টোকেন বাণিজ্যের পুরোনো কৌশল পাল্টেছে সিলেট নগর পুলিশ। আগের পন্থার চেয়ে নতুন পন্থা বেশ অভিনব। আরও নিরাপদ। আগের সরবরাহ করা টোকেন সিএনজি অটোরিকশার গায়ে লাগানো হলেও এখন আর তা করতে হয় না। স্টিকারের মতো চালকের মোবাইল ফোনের পেছনে লাগিয়ে দেওয়া হয়। টহল পুলিশ বা ট্রাফিক পুলিশ গাড়ি আটকালে মোবাইল বের করে পেছন সাইট দেখালেই দ্রুত চলার সিগন্যাল পাওয়া যায়। না হলে আটকে দেওয়া হয়।
এ কৌশলের নাম দেওয়া হয়েছে ‘মোবাইল স্টিকার’! এটি এখন সিলেটে রমরমা। সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশ-এসএমপির ট্রাফিক বিভাগের কিছু অসাধু কর্মকর্তা রয়েছেন এর নেতৃত্বে। মাঠপর্যায়ের ৩ সদস্য দিয়ে তারা টোকেন বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছেন। এরাই নিয়ন্ত্রণ করে এই কর্মকাণ্ড। পতিত সরকারের আমল থেকে এ বাণিজ্য চলে আসছে। টোকেন বাণিজ্য করে এই তিন দালাল রাতারাতি হয়েছে কোটিপতি! আর পুলিশ কর্মকর্তাদের পকেটে তুলে দিয়েছে কাড়ি কাড়ি টাকা!
পরিবহন সেক্টরে সংশ্লিষ্ট এমন একাধিক সূত্র জানায়, ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে এসএমপির অনেক অফিসার বদলি হলেও ‘ফ্যাসিস্ট সরকারের দোসর’ হিসেবে পরিচিত ও চিহ্নিতরা রয়েছেন বহাল তবিয়তে। যাদের মধ্যে পতিত সরকারের একাধিক স্থানীয় এমপির আস্তাভাজন ও বিশ্বস্ত কর্মকর্তাও রয়েছেন। যাদের কারো কারো বাড়ি সিলেটে। যারা নেতাদের পরিচয়ে পুলিশে ক্ষমতা ও প্রভাবের ছড়ি ঘোরাতেন।
ট্রাফিক বিভাগের পুরোনো সেই তারাই সিলেটে টোকেন বাণিজ্য দেখবাল করছেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন টিআই, সার্জেন্ট/টিএসআই, এটিএসআই পদবিধারী কর্মকর্তা। টোকেন হিসেবে স্টিকার বিতরণের মাধ্যমে পুলিশ ও দালালরা প্রতিমাসে সিলেটের সিএনজি অটোরিকশা চালকদের কাছ থেকে তুলছে অর্ধকোটি টাকারও বেশি। যার ভাগ যায় সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশ-এসএমপির সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তাসহ নগরী ও সিলেটের পার্শ্ববর্তী সব থানায়। তা ছাড়া পরিবহন ও দক্ষিণ সুরমা উপজেলার কয়েকজন রাজনৈতিক নেতা এই ভাগে শরিক রয়েছেন।
অবশ্য বাইরে চালকদের মধ্যে টোকেন বাণিজ্য রমরমা হলেও সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশ-এসএমপি বলছে, তথ্যটি সঠিক নয়। পুলিশ কোনো টোকেন বাণিজ্যে জড়িত নয়। এসএমপির উপপুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক) বিএম আশরাফ উল্যাহ তাহের বলেন, আমি দায়িত্বে আসার পর বিষয়টি নিয়ে কঠোর অবস্থান নিয়েছি। যদি এ অবস্থায় কেউ আগের কৌশল পাল্টে নতুন কৌশলে নামে তাহলে তাকে খুঁজে বের করা হবে। আমার ট্রাফিক বিভাগের কারো জড়িত থাকার প্রমাণ পেলে কোনো ছাড় দেওয়া হবে না। তার বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আমরা চাই, সড়কে শৃঙ্খলা আসুক। নিয়মের বাইরে কাউকে যেতে দেওয়া হবে না।
বিআরটিএ জানায়, সিএনজিচালিত অটোরিকশার অনুমোদন দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ রেখেছে সরকার। তবুও বাজারে এগুলোর বিক্রি থেমে নেই। উত্তরাসহ সরকার অনুমোদিত গাড়ি বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো এসব অটোরিকশা বিক্রি করছে। প্রতিদিন এভাবে সড়কে সিএনজিচালিত অটোরিকশা নামলেও সেগুলো চলছে কোনোরকম সরকারি অনুমোদন বা কাগজপত্র ছাড়া; অনটেস্টে। এসব গাড়ির কোনো নম্বর প্লেট নেই।
পরিবহন সূত্র জানায়, এই সুযোগটাই কাজে লাগিয়েছে সিলেটের ট্রাফিক বিভাগের কিছু অসৎ কর্মকর্তাসহ দালাল সিন্ডিকেট। জাতীয় মহাসড়কে সিএনজি অটোরিকশা চলাচলে বিধিনিষেধ রয়েছে। কিন্তু অনুমোদনহীন এসব গাড়ি চলছে নির্বিঘ্নে। এর জন্য তাদের ব্যবহার করতে হয় একটি অবৈধ টোকেন। এটি থাকলে নির্বিঘ্নে তারা গ্রামে-গঞ্জে-মহাসড়কে-শহরে নির্বিঘ্নে চলাচল করতে পারে। পুলিশের টোকেনধারী প্রত্যেক অটোরিকশাকে দেওয়া হয় একটি স্টিকার। নম্বর প্লেটহীন গাড়ি বাধাহীন চলার ‘লাইসেন্স’ এটিই। এই স্টিকার থাকলে কোথাও পুলিশ আটকায় না। আটকালেও ছেড়ে দেওয়া হয় সঙ্গে সঙ্গেই। প্রতি মাসে অবৈধ সিএনজি অটোরিকশাগুলোকে নির্দিষ্ট অর্থের বিনিময়ে এটি কিনতে হয়। একসময় প্রকাশ্যে গাড়িতে স্থাপন করা হতো এই টোকেন। এখন সেটি থাকে গোপনে।
সূত্র মতে, ৫ আগস্টের ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পর প্রেক্ষাপট পরিবর্তন হলে টোকেন বাণিজ্যে ভাটা পড়ে। মাঝখানে কিছুদিন পুলিশও ছিল নিস্ক্রিয়। পরে আবার সড়কে নেমে অবৈধ গাড়ি ধরপাকড় শুরু করে সিলেট মেট্রো পুলিশ। এ সময় শহর ও মহাসড়ক ছাড়া হয়ে যায় অবৈধ অটোরিকশাগুলো। কিন্তু কিছুদিন পর আবার ফিরে আসে আগের অবস্থায়। পুলিশে সংস্কারের অংশ হিসেবে কর্মকর্তাদের বদলিসহ নানা উদ্যোগ নিলেও এসএমপির ট্রাফিক বিভাগ থেকে যায় প্রায় আগের জায়গায়।
কর্মকর্তাসহ সার্জেন্টদের প্রায় সবাই থেকে যান একই জায়গায়। ফলে কিছুদিন যেতেই তারা আবার স্বরূপে ফিরে আসেন। তবে এবার কৌশল পাল্টে নেন। যেহেতু যৌথবাহিনী মাঝেমধ্যেই অভিযানে নামে, রাতে সড়কে তারা কাগজপত্র পরীক্ষা করে, এমনকি এসএমপির নতুন যোগ দেওয়া কমিশনার ও উপকমিশনাররা সরাসরি মাঠপর্যায়ে তদারকিতে নামেন; সে জন্য ট্রাফিক পুলিশের অসাধু কর্মকর্তারা নতুন কৌশলে অবৈধ অটোরিকশাকে সড়কে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন চালক জানান, সিলেটে অবৈধ সিএনজি অটোরিকশাকে চলাচলের সুযোগ করে দিতে যখন পুলিশ অবৈধভাবে টোকেন বাণিজ্যে নামে, তখন গাড়িপ্রতি মাসে ৩০০ টাকায় একটি টোকেন বিক্রি করা হতো। পরে সেটি ৬০০ টাকায় নেওয়া হয়। ৫ আগস্টের পর টোকেনের দাম চলে যায় গাড়িপ্রতি ১০০০ টাকায়। গত মাস থেকে নতুন কৌশলে স্টিকার চালু হওয়ার পর প্রতি মাসের জন্য এটি কিনতে হচ্ছে ১৩০০ টাকা করে। শো-রুম থেকে কেনা নতুন অটোরিকশা ছাড়াও চোরাই গাড়ি চলে এই টোকেন দিয়ে।
তারা জানান, প্রথম দিকে পুলিশের টোকেন বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণে মূল হোতা ছিলেন সিলেটের শীর্ষ পরিবহন শ্রমিক নেতা আবুল হোসেন। তিনি মারা যাওয়ার পর নতুন তিনজন পরিবহন নেতাকে দায়িত্ব দেন ট্রাফিক পুলিশের অসাধু কর্মকর্তারা। এদের একজন বালাগঞ্জ উপজেলার গহরপুরের ওয়াকিল আহমদ। যে ছিল একসময় আবুলের সেকেন্ড ইন কমান্ড। অপর দু’জন হলো, সিলেট শহরতলী বদিকোনার বাসিন্দা আলতাফ হোসেন।
তার বাড়ি জকিগঞ্জে এবং অন্যজন জালালপুরের আজমল হোসেন। দক্ষিণ সুরমার ভার্থখলা পাম্পের পাশেই তাদের অফিস। এই অফিসে বসে সিলেট জেলার অর্ধেক সিএনজি অটোরিকশা নিয়ন্ত্রণ করে তারা। টাকার লেনদেন সব হয় এখানে। এটিই সিলেটে টোকেন সিন্ডিকেটের হেডকোয়ার্টার। তবে অভিযোগের ব্যাপারে শ্রমিক নেতা আলতাফ হোসেন জানিয়েছেন, তিনি কখনো টোকেন বাণিজ্যে ছিলেন না। কখনো করেননি, করছেনও না। তার বিরুদ্ধে অযথা অপপ্রচার করা হচ্ছে।
সূত্র জানায়, সিলেটের দক্ষিণের উপজেলার দক্ষিণ সুরমা, বিশ্বনাথ, ওসমানীনগর, বালাগঞ্জ, ফেঞ্চুগঞ্জ, গোলাপগঞ্জ, বিয়ানীবাজার ও জকিগঞ্জের সব অবৈধ গাড়ি সড়কে চলে এই সিন্ডিকেটের দেওয়া ‘টোকেন লাইসেন্সে’। নতুন কেনা অনটেস্ট গাড়ি ছাড়াও চোরাই সিএনজি অটোরিকশা, বহিরাগত জেলার গাড়ি চলে টোকেনের মাধ্যমে।
সিলেটে এ মুহূর্তে ৫ হাজারের মতো সিএনজি অটোরিকশা স্টিকার দিয়ে সড়কে চলাচল করছে। এর জন্য প্রতি মাসে সিন্ডিকেটকে দিতে হয় ১৩০০ টাকা করে। মাসের ৫-১০ তারিখের মধ্যে এই টাকা দিয়ে ওয়াকিল আহমদ, আলতাফ হোসেন এবং আজমল হোসেনের কাছ থেকে কিনতে হয় স্টিকার। ট্রাফিক পুলিশ নিজে কখনো তা বিক্রি করে না, দেয়ও না। এই তিনজনই চালকদের কাছে বিক্রি করে থাকে। এর মাধ্যমে মাসে অর্ধ কোটি টাকারও বেশি হাতিয়ে নিচ্ছে পুলিশের টোকেন সিন্ডিকেট। এর একটি অংশ তিনজনের পকেটে গেলেও বড় অংশ যায় এসএমপির ট্রাফিক বিভাগ থেকে শুরু করে বিভিন্ন স্তরে। ভাগ দেওয়া হয় বিভিন্ন থানাকে।
সূত্র জানায়, পুলিশের অবৈধ স্টিকার চালু করায় সিলেট হয়ে উঠেছে চোরাই গাড়ির নিরাপদ আশ্রয়স্থল। আর এর জংশন হয়ে উঠেছে দক্ষিণ সুরমা। সেখানে অন্য জেলা থেকে চোরাই গাড়ি এনে বিক্রি করা হয়। সিএনজি অটোরিকশা পরিবহন সেক্টরে এগুলোকে ‘রোহিঙ্গা গাড়ি’ নামে ডাকা হয়। রোহিঙ্গা গাড়ি দামে সস্তা। ১ থেকে দেড় লাখ টাকায় কেনা যায় প্রতিটি। ক্রেতারা এগুলো কিনে স্টিকার লাগিয়ে রাস্তায় নামান।
আপনার মতামত লিখুন :