বাংলাদেশের পরিসংখ্যান ব্যবস্থাকে বিশ্বমানের পর্যায়ে উন্নীত করতে সাহসী ও বাস্তবসম্মত সংস্কারের প্রস্তাব দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যুরো অব স্ট্যাটিস্টিকস (বিবিএস) সংস্কারের জন্য গঠিত স্বাধীন টাস্কফোর্স।
সোমবার (১৫ সেপ্টেম্বর) পরিকল্পনা উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদের কাছে টাস্কফোর্সের খসড়া সুপারিশ প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়। এ সময় টাস্কফোর্সের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. হোসেন জিল্লুর রহমানসহ অন্য সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।
টাস্কফোর্সের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, বিবিএসের নাম পরিবর্তন করে ‘পরিসংখ্যান বাংলাদেশ’ (স্ট্যাটবিডি) রাখা হবে।
একই সঙ্গে এর প্রধানের পদ উন্নীত করে ‘চিফ স্ট্যাটিসটিশিয়ান’ করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, যা হবে বিশেষ স্কেলের একটি মর্যাদাপূর্ণ পদ। এ প্রস্তাবকে সদস্যরা আখ্যা দিয়েছেন স্বাধীনতা ও পেশাদারিত্বের নতুন যুগের সূচক হিসেবে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, একটি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন সাত সদস্যবিশিষ্ট কাউন্সিল গঠন করা হবে, যার নাম হবে ‘ট্রাস্ট অ্যান্ড ট্রান্সপারেন্সি কাউন্সিল অব স্ট্যাটিস্টিকস’। এই কাউন্সিল প্রাতিষ্ঠানিক তত্ত্বাবধান করবে, বার্ষিক কর্মক্ষমতা ও ব্যয় নিরীক্ষা পর্যালোচনা করবে এবং প্রধান পরিসংখ্যানবিদ নিয়োগ প্রক্রিয়া তদারকি করবে। কাউন্সিলের নেতৃত্ব দেবেন পরিকল্পনা উপদেষ্টা।
টাস্কফোর্স সুপারিশ করেছে, ২০১৩ সালের পরিসংখ্যান আইন সংশোধন করে পরিসংখ্যান বাংলাদেশকে পূর্ণ স্বাধীনতা দিতে হবে। তথ্য যাচাই-বাছাই ও প্রকাশের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের প্রশাসনিক বা রাজনৈতিক প্রভাব যাতে না পড়ে, সে বিষয়ে আইনি সুরক্ষা নিশ্চিত করার আহ্বান জানানো হয়েছে।
প্রতিষ্ঠানটির অভ্যন্তরীণ কাঠামোগত দুর্বলতা কাটাতে আটটি উইং থেকে ১৬টি উইংয়ে সম্প্রসারণের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি উপজেলা পর্যায়ে ৪৩৭টি নতুন পদ সৃষ্টি করে মাঠপর্যায়ে তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ জোরদারের কথা বলা হয়েছে। দীর্ঘদিনের ক্যাডার ও নন-ক্যাডার দ্বন্দ্ব নিরসনে এনক্যাডারমেন্ট প্রক্রিয়ার মাধ্যমে একটি একক ও পেশাদার ক্যারিয়ার কাঠামো তৈরি করার সুপারিশও এসেছে।
আর্থিক দিক থেকে প্রতিষ্ঠানকে আরও শক্তিশালী করতে বাজেটীয় স্বায়ত্তশাসনের কথা বলা হয়েছে। নিয়মিত জরিপ পরিচালনার জন্য স্থায়ী রাজস্ব তহবিল গঠন এবং জরুরি ভিত্তিতে ৫০ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
সাধারণ জনগণের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হলো মূল্যস্ফীতির পরিসংখ্যান।
বাজারদরের সঙ্গে সরকারি হিসাবের ফারাক নিয়ে জনমনে প্রশ্ন থাকায় রিপোর্টে বলা হয়েছে, তথ্য সংগ্রহের উৎস, কোন কোন বাজার থেকে তথ্য নেওয়া হচ্ছে, কোন কোন পণ্য অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে এবং কীভাবে মূল্যস্ফীতি নির্ধারণ করা হচ্ছে—এসব বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করতে হবে। প্রাকঘোষিত ক্যালেন্ডার অনুযায়ী সব ব্যবহারকারীর জন্য একই সঙ্গে তথ্য প্রকাশ, পদ্ধতিগত নোট ও সম্পূর্ণ মেটাডাটা প্রকাশের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
প্রতিবেদনে জনসম্পৃক্ততার ওপরও গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। প্রতিবছর একটি বার্ষিক পরিসংখ্যান সম্মেলনের প্রস্তাব এসেছে, যেখানে নীতিনির্ধারক, গবেষক, নাগরিক সমাজ ও বেসরকারি খাতের প্রতিনিধিদের সঙ্গে পরিসংখ্যানবিদরা মতবিনিময় করবেন। বড় জরিপের জন্য পরামর্শক কমিটি গঠন এবং তরুণ গবেষকদের জন্য ইন্টার্নশিপ সুযোগ তৈরির প্রস্তাব রাখা হয়েছে।
মানবসম্পদ উন্নয়নে একটি আধুনিক প্রশিক্ষণ একাডেমি প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব করা হয়েছে। বিদ্যমান প্রশিক্ষণ কেন্দ্রকে উন্নীত করে পূর্ণাঙ্গ একাডেমি করা হবে, যেখানে নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত, মধ্যম স্তরের কর্মকর্তা এবং উচ্চপদস্থ ব্যবস্থাপকদের জন্য কাঠামোবদ্ধ পাঠক্রম থাকবে। পাশাপাশি একটি ‘পদ্ধতিগত পরামর্শক কাউন্সিল’ গঠন করে জরিপসমূহে মান ও সামঞ্জস্য বজায় রাখার সুপারিশও করা হয়েছে।
অনুষ্ঠানে পরিকল্পনা উপদেষ্টা অধ্যাপক ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ বলেন, একটি দেশের উন্নয়ন কৌশল নির্ধারণে নির্ভরযোগ্য পরিসংখ্যান অপরিহার্য। পরিসংখ্যান যদি প্রশ্নবিদ্ধ হয়, নীতি প্রণয়ন দুর্বল হয়ে পড়ে। এই রিপোর্টের প্রস্তাবনা বাস্তবায়িত হলে আমাদের পরিসংখ্যান ব্যবস্থায় যুগান্তকারী পরিবর্তন আসবে। অভ্যন্তরীণভাবে আস্থা বাড়বে, আন্তর্জাতিক পরিসরেও বাংলাদেশের পরিসংখ্যান গ্রহণযোগ্যতা পাবে।
সভাপতির বক্তব্যে হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, আমরা সাহসী, সময়োপযোগী ও বাস্তবসম্মত সংস্কার প্যাকেজ জমা দিয়েছি। এখানে কোনো প্রকার আমলাতান্ত্রিক টেলরিং নেই। আমরা চাই দ্রুত সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের জন্য একটি বিশেষ টাস্ক টিম গঠিত হোক, যেখানে শুধু আমলাতান্ত্রিক প্রতিনিধিই নয়, স্বাধীন বিশেষজ্ঞরাও থাকবেন।
টাস্কফোর্সের সদস্যরা জানিয়েছেন, এই রিপোর্ট প্রণয়নের ক্ষেত্রে তারা বিবিএস, এসআইডি এবং পরিকল্পনা কমিশনের বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তা ছাড়াও গণমাধ্যম ও ব্যবহারকারীদের মতামত নিয়েছেন।
এটি আপাতত একটি খসড়া রিপোর্ট। সংশ্লিষ্ট পক্ষের মতামত নিয়ে এটিকে চূড়ান্ত রূপ দেওয়া হবে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, সুপারিশগুলো বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশের পরিসংখ্যান ব্যবস্থা বিশ্বমানের মানদণ্ডে উন্নীত হবে, যা সরকারের নীতি প্রণয়ন, জনগণের আস্থা এবং আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি—সবকিছুকেই শক্তিশালী করবে।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন