প্রধান উপদেষ্টার উপস্থিতিতে ঐকমত্য কমিশনের সংলাপেও জুলাই সনদ বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছতে পারেনি রাজনৈতিক দলগুলো। এখনো রাজনৈতিক দলগুলো নিজ নিজ অবস্থানে অনড়। যুক্ত হচ্ছে নতুন শর্তও। বারবার বৈঠকে বসেও পৌঁছানো যাচ্ছে না সিদ্ধান্তে। গতকাল প্রধান উপদেষ্টার উপস্থিতিতেও ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে তেমন কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। অনৈক্যের বিষয়গুলো হাতে রেখেই ঐকমত্য কমিশনের মেয়াদ আরও এক মাস বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। এদিকে নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে আসলেও বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে আসতে পারছে না জুলাই সনদ। এই পর্যায়ে ঐকমত্যের ভিত্তি ক্রমেই জটিল আকার ধারণ করতে পারে, এমন আশঙ্কা তীব্র হচ্ছে জনমনে।
জুলাই সনদের ভিত্তিতে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবি জানিয়েছে জামায়াতে ইসলামী। সনদ বাস্তবায়নে আগের মতোই অস্থায়ী সাংবিধানিক আদেশ অথবা গণভোটের কথা বলেছে দলটি। জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) আবারও গণপরিষদ নির্বাচনের দাবি জানিয়েছে। আর বিএনপি ও তাদের সমমনা দলগুলো সংবিধানসংক্রান্ত সংস্কার আগামী সংসদের ওপর দায়িত্ব দেওয়ার প্রস্তাবে অনড় রয়েছে। তবে বিএনপি এও বলছে, অতিরিক্ত বা বিশেষ সাংবিধানিক আদেশের মাধ্যমে সনদ বাস্তবায়ন করা যায় কি না, সে বিষয়ে সর্বোচ্চ আদালতের মতামত নেওয়া যেতে পারে।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সভাপতি ও প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, “আগামী ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠেয় ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে একটি ‘মহোৎসবের নির্বাচন’। নির্বাচনের মধ্য দিয়েই জাতির সত্যিকারের নবজন্ম হবে। এত ত্যাগ তখনই সার্থক হবে, যদি আমরা সেই নবজন্ম অর্জন করতে পারি। এ জন্য জুলাই সনদের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোকে সমঝোতায় পৌঁছতে হবে।”
প্রধান উপদেষ্টা আশা প্রকাশ করেন, ‘ঐকমত্য কমিশনের কাজ বিশ্বব্যাপী নজির হয়ে থাকবে। এটি যেন খুঁতওয়ালা নজির না হয়, এটা আমার আবেদন। এমন নজির সারা বিশ্ব দেখবে এবং অনুসরণ করার চেষ্টা করবে। আপনারা মূল কাজটি সম্পন্ন করেছেন। এখন সামান্য পথ বাকি। সবকিছু নির্ভর করছে শেষ অংশটুকুর ওপর।’
রাজনীতিবিদদের উদ্দেশে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘আপনারা দীর্ঘ পথ অতিক্রম করেছেন। বাকি রাস্তাটুকু যাতে সুন্দরভাবে সমাপ্ত করে পৃথিবীর জন্য নজির সৃষ্টি করতে পারেন।’
ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে বিএনপি বলছে, সংস্কার, বিচার এবং নির্বাচন কোনোভাবেই একটি আরেকটির ওপর সম্পর্কিত নয়। সংস্কার সংস্কারের মতো চলবে, এটি কনটিনিউ প্রসেস।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেছেন, এর মধ্যে কিছু কিছু বিষয়ে ‘‘নোট অব ডিসেন্ট’সহ আমরা একমত হয়েছি। আমাদের বিবেচনায় ৭০ অনুচ্ছেদের চারটি বিষয়ে এমপিদের স্বাধীনতা না থাকলে ভালো হয়। সর্বনিম্ন দুটি বিষয়ে সবাই একমত হয়েছে। নোট অব ডিসেন্টের কথা উল্লেখ করে সনদ তৈরি হচ্ছে এবং সেভাবে আমরা স্বাক্ষর করব। যারা জনগণের ম্যান্ডেট পাবে, তারা তাদের নোট অব ডিসেন্ট রক্ষা করে বাস্তবায়ন করবে। এটি কোনো জটিল বিষয় নয়।”
দুই-তিনটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছাড়া বাকিগুলো খুবই সাধারণ বিষয় উল্লেখ করে বিএনপির এই নেতা বলেন, ‘এগুলো বাস্তবায়ন খুব সহজ। কিন্তু ফোরাম কোনটা? সাংবিধানিক বিষয়গুলো পরবর্তী সংসদ ছাড়া অন্য কোনো ফোরাম করতে পারে কি না? এ ব্যাপারে আইনি পরামর্শ দিতে পারেন সুপ্রিম কোর্ট। আমরা সেখানে যেতে পারি এবং সহায়তা নিতে পারি। এর বাইরে কিছু থাকলে জানান, আমরা একমত। আমরা সনদে স্বাক্ষর করতে প্রস্তুত আছি, তা আগেও বলেছি।’
সালাহউদ্দিন বলেন, ‘আমরা কম্প্রোমাইজ করব। আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে কোনো পন্থা বের করতে পারলে তাতে একমত হব। প্রস্তুত করা চূড়ান্ত জুলাই সনদে ক্লারিক্যাল মিসটেক এবং কিছুটা বিভ্রান্তি আছে। এটা আমরা কারেকশন করে দেব, এটা মেজর কিছু নয়। তবে এটি জাতীয় দলিল, রাজনৈতিক সমঝোতার দলিল, ঐতিহাসিক দলিল হবে, সে জন্য এটা নির্ভুল হওয়া বাঞ্ছনীয়। যেসব বিষয় আলোচিত হয়নি, সেগুলো এতে অন্তর্ভুক্ত করা ঠিক হবে না। আমরা বলেছি, আইনি ভিত্তি নিয়ে আলোচনা হলে তাতে আমরা অংশ নেব। সেই আলোচনা শুরু হয়েছে। তার আগে কমিশন বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়েছে। সেখান থেকে অঙ্গীকারনামার যে ড্রাফট দেওয়া হয়েছে, তাতে আমরা লিখিত মতামত দিয়েছি। যেসব বিষয় পরে টিকবে না, সেগুলো এতে উত্থাপন করা ঠিক হবে না।’ তিনি বলেন, ‘কোনো আদালতে প্রশ্ন তোলা যাবে না, তেমন কোনো দলিল হতে পারে না, সংবিধানের ওপর সনদকে স্থান দেওয়া গ্রহণযোগ্য নয়। এর বাইরেও অনেক পন্থা থাকতে পারে, যাতে আমরা এটার বৈধতা দিতে, আইনি ভিত্তি দিতে পারি। আপিল বিভাগের পরামর্শ নিতে পারি আমরা, এটি এক্সট্রা কনস্টিটিউশনাল অর্ডার বা স্পেশাল কনস্টিটিউশনাল অর্ডার করা যায় কি না। তাহলে ভবিষ্যতে আদালতে এটা চ্যালেঞ্জ করলেও বলতে পারবে আমরা মতামত নিয়েছিলাম। এখন সেই পরামর্শ আপনারা দিতে পারেন, নাও পারেন।’
জামায়াতে ইসলামী বলছে, জুলাই সনদের ভিত্তিতে আগামী নির্বাচন হলেই তা সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য হবে বলে মনে করেন জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ। দলের পক্ষ থেকে সনদ বাস্তবায়নের দুটি উপায়ের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, একটি হলো প্রভিশনাল কনস্টিটিউশনাল অর্ডার। অতীতে এটার নজির আছে। আরেকটি হলো গণভোট। এটার ইতিহাসও দেশে আছে। দলগুলো একমত হতে না পারলে গণভোটের মাধ্যমে মানুষ রায় দেবে।
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা বিশ্বাস করতে চাই, প্রধান উপদেষ্টার ঘোষণা অনুযায়ী আগামী নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি হবে। আগামী নির্বাচন যেন সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও নিরপেক্ষ একটি প্রশাসনব্যবস্থার মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠিত হয়। তাহলেই আমাদের আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়ন হবে। এ জন্য আমরা বলতে চাই, আজকে যে সংস্কারের মধ্য দিয়ে জাতীয় সনদ হতে যাচ্ছে, এটির একটি সমাপ্তি সুন্দরভাবে হোক।’
এনসিপি বলছে, কমিশনের মেয়াদ আরও বাড়ানোর আহ্বান জানিয়ে এনসিপি সদস্যসচিব আখতার হোসেন বলেন, ‘আমরা মনে করি, একটি গণপরিষদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে নতুন সংবিধান ও নতুনভাবে লিখিত ধারা-উপধারা ও অনুচ্ছেদের মধ্য দিয়ে যে সংশোধনী ও সংস্কার প্রস্তাবে একমত হয়েছি, সেগুলো টেকসইভাবে বাস্তবায়ন করা সম্ভব। সে ক্ষেত্রে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোকে ঐকমত্যে পৌঁছাতে হবে।’
ইসলামী আন্দোলন বলছে, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মাদ রেজাউল করীম বলেন, ‘সামগ্রিকভাবে প্রতীয়মান হচ্ছে, জুলাইয়ের আত্মত্যাগ ম্রিয়মাণ হতে চলছে। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ এটা হতে দিতে পারে না। জুলাইয়ে হাসিনার বিরুদ্ধে যে সাহসিকতা ও ঝুঁকি নিয়ে নেমেছিলাম, সেই প্রতিজ্ঞায় আবারও মাঠে অবস্থান নেবে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। আমাদের দাবি সুস্পষ্ট। আমরা জুলাই সনদের বাস্তবায়ন চাই, এর আইনি ভিত্তি চাই। দ্রুততার সঙ্গে ফ্যাসিবাদের বিচার নিশ্চিত করতে চাই। ফ্যাসিবাদের দোসরদের রাজনীতিতে পুনর্বাসন বন্ধ করতে চাই। পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন চাই। আমাদের অবস্থান কোনো দলের বিরুদ্ধে না। জুলাই অভ্যুত্থানের রক্ত ও জীবনের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকেই আমাদের এই অবস্থান।’
উল্লেখ্য, জুলাই সনদ প্রণয়নে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গত ১২ ফেব্রুয়ারি গঠিত জাতীয় ঐকমত্য কমিশন ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে কার্যক্রম শুরু করে। ছয় মাস মেয়াদ শেষে কমিশনের মেয়াদ আরও এক মাস বাড়ানো হয়। ১৫ সেপ্টেম্বর কমিশনের মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা।