ভারতের পণ্যে যুক্তরাষ্ট্রের আরোপিত ৫০ শতাংশ শুল্ক যেন কার্যত এক ধরনের ‘নিষেধাজ্ঞা’ হয়ে দেখা দিয়েছে। ফলে পোশাক, হীরা-গয়না এবং চিংড়ি শিল্পে অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে, বিপদে পড়েছেন লাখ লাখ শ্রমিক। এমনকি বেতন নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে অনেক প্রতিষ্ঠান। সংবাদমাধ্যম বিবিসির এক প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে এর বিস্তারিত।
তিরুপুরে পোশাক কারখানায় নীরবতা
তামিলনাড়ুর তিরুপুর, ভারতের অন্যতম বৃহৎ তৈরি পোশাক রপ্তানি কেন্দ্র। এখানে সাধারণত ২০০টি ইন্ডাস্ট্রিয়াল সেলাই মেশিন একযোগে সচল থাকে। কিন্তু এখন চলছে মাত্র কয়েকটি, তাও শিশুদের পোশাকের শেষ অর্ডারগুলো সম্পন্ন করার জন্য।
কারখানার মালিক এন কৃষ্ণমূর্তি জানান, বড় মার্কিন ব্র্যান্ডগুলো সব নতুন অর্ডার স্থগিত করেছে। ফলে তিনি সম্প্রসারণ পরিকল্পনা বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছেন এবং সম্প্রতি নিয়োগ দেওয়া প্রায় ২৫০ শ্রমিককে বসিয়ে রাখতে হয়েছে।
তৈরি পোশাকের ক্ষেত্রে তিরুপুর একাই ভারতের ১৬ বিলিয়ন ডলারের এক-তৃতীয়াংশ সরবরাহ করে, যার মধ্যে রয়েছে ওয়ালমার্ট, টার্গেট, গ্যাপ ও জারা’র মতো ব্র্যান্ডের পোশাক। কিন্তু শুল্ক বৃদ্ধির ফলে এর ভবিষ্যৎ নিয়ে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
শুল্কে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে ভারত
ভারতের তৈরি একটি শার্ট আগে ১০ ডলারে মার্কিন বাজারে বিক্রি হতো, এখন ৫০ শতাংশ শুল্কে দাম দাঁড়াবে ১৬.৪ ডলার। তুলনায় চীনা শার্ট ১৪.২ ডলার, বাংলাদেশি শার্ট ১৩.২ ডলার আর ভিয়েতনামের শার্ট ১২ ডলারে পাওয়া যাবে। এমনকি শুল্ক কমে ২৫ শতাংশ হলেও ভারত প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়বে।
একটি অন্তর্বাস কারখানায় দেখা গেছে, প্রায় ১০ লাখ ডলারের পণ্য মজুত, কিন্তু মার্কিন ক্রেতা নেই। মালিক শিবা সুব্রামানিয়ামের প্রশ্ন, ‘এই অবস্থায় শ্রমিকদের বেতন দেব কীভাবে?’
হীরা শিল্পে দ্বিগুণ সংকট
মুম্বাইয়ের এক্সপোর্ট জোনে শত শত শ্রমিক ব্যস্ত হীরা পালিশে। কিন্তু এখানে আতঙ্ক—সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে মার্কিন বাজারে ৩ থেকে ৪ বিলিয়ন ডলারের গয়না রপ্তানি ঝুলে যেতে পারে।
ক্রিয়েশন জুয়েলারির মালিক আদিল কোটওয়াল বলেন, ‘আমার লাভের হার মাত্র ৩ থেকে ৪ শতাংশ। অতিরিক্ত ১০ শতাংশ শুল্কও বহন করা অসম্ভব। মার্কিন খুচরা বিক্রেতারাও এই চাপ নিতে পারবে না।’
হীরার বড় অংশ আসে গুজরাটের সুরাট থেকে। কিন্তু সেখানে চাহিদা হ্রাস ও ল্যাবে তৈরি হীরার প্রতিযোগিতা আগে থেকেই সমস্যা তৈরি করেছিল। এখন নতুন শুল্কে সংকট আরও ঘনীভূত হয়েছে।
একসময়ের ব্যস্ত কারখানাগুলো এখন মাসে সর্বোচ্চ ১৫ দিন চালু থাকে। অনেক শ্রমিককে বাধ্য হয়ে ছুটিতে পাঠানো হয়েছে। সুরাটের এক মালিক শৈলেশ মাঙ্গুকিয়া জানান, তিনি আগে ৩০০ শ্রমিক রাখতেন, এখন মাত্র ৭০ জন। মাসে হীরা পালিশ ২ হাজার থেকে কমে ৩০০-তে দাঁড়িয়েছে।
স্থানীয় শ্রমিক ইউনিয়ন বলছে, শ্রমিকরা এখন কম মজুরি, বাধ্যতামূলক ছুটি এবং আয় হ্রাসের মুখে পড়েছেন।
চিংড়ি শিল্পেও ধস
ভারত বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ চিংড়ি রপ্তানিকারক দেশ। আর যুক্তরাষ্ট্র তার বড় বাজার। কিন্তু নতুন শুল্কের কারণে এ খাতেও ধস নেমেছে। এখন মোট শুল্ক ৬০% এরও বেশি, ফলে চিংড়ির দাম কেজিতে ০.৬০ থেকে ০.৭২ ডলার কমেছে।
এখন চাষিরা নতুন করে চিংড়ি চাষ নিয়ে দ্বিধায় রয়েছেন। ভিজাগের এক রপ্তানিকারক জগদীশ বলেন, ‘এটি ক্রিসমাসের মৌসুম। কিন্তু এখন আমরা সিদ্ধান্তই নিতে পারছি না।’
হ্যাচারি মালিক এম এস বর্মা জানান, আগে বছরে গড়ে ১০০ মিলিয়ন চিংড়ির লার্ভা উৎপাদন হতো, এখন কমে ৬০ থেকে ৭০ মিলিয়নে নেমে এসেছে।
অর্থনৈতিক প্রভাব ও কূটনৈতিক উত্তেজনা
ভারত সরকার কিছু পদক্ষেপ ঘোষণা করেছে—কাঁচামালের আমদানি শুল্ক মওকুফ, নতুন বাজার খোঁজা ইত্যাদি। তবে ব্যবসায়ীরা এ পদক্ষেপগুলোতে খুব একটা সন্তুষ্ট নন।
ভারত-যুক্তরাষ্ট্রের নতুন বাণিজ্য আলোচনা এই সপ্তাহে দিল্লিতে শুরু হওয়ার কথা থাকলেও তা বাতিল হয়েছে। মার্কিন কর্মকর্তারা ভারতকে চীনের ঘনিষ্ঠ হওয়া ও রাশিয়ার সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্ক বজায় রাখার অভিযোগ তুলেছেন।
এশিয়া গ্রুপ অ্যাডভাইজরি ফার্মের গোপাল নাদ্দুর বলেন, ‘ভারত-যুক্তরাষ্ট্র আলোচনার ভবিষ্যৎ এখন নির্ভর করছে চীন-রাশিয়া ইস্যুতে ট্রাম্প প্রশাসনের অগ্রাধিকারের ওপর।’ তার মতে, ভারতের নীতিনির্ধারক ও ব্যবসায়ীদের এখন আত্মনির্ভরতা বাড়ানো, বাজারে বৈচিত্র্য আনা ও কোনো সুযোগ হাতছাড়া না করার ওপর নজর দিতে হবে।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন