যশোরের চৌগাছা উপজেলার মাকাপুর গ্রামে দীর্ঘ বছর ধরে জমি নিয়ে একই পরিবারের দুই পক্ষের বিরোধের জেরে ধ্বংসের মুখে পুরো গ্রাম। হায়দার ধনী পরিবারের কোন্দলের জেরে শান্তিপ্রিয় গ্রামটি চরম সংকটে।
পরিবারের দুই পক্ষের হয়ে পাল্টাপাল্টি মামলায় সাধারণ কৃষক, নারী, শিশুসহ পুরো গ্রামবাসীর মধ্যে বিরাজ করছে আতঙ্ক। ছেলে ও মায়ের পক্ষ হয়ে গ্রামের কিছু সুবিধাভোগী ব্যক্তি, অন্য পক্ষের কৃষক-সাধারণ মানুষকে ফাঁসাতে পরিস্থিতি ঘোলাটে করে আসছে। দীর্ঘ ঘটনার জেরে গ্রামবাসী এবং প্রশাসনের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে দ্বন্দ্ব।
তথ্য মতে, সাবেক উপজেলা আওয়ামী লীগ চেয়ারম্যন এস এম হাবিব ও তার বডিগার্ড গান বাবুল ব্যারিস্টার রাসেলের কাছ থেকে এককালীন ছয় লাখ টাকা চাঁদা গ্রহণ করে জমিসংক্রান্ত পারিবারিক সমস্যা সমাধান না করে আরো জটিল করেছেন। তার পর থেকে আর্থিক সুবিধা আদায় করে গ্রামের দুই মাদক ব্যবসায়ী আশরাফুল, রফিকুলসহ সুবিধাভোগী ধনী পরিবারের বর্গাচাষি মো. ছামছার, হামজা, বাবুরালি, শহিদুল, আনিছুর হুজুর, লাল্টুসহ স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারা ব্যারিস্টার রাসেল এবং রুবেলকে নানা কুপরামর্শ দিয়ে জটিল পরিস্থিতি তৈরি করে আসছে।
অভিযোগ রয়েছে, অর্থ প্রদান ছাড়া (মাগনা) জমিচাষসহ বিশেষ আর্থিক সুবিধা পেতে মো. ছামছার, বাবুরালি, শহীদুলসহ আরও কিছু ব্যক্তি অতিউৎসাহী হয়ে মিথ্যা মামলা করে আসছে গ্রামের সাধারণ মানুষকে ফাঁসাতে। গ্রামবাসী বিভিন্ন সময় সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নিয়ে ধনী পরিবারের দুই সন্তান রাসেল ও রুবেলের সঙ্গে কথা বললে সেখানে বাধা দেন সুবিধাভোগী বর্গাচাষিরা।
গ্রামবাসীর দেওয়া তথ্য মতে, শহিদুল নিজের হাত নিজে কেটে মিথ্যা মামলা এবং বাবুরালি নিজের বউয়ের শ্লীলতাহানির মিথ্যা তথ্য দিয়ে মানুষকে ফাঁসায়। তারা বলেন, ২৪-এর জুলাই অভ্যুত্থানের আগে তাদের এসব মামলায় উৎসাহ দিতেন তৎকালীন চৌগাছা থানার ওসি। ছামছার, শহিদুল এবং বাবুরালির বেশ কিছু ভিডিও পাওয়া গেছে। যেখানে তাদের মিথ্যা তথ্য এবং গ্রামবাসীকে হুমকি দেওয়ার প্রমাণ রয়েছে।
জানা যায়, দুই পক্ষের বর্গাচাষিরা রুবেল এবং রাসেলকে নানা সময় অসত্য তথ্য দিয়ে কৌশলে টাকা আদায় করে আসছে। একই সাথে, রাসেলের পৈতৃক সম্পত্তি বর্গা নিয়ে কোনো রকম অর্থ না দিয়ে ভোগ করায় ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে। এদিকে, বর্তমানে বিভিন্নভাবে ঘুষ ও চাঁদা গ্রহণের মাধ্যমে কৃষকদের হয়রানি করে যাচ্ছেন বর্তমান চৌগাছা থানার এসআই মারুফ। দীর্ঘ ৮ মাস যাবৎ ভয় প্রদর্শন, হয়রানি, ধরপাকড় ও জেল খাটানোর হুমকি দিয়ে অর্থ গ্রহণের অভিযোগ রয়েছে। অভিযোগ রয়েছে রাসেল ও রুবেল দুই পক্ষের কাছ থেকে ঘুষ গ্রহণের। এক ভুক্তভোগী নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন, এসআই মারুফ খুবই চালাক। সরাসরি টাকা দাবি না করে কৌশলে হুমকি ও ভয় দেখান।
ধনী পরিবারের সমস্যা সমাধানে স্থানীয় ও উপজেলার বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা চেষ্টা করলেও সমাধান না হওয়ায় তারাও বিরক্ত বলে জানান। জুলাই অভ্যুত্থানের পর চৌগাছা থানার সাবেক ওসি পায়েল সমাধানের উদ্যোগ নিলে সুবিধাভোগী বর্গাচাষিদের ক‚টকৌশলে তা সম্ভব হয়নি। অভিযোগ রয়েছে, মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে কিছু বিএনপি নেতা আবারও সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ গ্রহণ করেন, তবে কার্যত আরও জটিল পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়।
তথ্য মতে, মৃত হায়দার আলীর বিরোধপূর্ণ ৩৯ বিঘা ফসলি জমি নিয়ে ব্যারিস্টারপুত্র এ কে এম মর্তুজা রাসেল ও তার মা লতিফা হায়দারসহ দুই ভাই রুবেল, বাবু, তিন বোন লাকি, বিউটি এবং লাভলির মধ্যে সমস্যার সূত্রপাত। রাসেল অভিযোগ করেন, তার বাবা তার ফুফুদের প্রাপ্য জমি না দিয়ে তাদের ভাই-বোনদের নামে দলিল করা হয়েছে।
অন্যদিকে রুবেলসহ পরিবারের অন্যদের অভিযোগ, ফলসি জমিতে পরিবারের বাইরে অন্য কারো অংশ নেই। রাসেলের বর্গাচাষিদের মামলার জেরে তার ভাই রুবেলের বর্গাচাষিরা মামলা দায়ের করতে থাকেন। যেসব মামলার বেশির ভাগ আসামি গ্রামের নিরীহ বর্গাচাষি, মজুর ও প্রান্তিক কৃষক। পাল্টাপাল্টি মামলার জেরে গ্রামের প্রতিটি পরিবার কোনো না কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত, যা পুরো গ্রামকে ধ্বংস করে দিয়েছে বলে দাবি করেন গ্রামের প্রবীণরা।
ব্যারিস্টার রাসেল বলেন, পরিস্থিতির শিকার তিনি। তার বাবার সম্পত্তির বিশেষ কোনো প্রয়োজন নেই। বর্তমানে লন্ডনে যে পেশায় আছেন এবং সেখানে তার যে সম্পদ রয়েছে, দেশের সম্পদের প্রয়োজন নেই। তিনি জানান, একটি শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য অপেক্ষা করছেন। তবে তার ভাই-বোন এবং নিজের মা সেই সঠিক সমাধান মানতে নারাজ। একই সঙ্গে গ্রামের কিছু মানুষ কুপরামর্শ দিয়ে জটিল পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে।
তিনি বলেন, ২০২৩ সাল থেকে এখন পর্যন্ত রাজনৈতিক নেতাকর্মী, প্রশাসন থেকে শুরু করে গ্রামের লোকজন তার থেকে প্রায় ৩ কোটি টাকা নিয়েছে। সেই টাকা কাকে কীভাবে দিয়েছি, তার সম্পূর্ণ প্রমাণ রয়েছে তার কাছে। বর্তমান সম্যসার বিষয়ে অবগত আছেন জানিয়ে বলেন, দেশের আইন মেনে সুষ্ঠু সমাধানে তার আপত্তি নেই। লন্ডনপ্রবাসী রুবেল বলেন, সম্পত্তির জের ধরে যে সমস্যার সূত্রপাত তার সমাধান চাই। যারা মামলা করেছে তারা হয়রানিমূলক সব মামলা তুলে নিক।
চৌগাছা থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) আনোয়ার হোসেন জানান, ব্যারিস্টার পরিবারের অনেক জমি রয়েছে। এই জমি নিয়েই তাদের ভাই-বোনদের মধ্যে দীর্ঘ বছর ধরে দ্ব›দ্ব চলে আসছে। স্থানীয় একটি মহলের সুবিধার্থে পরিবারটির দ্বন্দ্ব এই পর্যায়ে পৌঁছেছে। এলাকার দুই পক্ষ তাদের দুই ভাইকে শেল্টার দিয়ে থাকে। যে কারণে তারা কেউ কাউকে ছাড় দিতেও নারাজ।
ওসি জানান, পুলিশের ওপর হামলার ঘটনায় মামলায় এই পর্যন্ত ৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। নিরীহ মানুষকে মামলায় আসামি করা হয়নি। মামলার পর থেকে আতঙ্কে অনেকেই গ্রামছাড়া। তবে নিরীহ মানুষ যাতে হয়রানি না হয় সেদিকে খেয়াল রাখা হচ্ছে। গ্রামবাসীর নিরাপত্তায় পুলিশ সর্বদা প্রস্তুত।