংস্কার প্রস্তাবে বিএনপির নেতিবাচক অবস্থানে থাকলেও সেগুলোর বেশিরভাগেই জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টিসহ বেশ কয়েকটি দল একমত হয়েছে।
আর কমিশন বলছে, দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে ঐকমত্যের ভিত্তিতে ‘জুলাই সনদ’ তৈরি করা হবে জুলাইয়ের মধ্যেই।
তবে গত বুধবার ঢাকায় এক সমাবেশে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেন, ‘সংস্কারের অভিনব শর্তের আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে আগামী জাতীয় নির্বাচনের ভবিষ্যত।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেছেন, ‘এখন ঐকমত্য যেগুলোতে হয়েছে সেগুলো করে দ্রুত নির্বাচনের রোডম্যাপ দিয়ে দেন (সরকারের প্রতি তাদের আহ্বান)। আর যেগুলোতে ঐকমত্য হবে না সেগুলো বাংলাদেশের জনগণের বাইরে আর কারও করার ক্ষমতা নেই, আমাদেরও ক্ষমতা নেই।’

যদিও ঐকমত্য কমিশন বলছে, যেসব মৌলিক ও গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাবে বড় রাজনৈতিক দলগুলো প্রথম দফায় দ্বিমত জানিয়েছে তাদের আংশিক হলেও রাজি করিয়ে সংস্কার প্রস্তাব চূড়ান্ত করবে তারা।
ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, ‘যে সব প্রস্তাবে একমত হওয়া যাচ্ছে না, আমাদের প্রথম লক্ষ্য হবে দলগুলোর অবস্থানগত দূরত্ব কমিয়ে মধ্যবর্তীভাবে জায়গায় এনে হলেও রাজি করানো।’

গুরুত্বপূর্ণ ও মৌলিক সংস্কার প্রস্তাবগুলো কী?
ঐকমত্য কমিশন মৌলিক যেসব পরিবর্তনের প্রস্তাব দিয়েছে সেগুলোর বেশিরভাগই সংবিধান সম্পর্কিত।
এই সংস্কার প্রস্তাবে রয়েছে সাংবিধানিক ব্যবস্থা, নির্বাহী ক্ষমতার ভারসাম্য, স্বাধীন ও শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন গঠন, সংবিধান সংশোধনে গণভোটের বিধান, বিচার বিভাগের পূর্ণ স্বাধীনতা নিশ্চিত, রাষ্ট্রের সাংবিধানিক পদে নিরপেক্ষ নিয়োগ দান, নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা, দুর্নীতি দমন কমিশন বা দুদক-স্থানীয় সরকার ও জনপ্রশাসন সংস্কারের মতো বিষয়গুলো।
এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে আলোচিত হচ্ছে- ভবিষ্যতে যেকোনো ধরনের ফ্যাসিবাদী শাসনব্যবস্থার উত্থান রোধ এবং রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গ—নির্বাহী বিভাগ, আইনসভা ও বিচার বিভাগের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য আনা।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত সংস্কার কমিশনগুলো বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি, সাধারণ জনগণসহ অনেকের কাছ থেকে মতামত নিয়ে সংস্কার প্রস্তাব নিয়েছে গত কয়েক মাসে।
সংস্কার প্রস্তাবগুলো চূড়ান্ত করার পর গত কয়েক মাস ধরে বিএনপি, জামায়াত, এনসিপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সাথে বৈঠক করে ঐকমত্য কমিশন।
ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, ‘কাঠামোগত পরিবর্তনের জায়গাগুলোতে ঐকমত্য জরুরি। অন্যথায় এতকিছুর পর রাষ্ট্র কাঠামো একই রকম রেখে অগ্রসর হওয়া কঠিন।’
রাজনৈতিক দলগুলোর মতপার্থক্য কোথায়?
ঐকমত্য কমিশনের প্রথম পর্বের আলোচনা শেষে গত সোমবার সংবাদ সম্মেলনে ঐকমত্য কমিশন জানিয়েছে, মৌলিক কাঠামোগত গুরুত্বপূর্ণ বেশ কিছু বিষয়গুলো প্রথম দফার আলোচনার পরও অমীমাংসিত থেকে গেছে। কোনো কোনো সংস্কার প্রস্তাবে প্রধান প্রধান দলগুলো পুরোপুরি বিপরীত অবস্থানেও রয়েছে।
এরমধ্যে প্রধানমন্ত্রী পদে দুই মেয়াদের বেশি না থাকা, প্রধানমন্ত্রী দলীয় প্রধান হতে পারবেন না, সংসদে সংখ্যানুপাতিক উচ্চকক্ষ, জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল বা এনসিসি গঠন, এনসিসির মাধ্যমে সাংবিধানিক নিয়োগ, সংবিধান সংশোধনে গণভোট, জ্যেষ্ঠতম বিচারপতি প্রধান বিচারপতি নিয়োগের মতো প্রস্তাবগুলোতে বিএনপির আপত্তি থাকলেও এতে একমত হয়েছে জামায়াত ইসলামী, এনসিপিসহ আরও কয়েকটি রাজনৈতিক দল।
‘আগামী মাসে বৈঠকে সংস্কার প্রস্তাব চূড়ান্ত হতে পারে। ওই বৈঠকে আমরা আমাদের মত দেবো। যে সব বিষয়ে দ্বিমত আছে সেগুলোও দ্বিতীয় দফার বৈঠকের পর চূড়ান্ত হবে বলে আশা করি’, বলেন জামায়াতে ইসলামীর মুখপাত্র মতিউর রহমান আকন্দ।

গুরুত্বপূর্ণ অনেকে প্রস্তাবে মতপার্থক্য থাকলেও বিদ্যমান ব্যবস্থায় নির্বাচন আয়োজনের পক্ষ একমত রয়েছে বিএনপি ও নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘বিভিন্ন পার্টির বিভিন্ন চিন্তা, বিভিন্ন দর্শনের সাথে আমাদের কেন একমত হতে হবে? আমরা কি বাকশাল নাকি? একমত হওয়ার সুযোগ নাই।’
অন্যদিকে নারী আসনে সরাসরি নির্বাচন প্রস্তাবে বিএনপি-জামায়াত কোনো দলই একমত পোষণ না করলেও এই প্রস্তাবে এনসিপি প্রস্তাবের পক্ষেই তাদের মত দিয়েছে।
এনসিপি’র সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব বলেন, ‘মৌলিক সংস্কার প্রশ্নে একমত না হওয়া গেলে রাষ্ট্রের পরিবর্তন সম্ভব না। সেটি গণঅভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষারও বিপরীত।’
আবার প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা হ্রাস প্রস্তাব আংশিকভাবে একমত হয়েছে বিএনপি। অন্যদিকে রাষ্ট্রীয় মূলনীতি থেকে বহুত্ববাদের মতো বিষয়গুলোতে বেশিরভাগ দলই একমত হয়নি।
ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, ‘যেসব বিষয়ে বড় আকারে অগ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হবে সেগুলো সেগুলো নিয়ে আর হয়তো এগোবে না ঐকমত্য কমিশন। যেমন চারটি প্রদেশ গঠন কিংবা সংবিধানের মূলনীতিতে বহুত্ববাদের প্রশ্নে কোনো দলই একমত হননি। যেগুলো নিয়ে কোনো দলই একমত হননি, সে সব জায়গা নিয়ে কমিশন আর এগোবে না।’
শেখ হাসিনা সরকার পতনের মধ্য দিয়ে ভেঙে গেছে জাতীয় সংসদ। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এসব সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা করলেও সেগুলো কীভাবে বাস্তবায়ন হবে সেটি নিয়ে নানা প্রশ্নও সামনে আসছে। সংস্কারের সুপারিশগুলো কীভাবে বাস্তবায়ন হবে, এ নিয়েও রাজনৈতিক দলগুলো বিপরীতমুখী অবস্থানে রয়েছে।
বিএনপির কথা, কমিশনের সঙ্গে সংলাপে রাজনৈতিক দলগুলোর যেসব বিষয়ে ঐকমত্য হবে, তা নিয়ে সই হবে জুলাই সনদ। এর ভিত্তিতে পরবর্তী সংসদে সাংবিধানিক সংস্কার হবে। তবে এই সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়নে জামায়াতের প্রস্তাবনা গণভোট এবং এনসিপির প্রস্তাবে রয়েছে গণপরিষদ নির্বাচন।
এনসিপির আরিফুল ইসলাম আদীব বলেন, ‘সংস্কার প্রস্তাবনা বাস্তবায়ন পদ্ধতির ক্ষেত্রে অধিকাংশ দলই গণভোট বা গণপরিষদের মতামত দিছে। বিএনপির এটা নিয়ে আপত্তি। এটাতে বিএনপি বাদে অন্য দলগুলো যে মতামত দিয়েছে সেটাই যৌক্তিক। হয় গণভোট বা গণপরিষদ দিয়ে এটির সমাধান বের করতে হবে।’

তবে এই ইস্যুতে বিএনপির বক্তব্য স্পষ্ট। তারা বলছে, যেসব প্রস্তাবনা এসেছে তার অনেকগুলোই সাংবিধানিক। যে কারণে সাংবিধানিক বিষয়গুলো নির্বাচিত সংসদের মাধ্যমেই বাস্তবায়নের পক্ষে বিএনপি।
দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘গণভোটও তো একটা সংস্কারের অংশ। যেগুলো ঐকমত্য হবে না সেগুলো আগামী সংসদের মাধ্যমে পাশ করতে হবে। সংসদ ব্যতীত তো এই সংস্কার সম্ভব না।’
ঐকমত্য কমিশন বলছে, যে সব বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো একই মত পোষণ করবে সেই সব সংস্কারগুলো আগামী সংসদে পাশ করতে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে থেকে প্রতিশ্রুতি নেয়া হবে।
‘যিনিই ক্ষমতায় যাবেন বাধ্যতামূলকভাবে তার প্রতিশ্রুতি দিতে হবে। তাদের বাধ্যবাধকতা তৈরি করতে হবে যাতে তারা ক্ষমতায় গেলে যেন বিষয়গুলো বাস্তবায়ন করেন’, বলেন কমিশনের সহসভাপতি আলী রীয়াজ।
আপনার মতামত লিখুন :