চট্টগ্রামে কোনোভাবেই থামানো যাচ্ছে না রোগী কিংবা মরদেহবাহী অ্যাম্বুলেন্সের দৌরাত্ম্য। নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে যে যার মতো ভাড়া হাঁকাচ্ছেন। একই গন্তব্যে কেউ ৫ হাজার টাকা ভাড়া হাঁকালে অন্য চালক ভাড়া চাইছেন ৪ কিংবা সাড়ে ৩ হাজার টাকা। এতে চরম ভোগান্তিতে পড়ছেন রোগী ও মৃতের স্বজনেরা।
জানা গেছে, এসি কিংবা নন-এসি অ্যাম্বুলেন্সের চালকভেদে ভাড়ার হেরফের দেড় থেকে দুই হাজার টাকা, আবার গন্তব্যভেদে কোনো কোনো পার্থক্য হয় আড়াই থেকে তিন হাজার টাকা। শুধু রোগীর ক্ষেত্রেই নয়, অ্যাম্বুলেন্স মালিক সমিতির সিরিয়াল মেনে চলা মরদেহ পরিবহনের ক্ষেত্রে এমন ভোগান্তিতে পড়তে হয় মৃতের স্বজনদেরও। একই টেবিলে সিরিয়াল দেওয়া মালিক সমিতির নিজস্ব লোকজনের কাছেও মরদেহ পরিবহনে ভাড়া হেরফের চোখে পড়ার মতো।
মরদেহের জন্য অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করতে গেলে প্রথমে আকাশচুম্বি ভাড়া হাঁকান তারাও। কাস্টমার বুঝে মাছবাজারের মতো দরদাম করেন ভাড়ার। ১০ হাজার টাকা চাওয়া ভাড়া মিনিট দশেকের দরকষাকষিতে নেমে আসে ৪ থেকে ৫ হাজার টাকায়। ‘কাঁধে’ লাশ কিংবা হাসপাতালে মুমূর্ষ অবস্থায় রোগী রেখে অ্যাম্বুলেন্সের ভাড়া নিয়ে যারা দরকষাকষি করতে চান না, তাদের মাথায় ‘টুপি’ পরান সিন্টিকেটের সদস্যরা। ভাড়া রাখেন ইচ্ছেমতো।
অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ই নয়, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতাল ঘিরে গড়ে ওঠা এই সিন্ডিকেট বাইরের কোনো অ্যাম্বুলেন্সকে রোগী কিংবা মরদেহ পরিবহন করতে দেন না। এতে অতিরিক্ত ভাড়া দেওয়া ছাড়া কোনো উপায় থাকে না রোগীর স্বজনদের।
বছরের পর বছর ধরে ভাড়া দৌরাত্ম্যের এমন নৈরাজ্য চলে এলেও কার্যত কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না চমেক, বিআরটিএ, সিটি করপোরেশন কিংবা চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ। অ্যাম্বুলেন্সের ভাড়া নিয়ে ভোগান্তিতে পড়া রোগীর স্বজনদের দাবি, অ্যাম্বুলেন্সের এই ভোগান্তি রোগীদের ওপর ‘মড়ার উপর খঁড়ার ঘা’য়ের মতো। এলাকাভিত্তিক কিংবা কিলোমিটারভিত্তিক ভাড়া নির্দিষ্ট করা না হলে এই ভোগান্তির শেষ হবে না, দাবি স্বজনদের।
সরেজমিনে চমেক হাসপাতালের সামনে গড়ে ওঠা অ্যাম্বুলেন্স স্টেশনে রোগী ও মৃতের স্বজন সেজে কথা বলে জানা গেছে, চমেক থেকে চন্দ্রঘোনা কিংবা রাঙ্গুনীয়া এলাকার কোনো কোনো অ্যাম্বুলেন্স (এসি) চালক প্রথমে চান ৬ থেকে ৭ হাজার টাকা। দরকষাকষি করলে এই ভাড়া নেমে আসে ৩ থেকে সাড়ে ৩ হাজারে। সীতাকুণ্ড ও মিরসরাই এলাকায় রোগী পরিবহনের জন্য ভাড়া চান ৭ হাজার টাকা। দরকষাকষিতে সেই ভাড়া নেমে আসে ৩ হাজার টাকায়। চট্টগ্রামের পটিয়া এলাকায় ভাড়া চাওয়া হয় ৪ হাজার টাকা। একই গন্তব্যে ২ হাজার টাকায়ও অ্যাম্বুলেন্স পাওয়া যায়।
গতকাল মঙ্গলবার চমেকের সামনে থেকে দুই দিনের জন্য রাউজানে একটি মৃতদেহ পরিবহনে অ্যাম্বুলেন্স মালিক সমিতি ভাড়া নির্ধারণ করে ১৫ হাজার টাকা। একই সময়ে অন্য এক গন্তব্যে মৃতদেহ নেওয়ার জন্য প্রথমে চাওয়া হয় ৯ হাজার টাকা। দরকষাকষি করে সেই ভাড়া চূড়ান্ত হয় ৬ হাজার টাকায়।
১৫ হাজার টাকায় ভাড়া চূড়ান্ত করা রাউজানের ওই মরদেহের স্বজন এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘বাইরের একটি অ্যাম্বুলেন্স আমাদের কাছে ১২ হাজার টাকা চেয়েছিল। কিন্তু বাইরের কোনো অ্যাম্বুলেন্স চট্টগ্রাম মেডিকেলে কলেজের কোনো রোগী বা মরদেহ পরিবহন করতে পারে না বিধায় মালিক সমিতির দাবি করা ১৫ হাজার টাকা ভাড়া দিতেই বাধ্য হয়েছি।’
একই অভিযোগ করেছেন শামিম নামে আরও এক রোগীর স্বজন। তিনি বলেন, ‘আমার কাছে প্রথমে ১০ হাজার টাকা চাওয়া হয়েছিল। পরে অনেক অনুরোধ করে ৭ হাজার টাকায় রাজি করিয়েছি।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চমেক হাসপাতালের সামনে গড়ে ওঠা স্টেশনে ৩৫০ থেকে ৩৬০টি অ্যাম্বুলেন্স রয়েছে। এই অ্যাম্বুলেন্সগুলো পরিচালিত হয় মালিক সমিতির ব্যানারে। মৃতদেহ পরিবহন করতে হলে মালিক সমিতির কাছ থেকে সিরিয়াল নিতে হয়। ভাড়া চূড়ান্ত করেন সমিতির নিজস্ব লোকজন। রোগী পরিবহনে সিরিয়াল নিতে হয় না। ভাড়া নির্ধারণ করেন অ্যাম্বুলেন্সের চালকেরাই। এ ছাড়া অ্যাম্বুলেন্স মালিকদের রয়েছে নিজস্ব দালাল সিন্ডিকেট। চমেক হাসপাতালের ওয়ার্ড ঘুরে ঘুরে অ্যাম্বুলেন্স পরিবহনের জন্য কাস্টমার ঠিক করেন তারা। বিনিময়ে পান কমিশন।
অ্যাম্বুলেন্সের ভাড়া নির্ধারণের বিষয়ে কথা বলতে বারবার কল করা হলেও মুঠোফোন রিসিভ করেননি বিআরটিএ চট্টগ্রাম কার্যালয়ের পরিচালক মাসুদ আলম ও উপপরিচালক সৈয়দ আইনুল হুদা চৌধুরী।
এ বিষয়ে চমেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল তসলিম উদ্দীন জানান, চমেক ঘিরে গড়ে ওঠা অ্যাম্বুলেন্স মালিকদের কোনো তালিকা তাদের কাছে নেই।
এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, আ জ ম নাছির চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) মেয়র থাকাকালীন অ্যাম্বুলেন্স মালিকসহ সবার সঙ্গে বসে প্রতি কিলোমিটারে ভাড়ার একটি তালিকা করা হয়েছিল। সেই তালিকা এখন মানা হচ্ছে না।
ইচ্ছেমতো ভাড়া হাঁকানোর বিষয়ে তিনি বলেন, এমন অনেক অভিযোগ আমিও পেয়েছি। বর্তমান মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেনের সঙ্গে কথা বলে ভাড়া নৈরাজ্য সমাধানের আশ্বাস দেন তিনি।
অ্যাম্বুলেন্সের নির্দিষ্ট কোনো ভাড়ার তালিকা নেই স্বীকার করে চট্টগ্রাম অ্যাম্বুলেন্স মালিক সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক আমান উল্লাহ বলেন, প্রতি কিলোমিটার ভাড়া চূড়ান্তকরণসহ পাঁচ দফা দাবি নিয়ে আমরা সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে গিয়েছি, কিন্তু কোনো সমাধান হয়নি। এটি সমাধানে সমিতির কোনো ভূমিকা নেই দাবি করে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ও চট্টগ্রাম সিটি মেয়রের ওপর দায় চাপান আমান উল্লাহ।
তিনি বলেন, ওনারা যদি দায়িত্ব না নেন, তাহলে ভাড়ার তালিকা তো আমি করতে পারব না।
আপনার মতামত লিখুন :