১৯৫৩ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডুইট আইজেনহাওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন ‘শান্তির জন্য পরমাণু’ কর্মসূচির। উদ্দেশ্য ছিল বিশ্বজুড়ে শান্তিপূর্ণ কাজে পারমাণবিক প্রযুক্তির ব্যবহার ছড়িয়ে দেওয়া। কিন্তু ইতিহাসবিদদের মতে, এই ঘোষণার আড়ালে ছিল পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির প্রতিযোগিতায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব বিস্তার ও নেতৃত্ব ধরে রাখার এক সূক্ষ্ম কৌশল।
এই কর্মসূচির আওতায় ইসরায়েল, পাকিস্তান ও ইরানসহ অনেক দেশকে দেওয়া হয় বিজ্ঞান, চিকিৎসা ও শক্তি উৎপাদনে ব্যবহৃত পারমাণবিক জ্ঞান ও প্রযুক্তি। এরই অংশ হিসেবে ১৯৬৭ সালে ইরান একটি গবেষণা চুল্লি পায়।
তখন ইরানের শাসনভার ছিল রাজা মোহাম্মদ রেজা পাহলভির হাতে। তিনি ছিলেন একজন পাশ্চাত্যপন্থি, সুইজারল্যান্ডে শিক্ষিত অভিজাত শাসক। ১৯৫৩ সালে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ’র সহায়তায় এক অভ্যুত্থানে তিনি ক্ষমতায় এসেছিলেন।
পাহলভি চেয়েছিলেন ইরানকে আধুনিক বিশ্বশক্তি হিসেবে গড়ে তুলতে। নারীদের পর্দা নিষিদ্ধ করেন, ধর্মনিরপেক্ষতা ও পাশ্চাত্য শিক্ষা চালু করেন, রাজনৈতিক বিরোধীদের কঠোর হস্তে দমন করেন।
তিনি বিশাল তেলসম্পদের দেশ হওয়া সত্ত্বেও পারমাণবিক শক্তিকে জ্বালানি স্বাধীনতার ভবিষ্যৎ বলে মনে করতেন। ‘শান্তির জন্য পরমাণু’ কর্মসূচির সুবিধাভোগী হয়ে ইরানের বিজ্ঞানীরা যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমআইটিতে পারমাণবিক বিষয়ে প্রশিক্ষণ নেন।
ইরানের উচ্চাকাঙ্ক্ষা যখন বাড়তে থাকে, তখন ইরান-ফ্রান্স, জার্মানি ও দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দেশের সঙ্গে নতুন পারমাণবিক চুক্তি করে। ১৯৭৪ সালে ফ্রান্স থেকে পাঁচটি বৃহৎ চুল্লি কেনার চুক্তি করেন পাহলভি। সে সময় নিউ ইংল্যান্ডের একদল বিদ্যুৎ কোম্পানি পূর্ণ পৃষ্ঠাজুড়ে তার ছবি দিয়ে বিজ্ঞাপন দেয়, যেখানে বলা হয়- ‘যদি নিরাপত্তা নিয়ে সন্দেহ থাকত, তবে তিনি এখনই বিদ্যুৎকেন্দ্র গড়তেন না।’
তবে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগ তখনই বাড়ে যখন দেখা যায়, এসব চুক্তিতে অস্ত্র তৈরির বিপদ রোধে সুনির্দিষ্ট সুরক্ষা ব্যবস্থার কথা নেই। পাহলভি পরবর্তীতে নিজের দেশের ‘পারমাণবিক জ্বালানি উৎপাদনের অধিকার’ নিয়ে সরব হয়ে ওঠেন এবং এই অধিকার হস্তক্ষেপ করলে তা ‘জাতীয় সার্বভৌমত্বে হস্তক্ষেপ’ বলেও উল্লেখ করেন।
১৯৭৯ সালে ইসলামী বিপ্লবের মাধ্যমে পাহলভির পতন ঘটে। তার বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের ক্ষোভ ছিল চরমে, আর পশ্চিমা প্রভাব ছিল এই ক্ষোভের অন্যতম উৎস। এ সময় নতুন ধর্মীয় নেতৃত্ব- আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনি প্রথমদিকে এই ব্যয়বহুল পারমাণবিক কর্মসূচি চালিয়ে যেতে আগ্রহ দেখাননি।
তবে ১৯৮০ সালে শুরু হওয়া ইরাক-ইরান যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ইরান আবার পারমাণবিক প্রযুক্তির দিকে ঝুঁকে পড়ে। এবার তাদের সহায়তায় আসে পাকিস্তান। পাকিস্তানের বিজ্ঞানী আব্দুল কাদির খান গোপনে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করার সেন্ট্রিফিউজ সরবরাহ করেন, যা উচ্চ মাত্রায় শোধিত হয়ে অস্ত্র তৈরির সক্ষমতা অর্জন করে।
যুক্তরাষ্ট্রের পারমাণবিক বিষয়ক সাবেক উপদেষ্টা গ্যারি সামোর বলেন, ‘ইরানের পরমাণু কর্মসূচি মার্কিন সহায়তায় নয়, বরং পাকিস্তান থেকে সংগ্রহ করা প্রযুক্তির ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে। তবে সেই প্রযুক্তি যে ইরানে আগে থেকেই স্থাপিত মার্কিন সহায়তা প্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানে ব্যবহৃত হচ্ছিল, সেটাও সত্য।’
বছরের পর বছর ইরান গোপনে কর্মসূচি চালিয়ে যায়, আরও সেন্ট্রিফিউজ তৈরি করে ও ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করে। ২০০২ সালে ইরানের গোপন কেন্দ্র ফাঁস হওয়ার পর আন্তর্জাতিক মহলে ব্যাপক উদ্বেগ সৃষ্টি হয়।
দুই দশকের কূটনৈতিক চেষ্টা, নিষেধাজ্ঞা ও সামরিক হামলার পরও সমস্যার মীমাংসা হয়নি। সম্প্রতি মার্কিন বিমান হামলায় ইরানের তিনটি পারমাণবিক স্থাপনা ধ্বংসের দাবি করা হলেও অনেক জায়গা এখনও সচল রয়েছে।

সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন