আগামী সংসদ নির্বাচনের রোডম্যাপ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিরাজ করছে চরম উত্তেজনা। এরই মধ্যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ঘোষণা দিয়েছেন, আগামী ২০২৬ সালের এপ্রিলের প্রথমার্ধে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। তার এই রোডম্যাপ ঘোষণার পরও কাটেনি সংকট। কিছু রাজনৈতিক দল এই রোডম্যাপকে স্বাগত জানালেও বিএনপিসহ অধিকাংশ দলই এই ঘোষণাকে নাকচ করে কড়া প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে।
তারা বলছে, বিএনপিসহ ৩০টির বেশি দল চলতি বছরের ডিসেম্বরেই নির্বাচন চেয়েছিল। সেনাপ্রধানও সম্প্রতি তার এক বক্তব্যে ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন শেষ করার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। এ প্রেক্ষাপটে এপ্রিলে নির্বাচন মোটেও যৌক্তিক সিদ্ধান্ত নয়।
এদিকে এপ্রিলে নির্বাচন হলে কী কী সমস্যা হতে পারে তাও সামনে তুলে আনছেন দলগুলোর শীর্ষ নেতারা। তাদের ভাষ্য, এপ্রিল মাসে বিরূপ আবহাওয়া থাকে। এ ছাড়াও ফেব্রুয়ারি-মার্চে রোজা ও এসএসসি, এপ্রিলে সম্ভাব্য এইচএসসি পরীক্ষা হওয়ায় জাতীয় নির্বাচনের জনসংযোগ কঠিন হবে। বাস্তবতার নিরিখেও এপ্রিলে নির্বাচন আয়োজন সম্ভব নয় বলে ধারণা রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সাধারণ মানুষের। ফলে এপ্রিলে আদৌ নির্বাচন হবে কি না তা নিয়ে শঙ্কিত তারা।
নির্বাচন বিশ্লেষকেরা বলছেন, এসব বিবেচনায় জাতীয় নির্বাচন দুই-তিন মাস আগে-পরে হতেই পারে। তবে সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে কিছুটা ছাড় দিতে হবে রাজনৈতিক দল বা সরকারকে। অন্যদিকে আগামী শুক্রবার লন্ডনে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। সেই বৈঠকে নির্বাচন নিয়ে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত আসতে পারে বলে আশাবাদী রাজনৈতিক নেতা ও বিশ্লেষকরা।
গত কয়েক মাস থেকেই বিএনপি, জামায়াতসহ রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণার দাবি জানিয়ে আসছে। সম্প্রতি সংস্কার, নির্বাচন ও বিচার ইস্যুতে জাতীয় ঐকমত্য তৈরির জন্য দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সিরিজ বৈঠক করেছেন প্রধান উপদেষ্টা। সেই বৈঠকেও বিএনপিসহ বেশির ভাগ দল চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবি জানিয়েছে। তবে জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে জানানো হয়, ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিলের মধ্যে নির্বাচন হলে তারা তেমন আপত্তি করবে না।
অন্যদিকে, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) প্রস্তাব দিয়েছে, প্রথমে রাষ্ট্রীয় সংস্কার, শেখ হাসিনার বিচার ও তার ফাঁসির রায় কার্যকর করতে হবে। এ ছাড়াও জুলাই সনদ প্রকাশের পরেই সংসদ নির্বাচন দেওয়া যেতে পারে।
রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে এই সিরিজ বৈঠক চলমান থাকা অবস্থায়ই গত শুক্রবার জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা জানিয়েছেন, আগামী জাতীয় নির্বাচন ২০২৬ সালের এপ্রিলের প্রথমার্ধের যেকোনো দিন অনুষ্ঠিত হবে। এই ঘোষণার ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশন উপযুক্ত সময়ে আপনাদের কাছে নির্বাচনের বিস্তারিত রোডম্যাপ প্রদান করবে। আমরা এমন নির্বাচন চাই যা দেখে অভ্যুত্থানের শহিদদের আত্মা শান্তি পাবে। আমরা চাই আগামী নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি ভোটার, সবচেয়ে বেশি প্রার্থী ও দল অংশ নিক। এটা সবচেয়ে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হিসেবে জাতির কাছে স্মরণীয় হয়ে থাকুক।
তার এই ভাষণের পর রাজনীতির মাঠে তৈরি হয়েছে নয়া মেরূকরণ। জামায়াত, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, এবি পার্টিসহ কিছু রাজনৈতিক দল এই ঘোষণাকে ইতিবাচকভাবে দেখলেও তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে বিএনপি, গণঅধিকার পরিষদ, সিপিবি, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টিসহ অধিকাংশ দল। তাদের ভাষ্য, নির্বাচন নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার এই রোডম্যাপ জনআকাঙ্খার প্রতিফলন হয়নি। এই সময়ে নির্বাচন হলে নানা সংকটের কথাও তুলে ধরছেন তারা।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্যও বলছে, এই সময়ে নির্বাচনের জন্য উপযুক্ত নয়। কারণ মার্চ থেকে বজ্রপাতের মৌসুম শুরু হলেও এপ্রিলে হয় শক্তিশালী। এপ্রিলে গড়ে সাড়ে ছয় লাখ বজ্রপাত হয়। গড়ে মৃত্যু হয় ১৬ জনের। বজ্রঝড় বা কালবৈশাখীর পাশাপাশি এপ্রিলে বৃষ্টিও বাড়ে। এ মাসে সিলেটে গড়ে ১৬ দিন আর ঢাকায় ১২ দিন বৃষ্টি হয়।
এপ্রিলে আরও এক সংকট তাপপ্রবাহ। ২০২৪ সালের এপ্রিল-মে মাসে টানা ৩৫ দিন তাপপ্রবাহের মধ্য দিয়ে গেছে দেশ। তখন তাপমাত্রা ৩৬ থেকে ৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত ওঠে। এ ছাড়াও এই সময়টিই দেশের পাবলিক পরীক্ষার মৌসুম বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট সূত্র। ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিলের মধ্যে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। ফেব্রুয়ারি ও মার্চ মাঝে রমজান, ঈদুল ফিতরও ভোটের প্রচার ও প্রস্তুতিতে বড় বাধা দেখছেন বিশ্লেষকরা।
এদিকে প্রধান উপদেষ্টার এ ঘোষণায় সন্তোষ প্রকাশ করে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির শফিকুর রহমান বলেন, প্রধান উপদেষ্টার ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ২০২৬ সালের এপ্রিলের প্রথমার্ধের যেকোনো একটি দিনে অনুষ্ঠিত হবে বলে জানিয়েছেন। তার এই ঘোষণায় জাতি আশ্বস্ত হয়েছে। ঘোষিত সময়ের মধ্যেই তিনি একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন বলে জাতি আশা প্রকাশ করছে।
এনসিপির সদস্যসচিব আখতার হোসেন বলেন, ‘আমরা প্রত্যাশা করেছিলাম, জুলাই সনদ ও জুলাই ঘোষণাপত্রের আনুষ্ঠানিকতা শেষে নির্বাচনের সময়সীমা নিয়ে সুনির্দিষ্ট বক্তব্য আসবে। তারপরও যদি ঘোষিত সময়সীমার মধ্যেই এসব বাস্তবায়নে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়, তাহলে আমাদের কোনো আপত্তি নেই।
তবে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান বলেন, এপ্রিল মাস প্রচণ্ড গরমের মাস। বাংলায় এই সময় চৈত্র মাস। চৈত্র মানেই চৌচির করা মাঠ-ঘাট, কাঠফাটা রোদ্দুর, প্রচণ্ড গরম। চৈত্রের দাবদাহে জীবন হয়ে পড়ে অতিষ্ঠ। চৈত্র মাসে প্রচণ্ড গরমের মধ্যে নির্বাচন আয়োজন করার আগ্রহ কেন তাদের? এখানে কি ভিন্ন কোনো উদ্দেশ্য আছে? তারা কি এমন কিছু দেখাতে চায় যে, ভোটারশূন্য নির্বাচন?
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, প্রধান উপদেষ্টার ভাষণে জাতীয় নির্বাচনের তারিখ সম্পর্কে অধিকাংশ রাজনৈতিক দল ও জনগণের মতামত ও আকাঙ্খারি প্রতিফলন ঘটেনি; বাস্তবে নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ সম্পর্কে জনদাবি উপেক্ষিতই হয়েছে। তিনি বলেন, ডিসেম্বরে কেন জাতীয় নির্বাচন করা যাবে না, ভাষণে তার যেমন সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা নেই, তেমনি জাতীয় নির্বাচন কেন আগামী বছরের এপ্রিলে নিতে হবে তারও গ্রহণযোগ্য ও যুক্তিগ্রাহ্য কোনো কারণ উল্লেখ নেই।
পরিস্থিতি বিবেচনায় আগামী বছরের এপ্রিলে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আয়োজন কোনোভাবেই সম্ভব নয় বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেছেন, আগামী ডিসেম্বরের মধ্যেই জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনের ব্যবস্থা নিতে হবে।
সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, বাংলাদেশের পরিবেশ পরিস্থিতি, আবহাওয়া, পরীক্ষা ও রমজান; এসব বিবেচনায় কোনোমতেই সেই সময়টা জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য উপযুক্ত নয়। ওই সময়টাকে দেশে পাবলিক পরীক্ষা থাকে, কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নির্বাচনি কাজে ব্যবহার করা যাবে না। পরীক্ষা চলাকালীন কোনো নির্বাচনি প্রচার করা যাবে না, সেটা যৌক্তিক। নির্বাচনি তপশিল ঘোষণার পর যেহেতু ৪৫ দিন সময় থাকে, রমজানের অর্ধেক সময় চলে যাবে; তাই নির্বাচন আয়োজন অসম্ভব ব্যাপার।
এপ্রিলে নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এই দ্বিধাবিভক্তির মধ্যে আগামী শুক্রবার সকালে লন্ডনে প্রধান উপদেষ্টা ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের মধ্যে বৈঠকে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত আসতে পারে বলে আশাবাদী রাজনৈতিক নেতাদের পাশাপাশি রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সাধারণ মানুষরা। শুক্রবার কী সিদ্ধান্ত আসবে সে নিয়ে অধির আগ্রহে সবাই।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম গতকাল মঙ্গলবার বলেছেন, আমি খুবই ইতিবাচক মানুষ এবং আমি সবসময়ে পজেটিভ দিকটাই দেখতে চাই, ব্রাইট দিকটা দেখতে চাই। আমি মনে করি এই একটা সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে অনেক সুযোগ তৈরি হতে পারে। সেই সুযোগগুলো তৈরি করার সুযোগ এসেছে আমাদের এই দুই নেতার। দিস ইজ এ প্রোপার টাইম, প্রোপার ভেন্যু, প্রোপার প্লেস যেটাতে নতুন একটা দিগন্তের উন্মোচন হতে পারে আর কি।
সার্বিক বিষয় নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কাজী মাহবুবুর রহমান রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, নির্বাচন নিয়ে সংকট দূর করতে হলে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সরকারের আরও নিবিড় আলোচনা প্রয়োজন। আলোচনা ছাড়া এই সংকট দূর হবে না। যাদের জন্য নির্বাচন আয়োজন করা হচ্ছে তারা যদি কমফোর্ট ফিল না করে তাহলে নির্বাচন দিয়ে কি হবে?
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক শামসুল আলম সেলিম রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক একধরনের অবিশ্বাসের তৈরি হয়েছে। সরকারের কিছু সংখ্যক উপদেষ্টার কর্মকাণ্ড আস্থাহীনতা তৈরি করেছে। আর বাস্তবতার নিরিখে বিচার করলে এপ্রিল নির্বাচনের জন্য যথাযথ নয়। অনেকে মনে করছে, এপ্রিলে এমনিতেই রোডম্যাপ দেওয়া হয়েছে। নানাবিধ কারণে এটা আরও পিছিয়ে যেতে পারে।
লন্ডনের প্রধান উপদেষ্টা ও তারেক রহমানের বৈঠক আশার আলো দেখাচ্ছে মন্তব্য করে এই রাজনৈতিক বিশ্লেষক আরও বলেন, এই দুই নেতার সামনা-সামনি বৈঠক ভালো ফল নিয়ে আসতে পারে। এই বৈঠক থেকে বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য টার্নিং পয়েন্ট হতে পারে।
আপনার মতামত লিখুন :