সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রতিক্রিয়া দেওয়ার শাস্তিমূলক ব্যবস্থার মুখোমুখি হতে হচ্ছে সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের। সরকার বা সরকারের কর্মকর্তা তো বটেই, সরকারের বাইরের কোনো ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা কার্যক্রম নিয়ে প্রতিক্রিয়া প্রদানকারীদের বিরুদ্ধে নেওয়া হচ্ছে দাপ্তরিক ব্যবস্থা।
নিজে পোস্ট করা তো বটেই, তৃতীয় পক্ষের কোনো পোস্টেও কমেন্ট (মন্তব্য) বা রিঅ্যাক্ট (প্রতিক্রিয়া) করা হলেও শাস্তিমূলক ব্যবস্থার মুখোমুখি হতে হচ্ছে কর্মচারীদের। এমন ঘটনায় মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে জনসাধারণের মাঝে।
এক পক্ষ বলছেন, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিধিমোতাবেক উপায়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করা উচিত। অন্য পক্ষের মতে, সরকারি কর্মকর্তা হওয়ার বাইরেও একজন ব্যক্তি তার ব্যক্তিগত মতামত প্রকাশ করতেই পারেন।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব হিসেবে রুটিন দায়িত্ব পালন করছেন অতিরিক্ত সচিব তোফাজ্জেল হোসেন। তাকে পদোন্নতি দিয়ে সচিব করার সুপারিশ করে মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফরিদা আখতার জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব মোখলেস উর রহমানকে আধাসরকারি পত্র বা ডিও লেটার দেন। এ বিষয়ে প্রবাসী সাংবাদিক জুলকারনাইন সায়ের খান সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে এক পোস্ট করেন।
এই পোস্টে ‘রিঅ্যাক্ট’ করার জন্য শো-কজ তথা কারণ দর্শানোর নোটিশ পেয়েছেন মৎস্য অধিদপ্তরের পাঁচ কর্মকর্তা। তারা হলেন মৎস্য অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক এ এস এম সানোয়ার রাসেল, মৎস্য পরিদর্শন ও মাননিয়ন্ত্রণ দপ্তরের জ্যেষ্ঠ সহকারী পরিচালক মো. সালমুন হাসান, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়ার জ্যেষ্ঠ উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা রওনক জাহান, ইলিশসম্পদ উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা প্রকল্পের সহকারী প্রকল্প পরিচালক মো. ফরিদ হোসেন এবং সহকারী প্রধান আবু মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান। কর্মকর্তাদের দেওয়া ‘রিঅ্যাক্ট’-এর স্ক্রিনশটও যুক্ত করা হয় গত ৪ মে কর্মকর্তাদের দেওয়া সেই কারণ দর্শানোর নোটিশে।
ছাত্রনেতা সারজিস আলমের এক পোস্টে কমেন্ট করে চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত হওয়ার পাশাপাশি এখন বিভাগীয় মামলা লড়ছেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক মো. নাজমুল হুদা। গত ১৯ ফেব্রুয়ারি সারজিস আলমের এক পোস্টে নাজমুল হুদা লেখেনÑ ‘আপনারা স্বৈরাচারী সরকারের দোসরদের সচিব বানানোর জন্য ডিও দেন, আবার বড় বড় কথা বলেন।’
এই কমেন্ট করার অপরাধে পরের দিন অর্থাৎ ২০ ফেব্রুয়ারি মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব সৈয়দা সাদিয়া নূরীয়া স্বাক্ষরিত অফিস আদেশে নাজমুল হুদাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। এরপর গত ১৩ মার্চ তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা রুজু করা হয়। সরকারি প্রতিষ্ঠানে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার নির্দেশিকা, ২০১৯-এর ধারা-৭ ও ১০ অনুযায়ী, নাজমুল হুদা ‘অসদাচরণ’ করেছেন বলে তাকে দেওয়া চিঠিতে উল্লেখ করা হয়।
শুধু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমই নয়, গণমাধ্যমে মতপ্রকাশের জেরেও সাময়িক বরখাস্ত হওয়ার নজির রয়েছে। গত ২৯ এপ্রিল দায়িত্ব থেকে সাময়িক বরখাস্ত হন চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের (চবক) যান্ত্রিক বিভাগের জোনাল ওয়ার্কশপ-এবির সিনিয়র অপারেটর মোহাম্মদ ইয়াছিন। তার অপরাধ, এক দিন আগে অর্থাৎ ২৮ এপ্রিল দৈনিক পূর্বকোণে প্রধান উপদেষ্টা বরাবর একটি খোলা চিঠি লিখেছিলেন তিনি।
সরকারি কর্মকর্তাদের এমন কর্মকাণ্ডের জন্য শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার পক্ষে মত দিয়েছেন অনেকেই। জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ মোহাম্মদ ফিরোজ মিয়া রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘একজন ভদ্রলোক যা করতে পারেন না, সেগুলো একজন সরকারি কর্মচারীও করতে পারেন না। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নিয়ে যে নীতিমালা আছে, সেটি তাদের মেনে চলতে হবে। এই নীতিমালার আগেও, ১৯৭৯ থেকে রয়েছে সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা। সেগুলোও তাদের মেনে চলতে হবে। মতপ্রকাশের নামে যেকোনো কিছু করা যাবে না।’
তবে সাধারণ নাগরিকরা বলছেন, মতপ্রকাশকারী কর্মচারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সরকারের একটি পক্ষ অতিউৎসাহী আচরণ করছেন। রাজধানীর মিরপুরের বাসিন্দা ও মানবাধিকারকর্মী কাওসার হোসেন বলেন, দুর্নীতির সুনির্দিষ্ট অভিযোগের পরেও অনেক সরকারি কর্মচারীর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায় না।
অথচ মতপ্রকাশের জন্য সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে এবং খুব দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। মনে হচ্ছে, সরকারের একটি পক্ষ বসে বসে সবার সোশ্যাল মিডিয়া মনিটরিং করছে। সরকারি কর্মকর্তা হওয়ার বাইরেও একজন মানুষের ব্যক্তিগত মতামত থাকবে। আর সোশ্যাল মিডিয়া মানুষের সেই মতামত প্রকাশেরই জায়গা।
পাশাপাশি স্বাধীন মতপ্রকাশে বাধা প্রদানকারী বিধিমালাকে নিপীড়নমূলক মনে করে সেগুলো বাতিল করা উচিত বলে মনে করেন মানবাধিকার এবং গণমাধ্যমকর্মীরা। অনুসন্ধানী সাংবাদিক জুলকারনাইন সায়ের খান রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, কালাকানুন বলে কোনো আইন নাই, যা আছে তা হলো নিপীড়নমূলক আইন।
‘সরকারি প্রতিষ্ঠানে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার নির্দেশিকা ২০১৯’ একটি নিপীড়নমূলক আইন। এই নির্দেশিকা ব্যবহার করে হাসিনা তার শাসনকালে সরকারি কর্মকর্তাদের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করত এবং বর্তমান সময়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার একই ব্যবহার শুরু করেছে। বিষয়টি একই সাথে ভয়ংকর এবং অবশ্যই সরকারের উচিত এই নির্দেশিকা বাতিল করে গণতান্ত্রিক এবং মানবাধিকারবান্ধব আইন প্রণয়ন করা।’
প্রবাসী এই সাংবাদিক আরও বলেন, সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদের চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা এবং বাক্স্বাধীনতার সাথে এবং জনস্বার্থসংশ্লিষ্ট তথ্য প্রকাশ (সুরক্ষা প্রদান) আইন ২০১১-এর ৪ ও ৫ ধারার সাথে (ঐ বিধিমালাগুলো) সরাসরি সাংঘর্ষিক।
এ ছাড়া এই সিদ্ধান্ত তথ্য অধিকার আইন ২০০৯-এর মূলনীতির বিপরীত। ‘রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি’, ‘জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি’, হেয়প্রতিপন্ন করা’ ইত্যাদি শব্দাবলির ব্যাখ্যাও কোনো আইনে নেই, যা দ্বারা জনগণ বুঝতে পারবে যে ঠিক কোন কাজগুলো করলে এসব দোষে দুষ্ট হবে।
আপনার মতামত লিখুন :