ঢাকা বৃহস্পতিবার, ০৪ ডিসেম্বর, ২০২৫

ইসরায়েলের বাধায় নিজেদের জমিতে যেতে পারছেন না ফিলিস্তিনিরা, বিপর্যয়ে জলপাইশিল্প

বিশ্ব ডেস্ক
প্রকাশিত: ডিসেম্বর ৪, ২০২৫, ০৯:০৭ এএম
ফিলিস্তিনিদের জমিতে প্রবেশে বাধা দিচ্ছে দখলদার এক যুবক, পাশেই ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর সদস্য। ছবি- সংগৃহীত

ফিলিস্তিনের অধিকৃত পশ্চিম তীরের দেইর আম্মার এলাকায় বসবাস ওসমান পরিবারের। বাড়ির বারান্দা থেকে যতদূর চোখ যায়, সারি সারি জলপাই গাছ। কিন্তু উসমান বাদাহা পরিবারের মতো অনেকেই আজ অসহায়। যে জমি থেকে প্রজন্ম ধরে তাঁরা ফসল তুলেছেন, গান গেয়েছেন এবং পিকনিক করেছেন, এখন তাঁরা সেই জমিতে যেতে পারছেন না। ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারীদের নিরন্তর আক্রমণ, জমিতে প্রবেশে সামরিক নিষেধাজ্ঞা ও খরা—এই তিনের সম্মিলিত প্রভাবে ফিলিস্তিনিদের ঐতিহ্যবাহী জলপাই ফসল সংগ্রহ অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতিতে গিয়ে ঠেকেছে। শত শত বছর ধরে যে জলপাই ফিলিস্তিনি সমাজের মেরুদণ্ড ও জীবিকার উৎস, তা আজ চরম সংকটের মুখে।

পূর্বপুরুষের জমিতে প্রবেশ নিষিদ্ধ: নীরব জলপাইবাগান

ফিলিস্তিনের অধিকৃত পশ্চিম তীরের কৃষকদের জীবনে এবার নেমে এসেছে এক ভয়াবহ বিপর্যয়। সশস্ত্র ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারীদের লাগাতার হুমকি এবং ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর দেওয়া বারবার ‘সামরিক এলাকা বন্ধ’ এমন নির্দেশের কারণে ফিলিস্তিনিদের জলপাইবাগানগুলো কাটা যায়নি, ছাঁটা যায়নি। ফলে অপরিচ্ছন্ন অবস্থায় পড়ে আছে।

৬৭ বছর বয়সী ফিলিস্তিনি ইউসুফ দার আল-মুসা বলেন, তাঁর ৪৫০টির বেশি জলপাইগাছ থাকা জমিতে প্রবেশ করতে গেলে অবৈধ ইহুদি বসতি স্থাপনকারীরা তাঁকে বন্দুকের বাট দিয়ে পিটিয়েছে। তাদের বেধড়ক পিটুনিতে তিনি গুরুতর আহত হয়েছেন। তিনি ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, ‘এই জমি আমার। আমি আমার বাবা, দাদা, তাঁর দাদার কাছ থেকে পেয়েছি। তোমরা কে, কোথা থেকে এসেছ?’

ইউসুফের পরিবারের আয়ের প্রধান উৎস ছিল জলপাই তেল বিক্রি। কিন্তু এই বছর তাঁর কোনো জলপাই তেল নেই। তিনি জানান, ‘জমি আমাদের জীবন...ফসল না তুলতে পারলে আমরা মরে যাব।’

দখল ও অর্থনৈতিক পতন

ইসরায়েলি দখলদারত্বের ফলে অবৈধ ইহুদি বসতি স্থাপনের জন্য ফিলিস্তিনি কৃষিজমি ক্রমশ দখল করে চলেছে ইসরায়েলি বাহিনী।

স্থানীয়দের মতে, ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর সহায়তায় বসতি স্থাপনকারীরা দেইর আম্মার গ্রামের আশপাশে প্রায় সাত হাজার ডুনাম (প্রায় ১ হাজার ৭৩০ একর) জমি দখল করে নিয়েছে। ইজ্জত উসমান (৭২) জানান, বসতি স্থাপনকারীরা তাঁর ৩৮ একর জমি কেড়ে নিয়েছে এবং তাঁর সব গাছ কেটে ফেলেছে।

গাজায় ইসরায়েলি নৃশংসতা শুরুর পর ইসরায়েল পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিনিদের ইসরায়েলে শ্রমিক হিসেবে কাজের অনুমতি বাতিল করে দেয়। ফলে কৃষির ওপর ফিলিস্তিনিদের নির্ভরশীলতা বৃদ্ধি পায়। কিন্তু ঠিক তখনই সামরিক বাহিনী পুরো উপত্যকাকে ‘সামরিক এলাকা’ ঘোষণা করে কৃষকদের আয়ের পথ বন্ধ করে দেয়।

অক্টোবর ও নভেম্বরে দেইর আম্মারের তেলের ঘানি অন্যান্য বছর এই মৌসুমে ২৪ ঘণ্টা চলত। প্রতিদিন ১ হাজার থেকে ২ হাজার টিন (প্রতি টিন ১০ লিটার) তেল উৎপাদন করত। এবার সব তেলের ঘানি নীরব। পুরো গ্রামের মোট উৎপাদন মাত্র ৩০ টিনের কাছাকাছি।

অবৈধ বসতি স্থাপনকারী ও সেনাবাহিনীর সম্মিলিত হামলা

ইউএন অফিস ফর দ্য কো–অর্ডিনেশন অব হিউম্যানিটারিয়ান অ্যাফেয়ার্সের (ওসিএইচএ) তথ্যানুযায়ী, ১ অক্টোবর থেকে ১০ নভেম্বরের মধ্যে ফসল সংগ্রহের সময় বসতি স্থাপনকারীদের ১৬৭টি হামলার ঘটনা নথিভুক্ত করা হয়েছে। আক্রান্ত গ্রামের সংখ্যাও দ্বিগুণ হয়েছে।

অবৈধ ইহুদি বসতি স্থাপনকারীরা হামলায় নতুন নতুন কৌশলের আশ্রয় নিচ্ছে। তারা ফিলিস্তিনিদের জমিতে পৌঁছাতে দেখলেই সেনা সদস্যদের ফোন করে খবর দেয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই সেনা এসে এলাকাটিকে ‘সামরিক এলাকা’ উল্লেখ করে ফিলিস্তিনিদের চলাচল বন্ধ ঘোষণা করে এবং কৃষকদের তাড়িয়ে দেয়।

মানবাধিকার সংস্থাগুলোর মতে, অবৈধ ইহুদি বসতি স্থাপনকারী ও সেনারা একযোগে কাজ করছে, এটি খুবই স্পষ্ট।

ঘাসসান নাজ্জার নামের এক কৃষক অ্যাকটিভিস্ট বলেন, মাঝেমধ্যে সামরিক বাহিনী ভুল তারিখ বা স্থানের সামরিক আদেশ দিয়ে কৃষকদের হয়রানি করে। তিনি গর্বের সঙ্গে বলেন, ‘ইসরায়েলি সেনারা এলে আপনি পালিয়ে যান...কিন্তু আমি কেন মর্যাদা ছাড়া মরব?’

শুধু ভূমি দখল নয়, ডাকাতি ও ধ্বংসযজ্ঞও চালিয়ে যাচ্ছে অবৈধ ইহুদি বসতি স্থাপনকারীরা। তারা কেবল ফসল সংগ্রহে বাধা দিচ্ছে না, তারা বাগান থেকে জলপাই, ত্রিপল এবং অন্যান্য সরঞ্জামও চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে। এমনকি ভয় দেখিয়ে কৃষকদের সরিয়ে দেওয়ার পর তারা নিজেদের গরু ছেড়ে দেয়, যাতে সেগুলো বাগানের ফসল খেয়ে ফেলে।

জলপাই তেলের অভাব ও সামাজিক সংকট

এই বছর ফিলিস্তিনে জলপাই তেল উৎপাদন মারাত্মকভাবে কমে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

চলতি বছর উৎপাদন সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে গেছে। গবেষকদের প্রাথমিক অনুমান, এ বছর মাত্র ৭ হাজার থেকে ৮ হাজার টন জলপাই তেল উৎপাদিত হতে পারে। এই পরিমাণ হবে গত বছরের উৎপাদনের মাত্র এক-চতুর্থাংশ। স্বাভাবিক বার্ষিক গড় উৎপাদন ২২ হাজার ৫০০ টন।

এ অবস্থায় জলপাই তেলের দাম হু হু করে বাড়ছে। সবচেয়ে কম উৎপাদনের কারণে ফিলিস্তিনিদের খাদ্যের প্রধান উপকরণ জলপাই তেলের দাম আকাশ ছুঁয়েছে। উসমান পরিবারের সদস্যরা প্রতি বেলাতেই জলপাই তেল খেতেন। তাঁরাও এখন তেলের ব্যবহার কমাচ্ছেন।

জলপাই গাছকে নিশানা করে কৃষকদের ওপর অবৈধ ইহুদি বসতি স্থাপনকারীদের হামলার কারণে ফিলিস্তিনিদের সামাজিক বাঁধনও দুর্বল হয়ে পড়ছে। গবেষকেরা সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, জলপাই সংগ্রহ ফিলিস্তিনিদের সামাজিক বন্ধনের তিনটি প্রধান স্তম্ভের (ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহাসহ) একটি। এটি এমন একটি সময় যখন পারিবারিক বিবাদ ভুলে সবাই একত্র হয়। এই ফসল সংগ্রহ ব্যাহত হলে ফিলিস্তিনি সমাজের সেই বন্ধনও ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

অসময়ে গাছ ছাঁটা, সার দেওয়া ও পরিচর্যা করতে না পারায় জলপাইগাছ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, কৃষকেরা বারবার তাঁদের জমিতে পৌঁছাতে না পারলে জলপাইগাছগুলো মরে যাবে। ফলে অবৈধ ইহুদি বসতি স্থাপনকারীদের পক্ষে ওই জমি সম্পূর্ণভাবে দখল করা আরও সহজ হয়ে উঠবে।

ফিলিস্তিনি বৃদ্ধ ইজ্জত উসমান বলেন, ‘আমার ৭২ বছর। এই বছরের ফসল সংগ্রহকে আমার দেখা সবচেয়ে খারাপ বলে মনে হচ্ছে।’

আলী বাদানহার স্ত্রী কিফাহ বিষণ্ন হাসি নিয়ে বলেন, ‘আমাদের সারা জীবন এই মাটি চাষ করেই কেটেছে। কিন্তু এখন আমি শুধু কষ্ট পাই জমিটির দিকে তাকিয়ে। আমার জীবন শূন্য মনে হয়।’

কিফাহ বলেন, অক্টোবরের মাঝামাঝি সময়ে তাঁরা তাঁদের জমিতে যাওয়ার চেষ্টা করেন। তাঁরা যখন ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর অবরোধ করে রাখা রাস্তায় পৌঁছালেন, সেখানে দেখেন পাথরভর্তি টায়ার দিয়ে রাস্তা বন্ধ করে রাখা হয়েছে। আলী ইসরায়েলি সেনাদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করলেন। তিনি কাকুতি-মিনতি করে তাঁদের জলপাইবাগানে যাওয়ার অনুমতি চাইলেন। এই ফাঁকে কিফাহ (আলীর স্ত্রী) টায়ারগুলো সরানোর কাজ শুরু করলেন।

কিন্তু যেই না কিফাহ তৃতীয় টায়ারটি সরালেন, সঙ্গে সঙ্গে সেখানে লুকিয়ে রাখা একটি ছোট বিস্ফোরণ ঘটল। কিফাহ ছিটকে পেছনে পড়ে গেলেন এবং জ্ঞান হারালেন।

পরে বিষাদের সঙ্গে কিফাহ বলেন, ‘জলপাই তুলতে গেলেই আমাদের সঙ্গে এমনটা করা হচ্ছে।’

নিজের জমিতে যেতে না পারায় আলী একদিন সকালে তাঁর চাচাতো ভাই ইসমাইলের বারান্দায় এসে একটি চেয়ারে এলিয়ে পড়লেন। নীরবে চা পান করতে করতে তিনি ফসলের অপেক্ষায় থাকা গাছগুলোর দিকে তাকিয়ে রইলেন।

ইসমাইল দেখলেন, তাঁর ছোট ভাগনে-ভাইপোরা চুপচাপ তাঁদের পাশে বারান্দায় বসে আছে। তিনি ভাবতে ভাবতে বললেন, ‘জলপাই ছাড়া ফিলিস্তিনি কী? জমি ছাড়া কৃষক (ফেল্লাহ) কী?’

ইসমাইল বলে উঠলেন, ‘কিছুই না। কিছুই না। এই জমিই আমাদের অতীত, আমাদের বর্তমান, আমাদের ভবিষ্যৎ।’