বাংলাদেশে স্বর্ণের বাজারে আবারও বড় ধরনের মূল্যবৃদ্ধি হয়েছে। মাত্র দু’দিন আগেই দাম বাড়ার পর, সোমবার (৭ সেপ্টেম্বর) রাতে বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতি (বাজুস) নতুন করে স্বর্ণের দাম বাড়ানোর ঘোষণা দেয়। এতে দেশের ইতিহাসে স্বর্ণের দাম পৌঁছেছে সর্বোচ্চ পর্যায়ে। নতুন দাম মঙ্গলবার (৮ সেপ্টেম্বর) থেকে কার্যকর হবে।
বাজুস-এর বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, ‘স্থানীয় বাজারে তেজাবি স্বর্ণের (পিওর গোল্ড) মূল্য বৃদ্ধির কারণে সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নতুন মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে। নতুন দামে ২২ ক্যারেটের প্রতি ভরি (১১.৬৬৪ গ্রাম) স্বর্ণের দাম ২ হাজার ৭১৮ টাকা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৮১ হাজার ৫৫০ টাকা।’
কেন বাড়ছে দাম?
বিশ্ববাজারে স্বর্ণের মূল্যবৃদ্ধির পেছনে রয়েছে একাধিক কারণ। ভূ-রাজনৈতিক অস্থিরতা, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা, আমদানি শুল্ক বৃদ্ধি এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্য নিয়ে অনিশ্চয়তা- সব মিলিয়ে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে স্বর্ণের প্রতি আগ্রহ বেড়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, অর্থনৈতিক সংকট, যুদ্ধ বা বৈশ্বিক অনিশ্চয়তার সময়ে বিনিয়োগকারীরা সাধারণত শেয়ারবাজার বা বন্ডের পরিবর্তে স্বর্ণকে বেশি নিরাপদ মনে করেন। কারণ, স্বর্ণের দাম তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল থাকে।
অস্ট্রেলিয়াভিত্তিক কেসিএম ট্রেডের প্রধান বাজার বিশ্লেষক টিম ওয়াটারার বলেন, ‘আর্থিক বাজার সবচেয়ে বেশি ভয় পায় অনিশ্চয়তাকে। তাই অনিশ্চিত সময়ে বিনিয়োগকারীদের প্রথম পছন্দ হয়ে ওঠে স্বর্ণ।’
এছাড়াও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুল্কনীতি এবং ‘লিবারেশন ডে’ শুল্ক আরোপ বিশ্ববাজারে অস্থিরতা তৈরি করেছে। এর ফলে বৈশ্বিক বাণিজ্যের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগ বেড়েছে এবং স্বর্ণের প্রতি ঝোঁক আরও বেড়েছে।
একই সঙ্গে, ফেডারেল রিজার্ভকে সুদের হার কমাতে চাপ দেওয়াও স্বর্ণের মূল্যবৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখছে। ডলার দুর্বল হলে, বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য সোনা আরও আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে, কারণ তাদের মুদ্রায় তুলনামূলকভাবে বেশি স্বর্ণ কেনা সম্ভব হয়।
বিশ্বজুড়ে স্বর্ণের চাহিদা বাড়ছে
শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, ইউরোপ ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশেও স্বর্ণের চাহিদা বেড়েছে। যুক্তরাজ্য ও জাপানের অর্থনীতি দুর্বল হয়ে পড়ায় পাউন্ড ও ইয়েনের মান কমেছে। তুরস্ক ও মিশরের মতো দেশগুলোতেও মুদ্রাস্ফীতি থেকে রক্ষা পেতে সাধারণ মানুষ স্বর্ণে বিনিয়োগ করছে।
বিশ্বের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর মধ্যেও এখন স্বর্ণ মজুদের প্রবণতা বেড়েছে। ট্রাম্প প্রশাসনের নীতির ফলে ডলারের ওপর আস্থা কমে যাওয়ায় অনেক দেশ ট্রেজারি বন্ডের পরিবর্তে স্বর্ণকে বেছে নিচ্ছে। গত তিন বছরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো সম্মিলিতভাবে ১,০০০ টনের বেশি সোনা কিনেছে। এর মধ্যে পোল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংক একাই ৯০ টন স্বর্ণ কিনেছে।
সামনে আরও দাম বাড়তে পারে
ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিলের প্রধান বাজার কৌশলবিদ জো কাভাতোনি বলেন, ‘বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতির কারণে মানুষ নিজেদের অর্থ ব্যবস্থাপনার বিষয়ে শঙ্কিত। নিরাপদ বিনিয়োগের মাধ্যম হিসেবে সোনার দিকে ঝুঁকছে। এ কারণে স্বর্ণের দাম আরও বাড়তে পারে।’
তিনি আরও বলেন, ‘ট্রাম্প যেভাবে শুল্ক আরোপ করছেন, তাতে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বজুড়েই মূল্যস্ফীতি বাড়তে পারে। আর এটিই মানুষকে সোনার দিকে আকৃষ্ট করছে।’
ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিলের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর সারা বিশ্বে মোট ৪,৯৭৪ টন স্বর্ণ বেচাকেনা হয়েছে। মানুষ এখন স্বর্ণের বার এবং সোনাভিত্তিক এক্সচেঞ্জ ট্রেডেড ফান্ডে (ইটিএফ) বিনিয়োগও বাড়াচ্ছে।
বাংলাদেশে দাম বাড়ার কারণ
বাংলাদেশে স্বর্ণের দাম বাড়ার পেছনে অন্যতম প্রধান কারণ হলো আন্তর্জাতিক বাজারে স্বর্ণের মূল্যবৃদ্ধি। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ, গাজা সংকট, যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কনীতি এবং বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা বিশ্ববাজারে স্বর্ণের চাহিদা বাড়িয়ে দিয়েছে, যার প্রভাব পড়ছে বাংলাদেশেও।
বাংলাদেশে স্বর্ণ আমদানি করতে হয় বৈদেশিক মুদ্রায়, বিশেষ করে মার্কিন ডলারে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে ডলারের বিপরীতে টাকার মান অনেক কমে গেছে। টাকার অবমূল্যায়ন এবং ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় স্বর্ণ আমদানির খরচ বেড়েছে, যার ফলে স্থানীয় বাজারে স্বর্ণের দামও বেড়ে যাচ্ছে বলে অনেকের ধারণা।
এছাড়া, দেশে এবং বিদেশে মুদ্রাস্ফীতি ও অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাব পড়েছে সাধারণ মানুষের বিনিয়োগ সিদ্ধান্তে। অনেকেই শেয়ারবাজার বা বন্ডের চেয়ে স্বর্ণকে তুলনামূলকভাবে নিরাপদ মনে করে এখন সোনায় বিনিয়োগ করছেন, যা চাহিদা বাড়িয়ে দিচ্ছে।
বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতি (বাজুস) জানিয়েছে, স্থানীয় বাজারে তেজাবি স্বর্ণের দামও বেড়েছে। এইসব কারণে বর্তমানে প্রতি ভরি ২২ ক্যারেট স্বর্ণের দাম ১ লাখ ৮১ হাজার ৫৫০ টাকা হয়েছে, যা দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ।