বিশ্বখ্যাত ব্রিটিশ গণমাধ্যম ফিন্যান্সিয়াল টাইমস (এফটি) সম্প্রতি প্রকাশিত এক তথ্যচিত্রে দাবি করা হয়েছে, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ১৫ বছরের শাসনামলে বাংলাদেশ থেকে প্রায় ২৩৪ বিলিয়ন ডলার (বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ২৮ লাখ ৫৪ হাজার ৮০০ কোটি টাকা) পাচার হয়েছে।
গতকাল (১১ সেপ্টেম্বর) ‘বাংলাদেশ’স মিসিং বিলিয়নস, স্টোলেন ইন প্লেইন সাইট’ শিরোনামের এই অনুসন্ধানচিত্রে তুলে ধরা হয়েছে, কীভাবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা, ব্যাংক খাত, রাজনৈতিক প্রভাব এবং অনানুষ্ঠানিক লেনদেন ব্যবস্থার অপব্যবহারের মাধ্যমে বিশাল অঙ্কের অর্থ বিদেশে পাচার করা হয়।
এ ছাড়াও এই টাকা কীভাবে দেশ থেকে বের করে নেওয়া হয়েছিল এবং তা ফেরত আনা আদৌ সম্ভব কি না এ নিয়ে ফিন্যান্সিয়াল টাইমস বিক্ষোভকারী, রাজনীতিক, ব্যবসায়ী ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলেছে।
তথ্যচিত্রে লন্ডনের হোয়াইট চ্যাপেল স্টেশন দেখিয়ে বলা হয়, স্টেশনটি থেকে বেরোলেই সাইনবোর্ডে লেখা দেখা যায় ‘ওয়েলকাম টু হোয়াইট চ্যাপেল’, কথাটি ইংরেজির পাশাপাশি বাংলায়ও লেখা।
এতে বোঝা যায়, বাংলাদেশ ও যুক্তরাজ্যের সম্পর্ক কত পুরোনো। যুক্তরাজ্য এখন নির্বাসনে থাকা বা নানা প্রান্তের বাংলাদেশি রাজনীতিকদের জন্য জনপ্রিয় গন্তব্যে পরিণত হয়েছে।
হাসিনার বোন শেখ রেহানা যুক্তরাজ্যের নাগরিক, আর শেখ রেহানার মেয়ে টিউলিপ সিদ্দিক লেবার পার্টির এমপি—কিছুদিন আগেও স্টারমার সরকারের মন্ত্রী ছিলেন। টিউলিপ সিদ্দিকসহ শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার পরিবারের কয়েকজন সদস্যের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ যে দুর্নীতির তদন্ত করছে, তাতে অবকাঠামো প্রকল্প থেকে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে। দুই পরিবারের কয়েকজন সদস্যের বিরুদ্ধে ঢাকায় রাষ্ট্রীয় জমি বেআইনি প্রভাব খাটিয়ে দখলের মামলাও চলছে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে টিউলিপ সিদ্দিককে ঘিরে অনেক প্রশ্ন উঠেছে, যা তার মন্ত্রিত্বের উপযুক্ততা নিয়ে সংশয় তৈরি করেছে।
তথ্যচিত্রে টিউলিপ সিদ্দিকের বিভিন্ন দুর্নীতির অভিযোগ উল্লেখ করা হয়। যেমন টিউলিপ সিদ্দিককে ঘিরে (এফটি) তদন্ত ছিল বড় এক জিগস পাজলের মাত্র একটি টুকরা, যেখানে সাবেক বাংলাদেশি শাসকগোষ্ঠীর ঘনিষ্ঠদের সঙ্গে যুক্ত শত শত সম্পত্তি খতিয়ে দেখা হয়।
এতে সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর কথাও উল্লেখ করা হয়, যিনি যুক্তরাজ্যে ৩০০টির বেশি সম্পত্তির মালিক। যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল ক্রাইম এজেন্সি (এনসিএ) ৩৫০টি সম্পত্তি শনাক্ত করে জব্দ করেছে, যা এফটির খুঁজে পাওয়া ৩০০টির বেশি সম্পত্তির সঙ্গে মিলে যায়। তবে সাইফুজ্জামান চৌধুরী এফটির পাঠানো কোনো প্রশ্নেরই জবাব দেননি।
ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের দক্ষিণ এশিয়া ব্যুরোপ্রধান জন রিড বলেন, ‘আমরা এমন গল্পও শুনেছি, কিছু ব্যাংক পরিচালকদের গোয়েন্দারা অস্ত্রের মুখে তুলে নিয়ে যেত, শেয়ার হস্তান্তরের কাগজে সই করিয়ে পদত্যাগে বাধ্য করত এবং সেই শেয়ার চলে যেত পুরোনো শাসকগোষ্ঠীর ঘনিষ্ঠদের হাতে।’
তথ্যচিত্রে বলা হয়, ব্যাংক দখলের প্রভাব বোঝার ভালো উপায় হলো খেলাপি ঋণের হার দেখা, বিশেষ করে দখলের পর। যেমন ইসলামী ব্যাংকের ক্ষেত্রে দখলের পর খেলাপি ঋণের হার আরও বেড়ে যায়। এতে এস আলম গ্রুপের নামও উল্লেখ করা হয়।
সুজ্যানা স্যাভিজ বলেন, এস আলম গ্রুপের মালিক সাইফুল আলমকে বাংলাদেশে ধনকুবের বলা যায়। অন্তর্বর্তী সরকারের অনুমান অনুযায়ী, এস আলম ও তার গ্রুপ বাংলাদেশ থেকে প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলার, এমনকি তার চেয়েও বেশি অর্থ পাচার করেছে।
তবে এফটিকে এস আলম গ্রুপ জানিয়েছে, এসব অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা। তারা আরও দাবি করেছে, বাংলাদেশে তাদের ব্যাংকগুলোর ওপর অন্তর্বর্তী সরকারের আরোপিত বিধিনিষেধের কারণে তারা ক্ষতিগ্রস্ত।
এরপর তথ্যচিত্রে টাকা পাচারের নানা পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করা হয়। যেমন:
ওভার ইনভয়েসিং— আমদানির দামের চেয়ে বেশি দাম কাগজে দেখিয়ে টাকা পাঠানো।
আন্ডার ইনভয়েসিং— বিদেশে রপ্তানির আয় কম দেখিয়ে বাকি টাকা ফেরত না আনা।
অনানুষ্ঠানিক চ্যানেল— হুন্ডি বা হাওলা, যা বৈধ রেমিট্যান্সের ক্ষেত্রেও ব্যবহার হয়, আবার অবৈধ অর্থ পাচার সাফ করতেও ব্যবহৃত হয়।
বাংলাদেশের পুঁজি বিদেশে নেওয়ার ওপর নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমতি ছাড়া ব্যক্তিগতভাবে বছরে ১২ হাজার ডলারের বেশি বাইরে নেওয়া যায় না।
বাংলাদেশে দেখা গেছে, ব্যাংক ঋণ মঞ্জুর হলে সবাই নিজের অংশ নিয়ে নেয়, ঋণ ফেরত দেওয়া হয় না। এরপর সেই ঋণের অর্থ পাচারে হুন্ডি নেটওয়ার্ক ব্যবহার করা হয়।
তথ্যচিত্রে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘এক হিসাবে দেখা গেছে, ব্যাংকিং খাত ও ব্যবসায়িক খাত মিলিয়ে মোট ২৩৪ বিলিয়ন ডলার লুটপাট হয়েছে বিভিন্ন উপায়ে, যা সম্ভবত কোনো দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় অর্থ লুণ্ঠন।’