স্বপ্ন ছিল বিচারকের আসনে বসে অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াবেন, ন্যায়ের সেবা করবেন। ছিলেন সাহসী, দৃঢ়চেতা, অবিচল এক তরুণ- জোবায়ের ওমর। নিজে হারিয়ে গেছেন ঠিকই, রেখে গেছেন শত প্রাণে বেঁচে থাকার গল্প।
জন্মের ছয় মাস পরেই হারিয়েছেন মা-কে। জীবনে আর কখনো মায়ের কোলে মাথা রাখা হয়নি জোবায়েরের। বড় হয়েছেন বড় বোন মুসফিকা সিফাত ও বাবার ভালোবাসায়।
বাবা জাহাঙ্গীর আহমেদ, পেশায় সুপ্রিম কোর্টের ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল, সন্তানদের মানুষ করেছেন ন্যায়ের পাঠ দিয়ে। তিন সন্তানের মধ্যে সবার ছোট ছিলেন জোবায়ের। পরিবারের সবাইকে আইন ও বিচার ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত। সেই ধারাতেই বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস (বিইউপি)-তে আইন পড়ছিলেন জোবায়ের। তবে তার স্বপ্ন ছিল আরও বড়- বিচারকের আসনে বসে গরিব, নিপীড়িত মানুষের জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা।
ছাত্রজীবন থেকেই অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন জোবায়ের। ২০১৮ সালে নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে হাতে প্ল্যাকার্ড নিয়ে নেতৃত্ব দিয়েছেন বন্ধুদের সঙ্গে।
নির্ভয়ে রাজপথে দাঁড়িয়ে বলতেন, ‘আইন যদি সবাইকে রক্ষা না করে, তাহলে সে আইন নয়—শুধু ক্ষমতার অস্ত্র।’
২০২৪ সালে কোটা সংস্কার দাবিতে দেশব্যাপী ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানেও জোবায়ের ছিলেন সামনে। হল বন্ধ হওয়ার পরও আন্দোলন বন্ধ করেননি। বন্ধুদের নিয়ে রুমে থেকেছেন, বাড়ি থেকে প্রতিদিন মিছিলে গেছেন। বাড়িওয়ালা যখন বললেন, ঝামেলা এড়াতে বাসা ছেড়ে দিতে হবে- তখন মাথা নত না করে বাড়িতে ফিরে এসেও রাজপথ ছাড়েননি।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট সকাল। জোবায়ের বের হয়েছিলেন বাড়ির পাশে এক দোকানে কিছু কিনতে। দোকানদার সাবধান করলেন- ‘আজকে আর যেও না মিছিলে। ঝামেলা হবে।’
জোবায়ের জবাবে বলেছিলেন, ‘আপনি সারাদিনে যত টাকা আয় করবেন, তা আমি দিয়ে দিব। চলেন দেশের জন্য আন্দোলনে যাই।’
এই কথাগুলো আজও কাঁদায় জোবায়েরের বাবা জাহাঙ্গীর আহমেদকে। তিনি বলেন, ‘দেশের প্রসঙ্গে ও ছিল পাহাড়ের মতো। ওর আদর্শ ছিল, মানুষ আর অন্যায়ের মাঝে একটা দেয়াল হয়ে দাঁড়াবে।’
সেদিন ছিল ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি। নাস্তা করে বন্ধুদের সঙ্গে বেরিয়েছিল জোবায়ের। দুপুর নাগাদ যাত্রাবাড়ী থানার কাছে পৌঁছালে তাদের উপর পুলিশ ও রাজনৈতিক সন্ত্রাসীদের হামলা হয়।
জোবায়ের তখন একজন বন্ধুকে বাঁচাতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হন। কবির হোসেন নামের এক রিকশাচালক তাকে উদ্ধার করে অলিগলি পেরিয়ে সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। পরে তার বন্ধুরা সেখানে এসে পৌঁছায়। কিন্তু ততক্ষণে ডাক্তাররা ঘোষণা দেন- জোবায়ের আর বেঁচে নেই।
সেদিন বিকেলে সারা দেশে বিজয়ের গান চলছিল, পতাকা ওড়ানো হচ্ছিল। আর সিদ্ধিরগঞ্জের দক্ষিণ কদমতলীর এক বাড়িতে কান্নার শব্দে স্তব্ধ হয়ে যাচ্ছিল সময়। জোবায়েরের মরদেহ তখনো পরিবারের কাছে পৌঁছায়নি।
পরিস্থিতি অনিরাপদ থাকায় সিদ্ধান্ত হয়, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা থানার সৈয়দাবাদ গ্রামে, জোবায়েরের দাদার কবরস্থানে দাফন করা হবে। পরদিন সৈয়দাবাদ মাদ্রাসা মাঠে তাকে শেষ শ্রদ্ধা জানিয়ে কবর দেওয়া হয়।
এই বছরের শহীদদের স্মরণে আয়োজিত একটি ইফতার মাহফিলে, জোবায়েরের বাবা জাহাঙ্গীর আহমেদের কাছে এসে দাঁড়ায় বিইউপির ছাত্র আসিফ। ভেজা গলায় বলেন, ‘আঙ্কেল, আমি বেঁচে আছি ভাইয়ের জন্য। ছাত্রলীগের ছেলেরা একদিন আমাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছিল। ভাই কৌশলে ও সাহসে আমাকে সেখান থেকে বের করে এনেছিল। ভাই আমাকে বাঁচাল, কিন্তু ভাই আজ নাই।’
জোবায়েরের বড় বোন মুসফিকা সিফাত, বিচার বিভাগের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন। প্রিয় ভাইয়ের কথা স্মরণ করে বলেন, ‘ভাইয়া তো কখনও মায়ের ভালোবাসা পায়নি। এখন আমিও ভাইয়াকে ছাড়া সব কিছু বিষাদময় মনে হয়। রাতে খেতে বসলে মনে হয়, ভাইয়াকে বলি- ‘জানো ভাইয়া, তোমার সাথে আমার কত কথা জমে আছে…’ তোমার চলে যাওয়াটা এখনো বিশ্বাস হয় না।’
জোবায়েরের বন্ধুরা বলেন, ‘আমাদের ভার্সিটি যখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অবরোধে, নির্যাতনে ধুঁকছিল- তখন সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছে জোবায়ের। ও ছিল আমাদের ‘বীর নায়ক’। গায়ে রক্ত লাগলেও পিছু হটেনি। ওর কোনো ভিডিও নেই, কিন্তু ওর সাহসিকতা ইতিহাস হয়ে গেছে।’
আজ জোবায়ের নেই, কিন্তু রাস্তার দেয়ালে দেয়ালে লেখা হয়েছে তার নামে গ্রাফিতি। তার স্বপ্ন, তার আদর্শ এখন নতুন প্রজন্মের আলো। হয়তো বিচারকের আসনে বসে দেশের সেবা করা হলো না তার, কিন্তু সে নিজের জীবন দিয়ে বিচারহীনতার বিরুদ্ধে রায় দিয়ে গেল।