আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে বিভিন্ন দলের প্রচারণায় সরগরম রংপুর-৩ আসন। ইতিমধ্যে বিভিন্ন দলের মনোনয়নপ্রত্যাশীরা নিজ নির্বাচনি এলাকার ভোটারদের দিচ্ছেন নানা প্রতিশ্রুতি। পাশাপাশি নির্বাচনে বিভিন্ন দলের জয়-পরাজয়ের সম্ভাবনা নিয়ে চায়ের কাপে ঝড় তুলছেন ভোটাররাও। তবে সার্বিকভাবে ভোটের পরিবেশ যাতে নিরাপদ থাকে এমনটাই চাচ্ছেন ভোটাররা।
রংপুর-৩ আসনে বিগত দিনের ভোটের রাজনীতি, বর্তমানের নির্বাচনকেন্দ্রিক প্রচারণা ও ভোটারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) এখন পর্যন্ত রংপুরে তাদের প্রার্থী চূড়ান্ত করেনি। বাম দলগুলোরও খবর নেই। এ ছাড়া আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি নির্বাচন করতে পারবে কি না তা-ও নিশ্চিত নয়। এই পরিস্থিতিতে নির্বাচন হলে বিএনপি, জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ-এর মধ্যে লড়াই হবে। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির সম্ভাব্য অনুপস্থিতিতে বিএনপি বেশ সুবিধাজনক অবস্থায় থাকলেও জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী আন্দোলনের চ্যালেঞ্জের মুখেই পড়তে হবে বলে জানা গেছে।
ভোটের রোডম্যাপ ঘোষণার পরপরই রংপুর-৩ আসনের সম্ভাব্য প্রার্থীরা সভা-সমাবেশ করছেন। এসব সভা-সমাবেশে প্রার্থীরা বলছেন উন্নয়নের কথা, বদলে দেওয়ার কথা। তবে ভোটাররা যোগ্য প্রার্থী খুঁজছেন, যাদের মাধ্যমে সত্যিকার অর্থেই এলাকার উন্নয়ন হবে।
সদর উপজেলার পাঁচ ইউনিয়ন ও সিটি করপোরেশনের ৯ থেকে ৩৩ নম্বর ওয়ার্ড নিয়ে গঠিত রংপুর-৩ আসনটি। স্বাধীনতার পর এই আসনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি একবার করে জয় পেলেও দল গঠনের পর থেকে আসনটি দখলে নেয় জাতীয় পার্টি। আগামী নির্বাচনে জাতীয় পার্টি অংশ নেবে কি না তা নিশ্চিত না হলেও বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী আন্দোলনের নেতাকর্মীরা মাঠে নেমে পড়েছেন। ইতিমধ্যে জামায়াতে ইসলামী তাদের প্রার্থী হিসেবে দলটির কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য অধ্যাপক মাহবুবুর রহমান বেলাল ও ইসলামী আন্দোলন তাদের প্রার্থী হিসেবে রংপুর মহানগরের সেক্রেটারি মুহাম্মদ আমিরুজ্জামান পিয়ালের নাম ঘোষণা করেছে।
অন্যদিকে বিএনপি তাদের প্রার্থী ঘোষণা না করলেও দলটির মহানগরের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য ও সাবেক শহর কমিটির সভাপতি কাওছার জামান বাবলা, জেলার সদস্যসচিব আনিছুর রহমান লাকু, মহানগরের আহ্বায়ক সামসুজ্জামান সামু, সাবেক মন্ত্রী মশিউর রহমান যাদু মিয়ার মেয়ে ও মহানগর আহ্বায়ক কমিটির সদস্য রিটা রহমানসহ একাধিক নেতা দলের মনোনয়ন প্রত্যাশা করছেন বলে জানা গেছে।
জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) এখন পর্যন্ত রংপুরে তাদের প্রার্থী চূড়ান্ত করেনি। বাম দলগুলোরও খবর নেই। এ ছাড়া আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি নির্বাচন করতে পারবে কি না তা-ও নিশ্চিত নয়। এ পরিস্থিতিতে নির্বাচন হলে বিএনপি, জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলনের মধ্যে লড়াই হবে।
বিগত নির্বাচনের পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, ১৯৭৩ সালে অনুষ্ঠিত প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ, ১৯৭৯ সালের নির্বাচনে বিএনপি এবং ১৯৮৬ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত জাতীয় পার্টির প্রার্থী সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। এর মধ্যে ১৯৯১ সাল থেকে এরশাদ ও তার পরিবারের সদস্যরাই ছিলেন এই আসনের সংসদ সদস্য। সিটি করপোরেশন গঠনের পর দলীয় কোন্দলে জড়িয়ে একবার আওয়ামী লীগের ঘরে মেয়র পদ চলে গেলেও পরপর দুবার জয়লাভ করেন জাতীয় পার্টির প্রার্থী। নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানে এরশাদের পতন ঘটে। এরপর আর ক্ষমতায় যাওয়া হয়নি জাতীয় পার্টির। তবে ক্ষমতা হারালেও বেশির ভাগ সময়ে ক্ষমতাসীন দলের মাঝে নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে সুবিধা ভোগ করেছে দলটি।
আওয়ামী লীগের গত তিন মেয়াদে তাদের সঙ্গে সমঝোতা করে নির্বাচনে অংশগ্রহণ এবং সংসদে বিরোধী দলের ভূমিকাও পালন করে জাপা। এ কারণে গৃহপালিত বিরোধী দলের তকমাও জোটে কপালে। জাতীয় পার্টির দুর্গখ্যাত রংপুর অঞ্চলেও প্রভাব কমতে থাকে একসময়ের একক আধিপত্য বিস্তারকারী দলটির।
বিগত সময়ের বিতর্কিত তিনটি সংসদ নির্বাচনে শরিক দলের কাছ থেকে ছাড় পাওয়া আসন ছাড়া এককভাবে কোনো আসনেই সুবিধা করতে পারেনি তারা। গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর জোট ছাড়া অনেকটা বেকায়দায় পড়েছে জাতীয় পার্টি।
এদিকে, দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে ও বিভিন্ন সময়ে নির্বাচন বর্জন করলেও ধীরে ধীরে নিজেদের অবস্থান পোক্ত করেছে বিএনপি, জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলন। যার প্রমাণ বিগত সময়ের স্থানীয় সরকার নির্বাচনে পাওয়া যায়। গত সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর জামানত বাজেয়াপ্ত হলেও প্রায় ৫০ হাজার (দ্বিতীয় সর্বোচ্চ) ভোট পেয়ে চমক দেখায় ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ।
এই আসনে বিএনপির প্রার্থী বাছাইয়ে ভুল করলে খেসারত দিতে হতে পারে। এর আগে বহিরাগত একজনকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছিল। এতে স্থানীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দেয়। সাধারণ ভোটাররাও তাকে সেভাবে জানতেন না। হুট করে এসে মনোনয়ন নিয়ে নির্বাচন করলে হিতে বিপরীত হতে পারে।
এর আগের সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থীও ভোটের মাঠে বেশ সাড়া ফেলেছিলেন। জামায়াতে ইসলামী জোটগত কারণে আগে এই আসন বিএনপিকে ছেড়ে দিলেও এবার নিজেদের অবস্থান জানান দিতে জোরেশোরেই মাঠে নেমেছে।
রংপুর নগরীর গণেশপুর বকুলতলা এলাকার নতুন ভোটার জায়েদ ইমরান বলেন, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) এখন পর্যন্ত রংপুরে তাদের প্রার্থী চূড়ান্ত করেনি। বাম দলগুলোরও খবর নেই। এ ছাড়া আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি নির্বাচন করতে পারবে কি না তা-ও নিশ্চিত নয়। এ অবস্থায় নির্বাচন হলে বিএনপি, জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলনের মধ্যে লড়াই হবে।
নগরীর ২০ নম্বর ওয়ার্ডের ব্যবসায়ী এনামুল হক বলেন, জোট ছাড়া জাতীয় পার্টি অচল। এখন আওয়ামী লীগ নেই। একটা সময় মানুষ আবেগতাড়িত হয়ে জাতীয় পার্টিকে ভোট দিত। এখন সেই আবেগ কেটে গেছে। জাতীয় পার্টি এককভাবে নির্বাচন করেও তেমন একটা ভালো করতে পারবে বলে মনে হয় না।
তিনি আরো বলেন, ৫৪ বছরের ইতিহাস এবং বিগত ১৬ বছরের ইতিহাস পর্যালোচনা করে সাধারণ মানুষ পরিবর্তন চায়। এ পরিবর্তন জামায়াতে ইসলামীর হাত ধরেই হবে। রংপুর-৩ আসনের মানুষ এবার সেই পরিবর্তনের ধারায় জামায়াতের প্রার্থীর পক্ষে রায় দেবেন বলে আশা করছি।
জানতে চাইলে মনোনয়নপ্রত্যাশী রংপুর মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য ও সাবেক শহর কমিটির সভাপতি কাওছার জামান বাবলা বলেন, এর আগে রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছি। জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও মনোনয়ন কিনেছি। এবার যেহেতু সিটি করপোরেশন নির্বাচনের আগে সংসদ নির্বাচন হতে পারে, তাই আমিও বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশা করছি।
মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক সামসুজ্জামান সামু বলেন, আমি বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী। সেই লক্ষ্যে নির্বাচনি এলাকায় গণসংযোগ শুরু করেছি। আশা করছি, সব দিক বিবেচনা করে দল আমাকে মনোনয়ন দেবে।
সাবেক ছাত্রনেতা ও রংপুর জেলা বিএনপির সদস্যসচিব আনিছুর রহমান লাকু বলেন, আমি দীর্ঘদিন ধরে বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে বিভিন্ন সময়ে নির্যাতনের শিকার হয়ে একাধিকবার কারাবন্দি ছিলাম। এই এলাকার সাধারণ মানুষের সুখে-দুখে সব সময় পাশে থেকেছি। তাদের ভালোমন্দ আমার জানা আছে। তাই মনে করি, দল যদি আমাকে মনোনয়ন দেয় তাহলে আমি ভালো করতে পারব।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় বিএনপির এক নেতা বলেন, এই আসনে বিএনপির প্রার্থী বাছাইয়ে ভুল করলে খেসারত দিতে হতে পারে। এর আগে বহিরাগত একজনকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছিল। এতে স্থানীয় নেতাকর্মীদের মাঝে অসন্তোষ দেখা দেয়। সাধারণ ভোটাররাও তাকে সেভাবে জানতেন না। হুট করে এসে মনোনয়ন নিয়ে নির্বাচন করলে হিতে বিপরীত হতে পারে।
তিনি আরও বলেন, যার সঙ্গে নেতাকর্মীদের সার্বক্ষণিক যোগাযোগ থাকে, সাধারণ মানুষের সঙ্গে যার সব সময় ওঠাবসা এমন কাউকে মনোনয়ন দেওয়া উচিত বলে মনে করি।
জামায়াতের প্রার্থী অধ্যাপক মাহবুবুর রহমান বেলাল বলেন, নির্বাচনের প্রাথমিক কাজ হিসেবে বিভিন্ন কেন্দ্র ও ওয়ার্ডে কমিটি গঠনের কাজ চলছে। আমরা বিভিন্ন এলাকায় যাচ্ছি। সাধারণ মানুষ পরিবর্তন চায়। এই পরিবর্তন জামায়াতে ইসলামীর হাত ধরেই হবে। রংপুর-৩ আসনের মানুষ জামায়াতের প্রার্থীর পক্ষে রায় দেবেন বলে আশা করছি।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থী আমিরুজ্জামান পিয়াল বলেন, এবার মনোনয়ন দেওয়ার আগে কেন্দ্রীয়ভাবে প্রার্থীদের অবস্থান যাচাই করে দেখা হয়েছে। মাঠ পর্যায়ে সাধারণ মানুষের ভালোই সাড়া পাচ্ছি। আশা করছি, ভালো কিছু হবে।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রংপুর-৩ আসনে মোট ভোটার ছিলেন ৪ লাখ ৯৪ হাজার ৭৬৮ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ২ লাখ ৪৭ হাজার ৪৭, নারী ভোটার ২ লাখ ৪৭ হাজার ২৯৪ এবং তৃতীয় লিঙ্গের ভোটার দুজন। আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এ আসন থেকে কতজন ভোটার তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করবেন, সে তথ্য এখনো জানা যায়নি।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন