স্বাস্থ্য সচিব কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে শুক্রাণুর সংখ্যা কমে যাওয়ার বিষয়ে সতর্ক করেছেন। চিকিৎসকরা বলছেন যে বাস্তবতা অনেক বেশি সূক্ষ্ম এবং আতঙ্কের কোনও কারণ নেই।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্য ও মানবসেবা সচিব রবার্ট এফ. কেনেডি জুনিয়র প্রায়ই জনসমক্ষে এসে বলেন, আজকের কিশোর ছেলেদের শুক্রাণুর সংখ্যা আগের প্রজন্মের তুলনায় অনেক কম। টেলিভিশন সাক্ষাৎকার, বক্তৃতা বা কংগ্রেসের শুনানিতেও তিনি একই কথা বলেন।
সম্প্রতি ফক্স নিউজে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি দাবি করেন, ‘আজকের কিশোরদের টেস্টোস্টেরন লেভেল একজন ৬৮ বছরের বৃদ্ধের চেয়েও কম। শুক্রাণুর সংখ্যাও ৫০ শতাংশ কমে গেছে। এটা এক ধরনের অস্তিত্বের সংকট।’
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই তথ্য পুরোপুরি ঠিক নয়। কারণ, সাধারণভাবে বয়স বাড়ার সঙ্গে শুক্রাণুর সংখ্যা কমে যায়। ফলে, কিশোরদের শুক্রাণুর সংখ্যা ৬০ থেকে ৭০ বছরের পুরুষদের তুলনায় বরং বেশি হওয়াটাই স্বাভাবিক। আর কিশোর ছেলেদের শুক্রাণুর সংখ্যা নিয়ে নির্দিষ্ট ও পর্যাপ্ত কোনো গবেষণা এখনো নেই।
ক্লিভল্যান্ড ক্লিনিকের প্রজনন বিশেষজ্ঞ ড. স্কট লুন্ডি বলছেন, পুরুষদের শুক্রাণুর সংখ্যা কমছে কি না এটা নিয়ে এখনো গবেষকদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। তিনি বলেন, ‘এই বিষয়টি খুব বিতর্কিত। একদিকে কিছু গবেষণা বলছে শুক্রাণুর সংখ্যা কমছে এবং সেটা নিয়ে চিন্তার কারণ আছে, অন্যদিকে কিছু গবেষণা আবার বলছে তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি, তাই আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই।’
স্বাস্থ্য ও মানবসেবা বিভাগের (এইচএইচএস) মুখপাত্র অ্যান্ড্রু নিক্সন বলেছেন, কেনেডি এমন একটি স্বাস্থ্য ইস্যুতে সচেতনতা তুলছেন যেটা নিয়ে অন্য অনেকেই রাজনৈতিক কারণে চুপ থাকেন।
সচিব কেনেডির এই বক্তব্যের পেছনে এমন এক ধারণা কাজ করছে, যেখানে অনেকেই বিশ্বাস করেন আজকের দিনে পুরুষদের উর্বরতা (সন্তান ধারণের ক্ষমতা) হুমকির মুখে। সোশ্যাল মিডিয়াতেও এমন অনেক দাবি ছড়ানো হয়েছে বিভিন্ন স্বাস্থ্য সচেতন ব্যক্তিত্ব, স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠান এবং তরুণদের মাধ্যমে।
এনিয়ে উদ্বিগ্ন অনেক তরুণ পুরুষ শুক্রাণু ফ্রিজ করে রাখছেন, যৌনতা থেকে বিরত থাকছেন বা টেস্টোস্টেরন থেরাপি নিচ্ছেন। এমনকি ২০২২ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, ‘বীর্য ধরে রাখা’ ছিল টিকটক ও ইনস্টাগ্রামে পুরুষদের স্বাস্থ্যবিষয়ক সবচেয়ে জনপ্রিয় আলোচ্য বিষয়।
অন্যদিকে, ‘প্রো-নেটালিস্ট’ নামে একটি আন্দোলনের সমর্থকরা বলছেন, আমেরিকায় জন্মহার কমে যাওয়ায় এখন পরিবারগুলোকে বেশি সন্তান নেওয়ার প্রতি উৎসাহিত করা উচিত। এর সবচেয়ে পরিচিত মুখ ইলন মাস্ক বলছেন, কম জন্মহারের প্রবণতা মানবজাতির জন্য বিপজ্জনক সংকেত।
তবে যারা পুরুষদের উর্বরতা নিয়ে গবেষণা করেন তারা বলছেন, বিষয়টি এতটা ভয়াবহ নয়। যুক্তরাষ্ট্রে জন্মহার কমেছে ঠিকই, তবে তার অনেক কারণ রয়েছে যেমন- অনেকে সন্তান নেওয়া বিলম্বিত করছেন কিংবা কম সন্তান নিতে চাইছেন। কিছু পুরুষ সন্তান নেওয়ায় সমস্যায় পড়লেও, সেটা অনেক সময় চিকিৎসা বা জীবনযাত্রার পরিবর্তনের মাধ্যমে সমাধান করা যায়।
দশকের পর দশক ধরে বিতর্ক
১৯৯৩ সালে বিজ্ঞানী লুই গিলেট মার্কিন কংগ্রেসে একটি শুনানিতে এমন এক মন্তব্য করেন, যা অনেককে চমকে দেয়। তিনি বলেছিলেন, ‘আজ এই ঘরে যারা বসে আছেন, তাদের প্রত্যেকেই তাদের দাদার অর্ধেক মানুষ মাত্র।’
তিনি আসলে বোঝাতে চাচ্ছিলেন যে পুরুষদের শুক্রাণুর সংখ্যা আগের প্রজন্মের তুলনায় অনেক কমে গেছে। তার এই বক্তব্যের এক বছর আগে ১৯৩৮ থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন গবেষণাপত্র বিশ্লেষণ করে এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, গড় শুক্রাণুর সংখ্যা প্রায় ৫০ শতাংশ কমে গেছে।
তবে পরবর্তী সময়ে অনেক বিজ্ঞানী সেই গবেষণার পদ্ধতি ও বিশ্লেষণ নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তারা বলেন, বিশ্লেষণে পুরোনো সময়ের তুলনায় তথ্য খুব কম ছিল, সব পুরুষদের একরকম পদ্ধতিতে পরীক্ষা করা হয়নি, এবং যাদের শুক্রাণুর সংখ্যা স্বাভাবিকের নিচে ছিল, তাদের তথ্য সঠিকভাবে বিশ্লেষণে ধরা হয়নি।
চিলড্রেন’স মার্সি কানসাস সিটির গবেষক ডোলোরেস ল্যাম্ব বলেন, ‘এই গবেষণাপত্রটি অনেক সময় উদ্ধৃত করা হয়, কিন্তু এর পরিসংখ্যান ঠিকভাবে তৈরি করা হয়নি’।
পরবর্তীতে ১৯৯২ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত প্রকাশিত গবেষণাগুলোর একটি পর্যালোচনায় দেখা গেছে, আটটি গবেষণায় শুক্রাণুর মান খারাপ হওয়ার কথা বলা হয়েছে। ২১টিতে কোনো পরিবর্তন দেখা যায়নি বা বরং উন্নতি দেখা গেছে, ছয়টি গবেষণায় মিশ্র বা অস্পষ্ট ফলাফল পাওয়া গেছে।
এই তথ্য বিশ্লেষণ করে ল্যাম্ব বলেন, ‘সামগ্রিকভাবে তথ্যগুলো বলছে, শুক্রাণুর সংখ্যায় প্রকৃতপক্ষে কোনো বড় ধস দেখা যায়নি।’
২০২১ সালে প্রজনন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ শান্না সোয়ান তার বই ‘কাউন্ট ডাউন’ প্রকাশ করে শুক্রাণুর সংখ্যা কমে যাওয়া নিয়ে নতুন করে আলোচনার ঝড় তোলেন। বইটিতে তিনি সতর্ক করেন যে, শুক্রাণুর এই হ্রাস ‘মানব জাতির ভবিষ্যতকেই হুমকির মুখে ফেলতে পারে’।
এর আগেই, ২০১৭ সালে সোয়ান ও তার সহ-লেখকরা একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছিলেন, যেখানে দেখা যায় ১৯৭৩ থেকে ২০১১ সালের মধ্যে উত্তর আমেরিকা, ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডে পুরুষদের শুক্রাণুর সংখ্যা ৫২ শতাংশ কমে গেছে। পরে ২০২২ সালের একটি ফলোআপ গবেষণায় দেখা যায়, এই প্রবণতা কেবল ওই অঞ্চলগুলোতেই নয়, বরং পুরো বিশ্বেই দেখা যাচ্ছে।
দ্য গার্ডিয়ানে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সোয়ান বলেন, তার গবেষণার ফলাফল ইঙ্গিত দেয় যে এই হারে চলতে থাকলে ২০৪৫ সালের মধ্যে গড় শুক্রাণুর সংখ্যা শূন্যে নেমে যেতে পারে।
পুরুষদের অধিকার নিয়ে কাজ করা কিছু গোষ্ঠী এই গবেষণাকে সামনে এনে দাবি করে, পুরুষরা নাকি ধীরে ধীরে তাদের ‘পুরুষত্ব’ হারাচ্ছেন। এমনকি এটি নিয়ে একটি ভাইরাল ক্যাম্পেইনও হয়েছিল, যেখানে মাইক্রোস্কোপের নিচে শুক্রাণু কোষগুলোর প্রতিযোগিতা দেখতে অনেকে ভিড় জমিয়েছিলেন এই বার্তা দিতে যে ভবিষ্যতে সন্তান ধারণের সামর্থ্য এক সময় হারিয়ে যাবে।
এইচএইচএস মুখপাত্র নিক্সন ২০১৭ এবং ২০২২ সালে সোয়ানের গবেষণাগুলো প্রজনন স্বাস্থ্যের অবনতি সম্পর্কে কেনেডির দাবিকে সমর্থন করেন।
আপনার মতামত লিখুন :