বাংলাদেশের রাজনীতিতে অস্থিরতা আছে প্রতিটি বৈধ রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডসম্পন্ন দলের নিজেদের সাংগঠনিক ভিত্তিকে মাঠে আরও শক্তিশালী করা নিয়ে। সামনে নির্বাচন। সবাই সেদিকে মন রেখেছে। ঠিক এমন সময় অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দৃশ্যপট হলো জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) চীন সফর। অতি নবীন এই রাজনৈতিক দলের সাংগঠনিক ভিত্তি পুরো প্রস্তুত না হলেও, এই দলের প্রতিটি শীর্ষ নেতা দেশজুড়ে খ্যাতিমান জুলাইয়ের মহা আন্দোলনে তাদের সাহসী ভূমিকায়। সবাই জানি, তারই ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি প্রতিষ্ঠিত এনসিপি ।
এনসিপির চীন সফরের পেছনে যে রাজনৈতিক কৌশল রয়েছে, সেটি বোঝা গুরুত্বপূর্ণ। এটিকে শুধু একটি নিরেট কূটনৈতিক কর্মকাণ্ড মনে করার কোনো কারণ নেই। এর সাথে দেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা এবং অব্যাহতভাবে আন্তর্জাতিক অস্থির রাজনীতি এবং জটিল বাণিজ্য প্রতিযোগিতামূলক পরিস্থিতির গভীর ইঙ্গিত বুঝতে হবে।
আজকের বাংলাদেশ শুধু একটি অভ্যন্তরীণ রাজনীতির টানাপোড়েনে সীমাবদ্ধ নেই; দেশটি এখন আন্তর্জাতিক ভূরাজনৈতিক লড়াইয়ের কেন্দ্রবিন্দুতে ঢুকে পড়েছে। এখানে যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ভারত এবং অন্যান্য শক্তিগুলোর নিজের স্বার্থে নানাভাবে খেলছে। প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছে। এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের নবীন রাজনৈতিক দল এনসিপির চীন সফর কেবল কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের প্রচেষ্টা নয়, বরং ভবিষ্যতের রাজনৈতিক এবং ভূরাজনৈতিক সম্পর্ক বিস্তারের একটি সিগন্যাল।
ধারণা করা হচ্ছে, এনসিপি নেতাদের এই সফরটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক দৃশ্যপটে এক নতুন রাজনৈতিক ভূমির নতুন আকৃতি সৃষ্টি করতে পারে, যা দেশের ভেতরের রাজনীতির সাথে বাহ্যিক প্রভাবকে নতুনভাবে সংযুক্ত করার ইঙ্গিতবহও বটে। একইসাথে প্রশ্ন উত্থাপিত হতেই পারে, এই সফর কি কেবলই কূটনৈতিক ভারসাম্যহীনতার ইঙ্গিত দিচ্ছে, নাকি বাংলাদেশের রাজনৈতিক কাঠামোয় নতুন একটি অক্ষ তৈরি করতে সক্ষম হবে?
যদি এনসিপির জন্ম এবং তার রাজনৈতিক চরিত্র পর্যালোচনা করা হয়, তবে বোঝা যায়, দলের এই সফরের পেছনে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য কাজ করছে। কেননা, সবাই ধারণা করে, এনসিপি আসলে ড. ইউনূসের রাজনৈতিক প্রভাব ছায়ায় গড়ে উঠেছে। দলটির বিষয়ে এও বলা হয়, এটি আমেরিকার কূটনৈতিক ছায়াতলে রয়েছে। আন্তর্জাতিক মঞ্চে এই দলের উপস্থিতি এবং বিদেশি উন্নয়ন সংস্থাগুলোর সাথে তাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক এমন ধারণাকে আরও শক্তিশালী করেছে। এনসিপি নামক দলটির সাথে আন্তর্জাতিক যোগাযোগ পষ্ট হলেও বাংলাদেশের ভূমিতে তাদের গণভিত্তি এখন অনেকটাই ম্লান। মাঠে তাদের সাথে জনতার উপস্থিতি কম।
জুলাই এর পর কেন এমন হলো, সে উত্তর তারাই হিসাব করবেন যদি বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভূমিতে শিকড় মজবুত করতে প্রত্যয়ী হন। তবে, এই দ্বৈত বাস্তবতার মধ্যেই এনসিপি নেতাদের চীন সফর নতুন প্রশ্নের জ্বালামুখ সামনে, আমেরিকার ছায়াতলে জন্ম নেওয়া দলটি কি এবার নতুনভাবে চীনের দিকে ঝুঁকছে? যদি সত্যিই তারা চীনের দিকে অগ্রসর হয়, তাহলে তাদের আন্তর্জাতিক অবস্থান কি পরিবর্তিত হবে বা হচ্ছে? কেননা, এই ইন্দোপ্যাসিফিক অঞ্চলে চীন এবং আমেরিকার প্রতিযোগিতা অতি তীব্র।
এনসিপির চীন সফরের মধ্যে মূলত দুটি রাজনৈতিক বার্তা রয়েছে। একটি হলো, চীন সফরের মধ্য দিয়ে তারা আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে নিজেদের অবস্থান প্রতিষ্ঠা করতে চায়। এটি তাদের বৈশ্বিক মর্যাদা বৃদ্ধি করার একটি পদক্ষেপ, যেখানে তারা চীনের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করতে চাইছে। এটি তাদের রাজনৈতিক শক্তির একটি কৌশলগত বর্ধিতকরণ হতে পারে, যেখানে তারা চীনের কাছে নিজেদের গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক অংশীদার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সুযোগ নেবে। চীনা রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েনের উপস্থিতিতে ঢাকাস্থ চীনা দূতাবাসের আয়োজন করা অনুষ্ঠানটি একটি বড় সিগন্যাল দেয় যে চীন এই তরুণ নেতাদের গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে বিবেচনা করছে।
সেইসাথে আমেরিকা এবং ভারতের দৃশ্যমান এবং অদৃশ্যমান রাজনৈতিক খেলার মাঠে এনসিপি কি চীনকে একটি নতুন রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে স্বিকৃতি দিচ্ছে? যদি তাই হয়, তাহলে এটি বাংলাদেশের জন্য বড় রাজনৈতিক পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিতে পারে। তবে, প্রসঙ্গত, বাংলাদেশে বন্ধু নির্বাচনে চীন কখনো একপেশে কৌশল নেয়নি। বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের সাথে সম্পর্ক বজায় রেখেছে, সেখানে এনসিপি’র প্রতি চীনের নতুন আগ্রহ রাজনৈতিক কৌশলের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ বৈকী। বাংলাদেশে চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতায় চীনের দিক থেকে এটি ভবিষ্যতের রাজনৈতিক শক্তির সম্ভাবনা সৃষ্টির পুঁজি বিনিয়োগ।
কেন চীন এমন রাজনৈতিক বিনিয়োগে পা ফেললে? মূলত ইন্দোপ্যাসিফিক অঞ্চলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তীব্র আগ্রহের ফলে, যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের মধ্যে চলমান ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা আরও জটিল এখন। যুক্তরাষ্ট্র মুক্তবাজার অর্থনীতি এবং মানবাধিকারকে সামনে রেখে বিশ্বব্যাপী প্রভাব বিস্তার করতে চায়, তবে চীন অবকাঠামো বিনিয়োগ ও দীর্ঘমেয়াদি সম্পর্কের মাধ্যমে সামগ্রিকভাবে বিশ্বব্যাপী নিজের অবস্থান শক্তিশালী করতে চায়। এমন পরিস্থিতিতে, এনসিপি যদি চীনের দিকে ঝুঁকতে শুরু করে, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে সেটিকে একটি বড় ধরনের সতর্কবার্তা হিসেবে বিবেচনা করার কথা।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক মাটিতে বহির্বিশ্বের শক্তিশালী দেশগুলোর কর্মকাণ্ড একপাশে সরিয়ে রেখে সম্ভবত চীন চাইছে এনসিপির নেতাদের পরিপক্ব করে তুলতে। কেননা, লক্ষ্য করা যাচ্ছে, রাজনীতির মাঠে তাদের কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক ভাষার প্রয়োগ অতি দুর্বল। সেখানে দাবা খেলার বোর্ডে আগামী দিনের ঘোড়া, কিস্তি আর মন্ত্রী হিসেবে চীন চায় তাদের রাজনৈতিক ভাষাশৈলী এবং কৌশলে পারদর্শী করতে। এমন উদ্যোগে চীন সফর তাদের জন্য যেমন আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জনের, ঠিক তেমনি করে চারদিকে দেখে ও শুনে একটি প্রশিক্ষণ লাভও। এটি তো সত্য, নিজ দেশের জমির সীমানার বাইরে না বেরুলে চোখ ফুটে না।
এনসিপির নেতাদের চোখ ফোটাতে চীনের এই আয়োজন অন্য শক্তিশালী দেশগুলো সুনজরে নাও দেখতে পারে। এখানেই এনসিটির জন্য সতর্ক বার্তা। মনে রাখা দরকার, কূটনীতি একটি অতি জটিল ও সংবেদনশীল খেলা। আপাত দৃষ্টিতে যা মনে হবে আমার হাতের মুঠোয় সব, কিংবা আমাকে পরম যত্নে নরম বিছানায় আয়েশ করতে বিশেষ ব্যবস্থা প্রস্তুত; তাই হয় তো কখনো বদলে গিয়ে গিলোটিনে পরিণত হয়। সে কারণে বলার, যেই বাংলাদেশে এনসিপির শুরুর দোস্তালি আমেরিকার ছায়ার সাথে, সেই মধুরতা বদলে যেন এমন দিকে গড়িয়ে চীনের ড্রাগন কক্ষে দুধের বাটির সামনে বসিয়ে না দেয়, যা কি না চপস্টিক দিয়ে খেতে লাস্যময়ী ললনারা অনুরোধ করবে।
যাইহোক, এসব কিছু দেখে মনে হচ্ছে, এখানে শিগগিরই নতুন কূটনৈতিক অক্ষ জটিল করে জন্ম নেবে এবং আন্তর্জাতিক কূটনীতির টাট্টুঘোড়ায় চেপে নতুন এক রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি হতেও পারে। তা যেমনটাই ঘটুক, চীন এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বাণিজ্য সম্পর্কের প্রবল দ্বন্দ্বের সূত্রে বাংলাদেশের ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ক্রমান্বয়ে এনসিপির বিকাশ ঘটবে একটি নতুন রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে। সেই অগ্রগতির স্থায়িত্ব ধরে রাখতে এনসিপির এখন দরকার দেশের জনগণের আস্থা অর্জন এবং অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাকে দৃঢ়তা দিতে সহায়তা করা।
এ জন্য এটিও বলা দরকার, এখানে ভৌগোলিক কারণে ভারতের অবস্থানও গুরুত্বপূর্ণ। ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক কেবল সীমান্ত নিরাপত্তা, পানি বণ্টন এবং নির্বাচনি ফলের উপরে নয়, বরং বৃহত্তর ভূরাজনৈতিক সম্পর্কের অংশ এবং নিজ ভূখণ্ডের অখণ্ডতার হিসাব ভারত বিবেচনা করে। সুতরাং এনসিপি ভারতবিরোধী মনোভাব প্রকাশ করলেও, ভারতের ভূরাজনৈতিক কৌশল বাদ দিয়ে অনেক দূর এগিয়ে যেতে অতি তীব্রভাবে একটি বৃহত্তর কৌশলগত ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে। কেননা, অস্বীকার করার উপায় নাই আগামী পাঁচ বছর পর ভারতের অর্থনীতি দানবীয় আকার নেবে। এ কারণেই ভারত সরাসরি এবং তার বাণিজ্য সহযোগী উন্নত দেশ দ্বারা বাংলাদেশের মাটিতে প্রভাব বিস্তার করতে চাইবেই।
এই জটিল সমীকরণে যদিও চীন সফরের মাধ্যমে এনসিপি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিজেদের প্রাসঙ্গিকতা প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে। তবে তাদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির শক্তি এখনো প্রশ্নবিদ্ধ। আগামী দিনের বাংলাদেশে রাজনীতি হবে চতুর্মুখি প্রতিযোগিতার—একদিকে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের বলয়, অন্যদিকে ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক শক্তি বিএনপি, তৃতীয় শক্তি হিসেবে উদীয়মান এনসিপি এবং দেশের মাটিতে আবারও নৌকা চালাতে সদা তৎপর আওয়ামী লীগ।
এনসিপির চীন সফরকে শুধু সৌজন্য সফর হিসেবে দেখা হলে, তা বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতাকে সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করা যাবে না। নিঃসন্দেহে এই সফর কেবল একটি কূটনৈতিক রঙের না হয়ে দেশের অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির ভবিষ্যৎ পরিবর্তনের সূচক হয়ে উঠতে পারে। এনসিপি এই সফরের মাধ্যমে তিনটি প্রধান স্তরে বার্তা দিয়েছে।
প্রথমত, এনসিপি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি চায় এবং চীন সফরের মাধ্যমে তারা নিজেদের একটি প্রভাবশালী কূটনৈতিক শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করছে।
দ্বিতীয়ত, রাজনৈতিকভাবে, এনসিপি দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে তাদের প্রাসঙ্গিকতা প্রতিষ্ঠা করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। রাজনৈতিক অস্থিরতায় ভরা বাংলাদেশে নতুন একটি প্ল্যাটফর্ম তৈরিতে যদিও তাদের জনসমর্থন এখনো সীমিত, তবুও চীন সফরের মাধ্যমে তারা নিজেদের রাজনৈতিক অবস্থান দৃঢ় করার সুযোগ পেতে পারে।
তৃতীয়ত, ভূরাজনৈতিকভাবে বাংলাদেশ এখন যুক্তরাষ্ট্র, চীন এবং ভারতের মধ্যে একটি প্রতিদ্বন্দ্বী প্রভাব বলয়ের মধ্যে অবস্থান করছে। এই চীন সফরের মাধ্যমে এনসিপির শীর্ষ নেতারা তাদের কূটনৈতিক কৌশলকে আরও সুচিন্তিতভাবে পরিচালনা করে রাজনৈতিক অবস্থান দৃঢ় করার চেষ্টা করবে বলেই ধারণা করি।
লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক, কবি ও কথাসাহিত্যিক
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন