জুলাই আন্দোলনের সময়কার হত্যা মামলায় কনটেন্ট ক্রিয়েটর তৌহিদ আফ্রিদি গ্রেপ্তার হওয়ার পর মুনিয়া হত্যা মামলা নতুন মোড় নিতে শুরু করেছে। মুনিয়ার সঙ্গে তৌহিদ আফ্রিদির ফাঁস হওয়া ফোনালাপ, ভুক্তভোগী আরেক নারীর অভিযোগ ইঙ্গিত করছে গোপন ষড়যন্ত্রের। মুনিয়ার বাসায় আফ্রিদির নিয়মিত যাতায়াতের বিষয়টি তাদের আলাপেই উঠে এসেছে। ড্রাংক হয়েও আফ্রিদি দেখা করেছেন মুনিয়ার সঙ্গে। সেই রাতে কী হয়েছিল দু’জনের মধ্যে? এসব মিলিয়ে দেখলে মুনিয়া হত্যাকান্ডের রহস্য ভিন্ন দিকে মোড় নিতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
ভুক্তভোগী এক নারী সরাসরি গণমাধ্যমে অভিযোগ করে বলেন,আমাকে উদ্দেশ্য করে তৌহিদ আফ্রিদী বলেছেন-‘মুনিয়ার যেরকম অবস্থা হয়েছে,তারও ঠিক সেরকম অবস্থা হবে।’ ফলে মুনিয়া হত্যার সঙ্গে তৌহিদ আফ্রিদির স্পষ্টতই দায় দেখছেন নেটিজেনরা।
মূলত আফ্রিদি-আনিসুল হক-আসাদুজ্জামান খান কামাল-ডিবি হারুনদের ষড়যন্ত্রে ফাঁসিয়ে দেওয়া হয় শীর্ষ ব্যবসায়ী সায়েম সোবহান আনভীরকে। মামলার চূড়ান্ত তদন্তে আনভীরের কোনো সংশ্লিষ্টতা পায়নি পুলিশ। তবে ধনাঢ্য ব্যবসায়ীকে বলির পাঠা বানিয়ে তার কাছ থেকে মোটা অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নেয়ার জন্যই মূলত ছক এঁকেছিল আফ্রিদি-হারুন-কামাল ও আনিসুল হক গংরা। জুলাই আন্দোলনের পর ওঠে আসা নানান ঘটনাপ্রবাহে দেখা গেছে অর্থের জন্য এহেন অপকর্ম নেই যা তারা করেননি। আফ্রিদির সরকারের দালালি আর ডিবি হারুণের সঙ্গে ঘনিষ্টতা প্রমাণ করে মুনিয়ার মৃত্যুকে ভিন্ন খাতে নিতে এরা সবাই একযোগে কাজ করেছেন।
কিন্তু সত্য কখনো গোপন থাকে না। আফ্রিদি আটক হওয়ার পর মুনিয়ার সঙ্গে তার ফোনালাপ ও ভুক্তভোগী একাধিক নারীর বক্তব্যে এখন ফেঁসে যাচ্ছেন মুনিয়া হত্যা মামলার এই মূল হোতা। মুনিয়া হত্যার ঠিক পর পর ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করলেও বড় ষড়যন্ত্রের গন্ধ পাওয়া যায়। দেশের ইতিহাসে এতো দ্রুততম সময়ে হত্যা মামলা হওয়া এবং তার চেয়েও দ্রুত আদালতের নির্দেশ প্রমাণ করে এগুলো সবই আসলে পূর্ব পরিকল্পিত। সেদিন কোনো প্রমাণ ছাড়াই উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে সায়েম সোবহান আনভীরকে প্রধান আসামি করে মামলা দায়ের করা হয়। আর মামলা দায়েরের মাত্র ১৪ ঘন্টার মধ্যে আনিসুল হকের প্রভাবে আদালত দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ী সায়েম সোবহান আনভীরসহ আসামীদের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। যা যে কোনো হত্যা মামলা বা এ ধরণের ঘটনার জন্য ইতিহাসের সবচেয়ে দ্রুততম সিদ্ধান্ত। তাও আবার কার বিরুদ্ধে? দেশের অন্যতম শীর্ষ শিল্পগ্রুপ বসুন্ধরা গ্রুপের এমডির বিরুদ্ধে। বোঝাই যাচ্ছে এটা আসলে অনেক বড় ষড়যন্ত্রের অংশ। আর এগুলো সবই কামাল-হারুন-আফ্রিদি-আনিসুল হক গংদের ক্ষমতার তেলেসমাতি। অর্থের লোভে যে কাউকে ফাঁসিয়ে দেয়ার জন্য এরা সিদ্ধহস্ত।
একটু পেছন ফিরে তাকানো যাক। মুনিয়া যখন নিহত হন, তখন ছিল রমজান মাস। ইফতারির ১ ঘন্টা আগে মুনিয়া ও তার বোনের ফোনালাপে জানা যায়, ইফতারির পর দুই বোন মিলে শপিং করবে। ইফতারির পরে বড় বোন এসে দেখে মুনিয়া আত্মহত্যা করছে। তার ঝুলন্ত শরীর নীচে নামানোর এক ঘন্টার মধ্যেই এটাকে হত্যা মামলায় রূপান্তর করে মামলা দায়ের করা হয়। সেদিন রাত ৮টা বা সাড়ে ৮টার দিকেই মামলা রুজু হয়। পরদিন সকালেই আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী আসামীদের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। বোঝাই যাচ্ছে গোটা ষড়যন্ত্রের সঙ্গে মুনিয়ার বোনও কমবেশি জড়িত ছিল। মূলত কামাল-হারুন-আফ্রিদিদের উসকানি-সমর্থন এবং অর্থের লোভে তিনিও দিশেহারা হয়ে পড়েন। আর শীর্ষ ব্যবসায়ীকে ফাঁসাতে পারলে মাঠ গরমের পাশাপাশি মোটা অর্থ আত্মসাতের সুযোগ কে না নিতে চাইবে?
সোশ্যাল মিডিয়ায় আফ্রিদি মুনিয়ার কনভারসেশন এখন টক অব দ্যা কান্ট্রি। একটি ফোনকলে মুনিয়াকে আফ্রিদিকে উদ্দেশ্যে করে বলতে শোনা যায়- রস-কস থাকবে না। প্রত্যুত্তর তৌহিদ আফ্রিদি বলছে, ওর রস-কস থাকবে না বিয়ের পর। বিয়ের আগেই রস.. বিয়ের পরের। মুনিয়াকে বলতে শোনা যায়, উনি কিভাবে বলল, উনাকে আমি কি, তোমার উপরে কিচ্ছু..
আরেকটি ফোন কলে মুনিয়া বলছে, হ্যাঁ! কোথায় তুমি, কই, কি করো। তৌহিদ আফ্রিদি বলেন, এই যে, আমি এই যে, আমি রাতের মধ্যে আসতেছি। মুনিয়া বলেন, ও, কোথায় আসবা? আফ্রিদি বলেন, তোমাকে পিক করবো রাতে। মুনিয়া বলেন, আচ্ছা, ফোন দিও।
আরেকটি ফোন কলে শোনা যায়, হ্যাঁ, কোথায় তুমি? আফ্রিদি বলেন, অফিসে, অফিসে কাজে। মুনিয়া বলেন, অফিসে কি গাড়ি চালাও, হা হা হা! আফ্রিদি বলেন, না না অফিসে। মুনিয়া বলেন, আচ্ছা, এখন কি করবো বলো একটু? আফ্রিদি বলেন, কি করবা? মানে বুঝি নাই। মুনিয়া বলেন, মানে, আজকে দেখা করবা না আমার সাথে একটু? আফ্রিদি বলেন, রাতে রাতে।
আরেকটি ফোন কলে শোনা যায়, আফ্রিদি বলেন, না আমি মানে, মাত্র ইন্টারকন্টিনেন্টাল থেকে থেকে বের হচ্ছি। আমার কথা হচ্ছে, আমি আসতে পারবো, কোন সমস্যা নেই। আমি একটু একটু ড্রাংক। তবে, চলবে? মুনিয়া বলেন, না, সমস্যা কি? ড্রাংক! আফ্রিদি বলেন, আচ্ছা। মুনিয়া বলেন, ওই কাবাইকাবা, আফ্রিদি বলেন, হ্যা! বুঝি নাই। মুনিয়া বলেন, কাইকাবা গাঁধা কোথাকার! আফ্রিদি বলেন, গাঁধা কেন? মুনিয়া বলেন, এত ন্যাচারালভাবে কথা বলতে পারতা? আফ্রিদি বলেন, হ্যাঁ! আমি ন্যাচারালি কথা বলি। আর হ্যাঁ! এক পারসেন্ট। এটা তোমাকে জানায়া রাখলাম। আমি রাতে আসতেছি। এসময় মুনিয়া বলেন, এত দুষ্টু ক্যান তুমি?
মূলত তৌহিদ আফ্রিদি ও তার বাবাকে নিয়ে করা বাংলা এডিশনের একটি বিশেষ ক্রাইম রিপোর্টে এসব ওঠে আসে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জুলাই আন্দোলন চলাকালে তৌহিদ আফ্রিদি দেশের জনপ্রিয় কনটেন্ট ক্রিয়েটরদের হুমকি দিয়ে সরকারের পক্ষে কাজে লাগানোর চেষ্টা চালিয়েছেন। তাছাড়া, আফ্রিদির বিরুদ্ধে বেশ কয়েকজন নারীকে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে শারীরিক সম্পর্ক করার অভিযোগও উঠেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নারী জানান, দীর্ঘদিন সম্পর্কে থাকার পর আফ্রিদি হঠাৎ করেই তাকে ছুড়ে ফেলে দেয়। পরে তাকে ডিবি অফিসে ডেকে গায়েব করে দেওয়ার হুমকি দেওয়া হয়। ফলে সংসার করার স্বপ্ন শেষ হয়ে যায় তার।
ওই নারী আরও বলেন ‘আমি জানতে পারি, বিভিন্ন মেয়ের সঙ্গে তার (আফ্রিদির) সম্পর্ক আছে। মুনিয়া নামের একটা মেয়ে আছে, তার সঙ্গেও আফ্রিদির সম্পর্ক। এগুলো জেনে ওর সাথে আমি একটু রাগারাগি করি। এটা স্বাভাবিক, আমার একটু খারাপ লাগতেই পারে। আমি যেহেতু ওকে ভালোবেসে ফেলেছি। তো, ওকে আমি বলার পরে খুব বাজেভাবে রিঅ্যাক্ট করে। এক সময় এরকমও বলে, মুনিয়ার যেরকম অবস্থা হয়েছে, আমারও ঠিক সেরকম অবস্থা হবে। মানে, ইনডিরেক্টলি ও আমাকে হত্যার হুমকিই দেয়।’
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ওই নারীর অভিযোগের সূত্র ধরে কিছু ফোন রেকর্ড হাতে আসে। যেখানে মুনিয়ার বাসায় আফ্রিদির যাতায়াত এবং ঘনিষ্ঠতার প্রমাণ মেলে। মুনিয়ার সাথে আফ্রিদির সম্পর্ক এবং আরেক প্রেমিকার সাক্ষ্য মিলিয়ে দেখলে হত্যাকান্ডের রহস্য ভিন্ন দিকে মোড় নিতে পারে।
তৌহিদ আফ্রিদির বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত দুইটি মামলার তথ্য পাওয়া গেছে। এর মধ্যে যাত্রাবাড়ী থানার মামলায় অভিযোগ করা হয়েছে, জুলাই আন্দোলনে আসাদুল হক বাবু নামের এক বিক্ষোভকারীকে হত্যার পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে তিনি জড়িত।
আরেকটি মামলা হয়েছে বাড্ডা থানায়। এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে, ২০২৪ সালের ২০ জুলাই মধ্য বাড্ডা ফ্লাইওভারের নিচে অবৈধ অস্ত্র দিয়ে আন্দোলনকারীদের ওপর এলোপাতাড়ি গুলি চালায় আফ্রিদি।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন