দেশের সড়ক যেন এক নীরব হত্যার মঞ্চ, গত ১২ বছরে যার পরিসংখ্যান ছুঁয়েছে ভয়ংকর মাত্রা। এ সময়ে ৬৭ হাজার ৮৯০টি দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ১ লাখ ১৬ হাজার ৭২৬ জন, আহত হয়েছেন ১ লাখ ৬৫ হাজার ২১ জন। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি সতর্ক করে বলছে, সরকারের দুর্নীতি, নীতিগত ব্যর্থতা এবং পরিবহন খাতের নৈরাজ্যই এই ভয়াবহ পরিস্থিতির মূল কারণ।
মঙ্গলবার (২১ অক্টোবর) রাজধানীর ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির (ডিআরইউ) সাগর-রুনি মিলনায়তনে জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস-২০২৫ উপলক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনটির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী এই তথ্য প্রকাশ করেন।
তিনি সতর্ক করে বলেন, ‘যদি কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়া হয়, তবে সড়কে মৃত্যুর এই ভয়াবহ ধারা থামানো যাবে না এবং প্রতিটি পথযাত্রা ঝুঁকির মধ্যে পড়বে।’
১২ বছরের দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির পরিসংখ্যান
সংগঠনটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সড়কে মৃত্যুর ধারা ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী:
- ২০১৪: ৫,২৮৮ দুর্ঘটনা, নিহত ৮,৪৮৯, আহত ১৭,৪২৪
- ২০১৫: ৬,৫৮০ দুর্ঘটনা, নিহত ৮,৬৩২, আহত ২৩,৫৫৫
- ২০১৬: ৪,৩১২ দুর্ঘটনা, নিহত ৭,০৬৪
- ২০১৭: ৪,৮১৯ দুর্ঘটনা, নিহত ৭,৩১৭
- ২০১৮: ৫,২২৫ দুর্ঘটনা, নিহত ৯,২২১
- ২০১৯: ৫,৫১৪ দুর্ঘটনা, নিহত ৭,৫৫৫
- ২০২০: ৪,৮৭৫ দুর্ঘটনা, নিহত ৬,৮৬৬
- ২০২১: ৫,৬২৫ দুর্ঘটনা, নিহত ৭,৮৩১
- ২০২২: ৬,৮৩৩ দুর্ঘটনা, নিহত ৯,৯২১
- ২০২৩: ৬,২৬৬ দুর্ঘটনা, নিহত ৭,৯২২
- ২০২৪: ৬,৩৭১ দুর্ঘটনা, নিহত ৮,৩৪৩
- ২০২৫ (জানুয়ারি–সেপ্টেম্বর): ৫,১৭১ দুর্ঘটনা, নিহত ৬,০২৩, আহত ১১,৭৬৪
প্রতিবেদনটি আরও সতর্ক করে জানাচ্ছে, চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুর হার যদি গড়ে আরও ১৫ শতাংশ ধরা হয়, তবে প্রকৃত মৃত্যুর সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে যাবে।
মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, স্বাধীনতার আগে দেশের ৮০ শতাংশ মানুষ নৌ ও রেলপথে চলাচল করত। তখন সড়ক দুর্ঘটনা সীমিত ছিল। কিন্তু স্বাধীনতার পর দাতা সংস্থার শর্তে একের পর এক সড়ক নির্মাণ ও সংস্কারের নামে দুর্নীতি ও বেহিসেবি লুটপাট হয়েছে। সমন্বিত পরিবহনব্যবস্থা না গড়ে সড়ককে ৮০ শতাংশ মানুষের যাতায়াতের প্রধান মাধ্যম বানানোর কারণে দুর্ঘটনার হার আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে গেছে।
তিনি অভিযোগ করেন, সরকারি নীতি ও সড়ক পরিবহন খাতে সীমাহীন অনিয়ম-দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, ফিটনেসবিহীন যানবাহনের চলাচল, লাইসেন্সবিহীন ও অপ্রাপ্তবয়স্ক চালকের হাতে গাড়ি তুলে দেওয়া, বেপরোয়া গতি, ত্রুটিপূর্ণ সড়ক ব্যবস্থা এবং চালকদের মাদক গ্রহণের কারণে সড়কে নৈরাজ্য চরমে পৌঁছেছে। দুর্নীতিবাজ পুলিশ কর্মকর্তাদের চাঁদাবাজিও সড়ক ব্যবস্থায় বিভীষিকা ডেকে এনেছে।
মহাসচিব আরও বলেন, দেশের বিভিন্ন খাতে উন্নয়ন হলেও নিরাপদ ও সাশ্রয়ী নৌ ও রেলপথের ব্যবহার কমে যাওয়ায় সড়ক সম্প্রসারণের ওপর পুরো পরিবহন ব্যবস্থা নির্ভরশীল হয়েছে। পথচারীদের জন্য হাঁটার উপযোগী অবকাঠামো না থাকার কারণে মানুষের যাতায়াত ঝুঁকিপূর্ণ।
তিনি উল্লেখ করেন, ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা, রাইডশেয়ারিং মোটরসাইকেল, সিএনজিচালিত অটোরিকশা, স্থানীয় নসিমন-করিমন এবং বিদেশি মাহিন্দ্রা-পিয়াজিও, পিকআপভ্যান ‘লেগুনা’ বানিয়ে যাত্রী পরিবহন করায় সড়ক যোগাযোগে নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে সরকার।
সরকারের ব্যর্থতা ও নীতিগত চ্যালেঞ্জ: মহাসচিব জানান, দীর্ঘ সময় সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা ওবায়দুল কাদের কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনায় ব্যর্থ হয়েছেন। বর্তমান সরকারের নীতি অপরিবর্তিত থাকায় দুর্ঘটনার লাগাম টানা সম্ভব হয়নি। অবকাঠামোগত সমস্যা প্রতিদিন নতুনভাবে প্রাণহানি ডেকে আনছে।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে না আনলে যানজট, দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি কমানো সম্ভব নয়। পরিবহন নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠানসমূহে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত না হলে কোনো দৃশ্যমান উন্নয়ন সম্ভব নয়।
সংগঠনটি ঢাকাসহ প্রতিটি বিভাগীয় শহরে সরকারি উদ্যোগে পাতাল মেট্রোরেল চালু এবং ডিজিটাল লেনদেন ভিত্তিক অন্তত দুটি বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) লেন চালুর দাবি জানিয়েছে। এতে সড়কে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি কমবে, মানুষের যাতায়াত সহজ হবে এবং দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে।
১২ দফা সুপারিশ
- নৌ ও রেলপথ পুনরুদ্ধার করে সড়কের সঙ্গে সমন্বিত যাতায়াত নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা।
- পরিবহন খাতে চাঁদাবাজি ও দুর্নীতি বন্ধ করা।
- ঢাকা-চট্টগ্রামসহ বিভাগীয় শহরে সরকারি উদ্যোগে পাতাল মেট্রোরেল চালু করা।
- ডিজিটাল লেনদেন ভিত্তিক অন্তত দুটি বিআরটি লেন চালু করা।
- জেলা থেকে উপজেলা পর্যায়ে মানসম্পন্ন বাস নেটওয়ার্ক উন্নয়ন।
- মোটরসাইকেল, ব্যাটারি ও সিএনজিচালিত অটোরিকশা নিয়ন্ত্রণ করা।
- রাষ্ট্রীয় খরচে চালকদের উন্নত প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করা।
- ট্রাফিক ব্যবস্থাপনাকে ডিজিটাল করে ট্রাফিক ট্রেনিং একাডেমি গড়ে তোলা।
- সড়ক দুর্ঘটনার মামলা সরকারি উদ্যোগে আমলে নিয়ে হতাহতদের ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করা।
- পরিবহন সেক্টরে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ফোরামে যাত্রী প্রতিনিধি ও ভুক্তভোগীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা।
- সড়ক সেক্টরে আইনের সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও কর্মকর্তাদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা।
- সারা দেশে সাইক্লিস্ট ও পথচারীদের জন্য পৃথক লেন ও নিরাপদ ফুটপাতের ব্যবস্থা করা।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন