অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে ‘বৈষম্যবিরোধী’ চেতনার বাজেটেও অপ্রদর্শিত আয় বা কালো টাকা বৈধ করার যে সুযোগ রাখা হয়েছে, তা থাকবে, না বাদ দেওয়া হবে সে বিষয়ে উপদেষ্টা পরিষদ চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিবে। ফলে আজ রোববার বাজেট পাশের পরই তা জানা যাবে কালো টাকার সুযোগ থাকবে, না বাতিল হবে। তাই প্রস্তাবিত বাজেট বড় ধরনের কোনো পরিবর্তন ছাড়াই উপদেষ্টা পরিষদে উপস্থাপন হতে যাচ্ছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে।
জাতীয় সংসদ না থাকায় আজ রোববার অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে জাতীয় বাজেট পাস হবে। সকাল ১০টায় এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। এর আগে অর্থ উপদেষ্টা গত ২ জুন জাতির সামনে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট উপস্থাপন করেন।
এদিকে বাজেট প্রস্তাবের ওপর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার অনলাইনের মাধ্যমে প্রস্তাব পেয়েছে, এর সংখ্যা বা কি ধরনের প্রস্তাব পেয়েছে তাও প্রকাশ করেনি। ফলে সরকার এসব প্রস্তাব বা পরামর্শ থেকে কি পেয়েছে বা কি গ্রহণ করবে তাও অজানাই রয়ে গেছে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান কয়েকজন সাংবাদিককে বলেন, কালো টাকার বিষয়টি উপদেষ্টা পরিষদ সিদ্ধান্ত নিবে। এ বিষয়ে এনবিআর কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি।
তবে এনবিআরের আয়কর অনুবিভাগের এক কর্মকর্তা বলেছেন, উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকেও এ নিয়ে তীব্র সমালোচনা হওয়ায় এ সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসে নতুন করে অধ্যাদেশ জারি করা হতে পারে বলে আভাস পাওয়া গেছে। এই সুযোগ না রাখার বিষয়ে তাদের মধ্যে নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে যে এটা থাকবে না।
সূত্র জানিয়েছে, কালো টাকার বিষয়টি এমন এক পর্যায়ে গেছে যে, নতুন অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে যে সুবিধা দেওয়া হয়েছে তা তো থাকবেই না। এমনকি চলতি অর্থবছর যে সুবিধা আছে তাও বাতিল করা হবে। তবে সবকিছু চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিবে উপদেষ্টা পরিষদ।
এনবিআর সূত্র বলছে, অপ্রদর্শিত অর্থে আবাসন খাতে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে যেভাবে কর বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে, তাতে বাস্তবে কেউ ওই সুবিধা নেবেন না বলেই এনবিআর কর্মকর্তারা মনে করছেন। তবে এ বিষয়ে সরকারের তরফ থেকে আনুষ্ঠানিক কোনো ঘোষণা আসেনি। ফলে আজকের উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠক থেকেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসবে।
জানা গেছে, স্বাধীন বাংলাদেশে শুরু থেকেই বিভিন্ন সরকার কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দিয়ে আসছে। স্বাধীন বাংলাদেশে ২১ বার এ সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। সর্বশেষ ২০২৪-২৫ অর্থবছরে কর্তৃত্ববাদী সরকারের সর্বশেষ বাজেটেও বিনা প্রশ্নে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ বহাল ছিল।
এদিকে কালো টাকা সাদা করার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সব সুযোগ অধ্যাদেশের মাধ্যমে চিরতরে বাতিলের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। সংস্থাটি মনে করে, অন্তর্বর্তী সরকারের এ উদ্যোগ রাষ্ট্রীয় সংস্কার, বিশেষ করে দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কারের মূল উদ্দেশ্যের বিপরীত। যা অনৈতিক, বৈষম্যমূলক ও সংবিধান পরিপন্থি।
আর সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, এতে বৈধ পথে উপার্জনকারীদের সঙ্গে বৈষম্য তৈরি হবে। তা ছাড়া এই পদক্ষেপে সরকারের খুব বেশি আয় হবে বলে মনে হয় না।
বাজেট উপস্থাপনের পরদিন রাজধানীর ওসমানী মিলনায়তনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ বিষয়ে প্রশ্নের মুখে অর্থ উপদেষ্টা স্বীকার করেন যে, অপ্রদর্শিত আয় বৈধ করার সুযোগ রাখা ভালো কিছু হয়নি। তিনি সেদিন বলেন, অনেকের একটা প্রশ্ন যে- কালো টাকা সাদা করতে দেওয়া হলো কেন। কালো টাকা কিন্তু ঠিক কালো টাকা না।
আমরা যেটা বলেছি যে-অপ্রদর্শিত টাকা, কোনো কারণে যদি আপনার কাছে থাকে, শুধু ফ্ল্যাটের ব্যাপারে একটা বিধান দেওয়া হয়েছে। এর দুটো দিক আছে। একটা নৈতিক দিক- কালো টাকা সাদা করা, আরেকটা হলো প্র্যাক্টিক্যাল দিক- টাকা-পয়সা আমরা ট্যাক্স পাব কি না। দুই দিকেই কালো টাকা সাদা করার বিষয়ে অবশ্যই কিছু একটা হবে, সেটা আমরা বিবেচনা করব।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান আব্দুর রহমান খান বলেন, ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে কালো টাকা সাদা করার জন্য আগের মতো কোনো বিশেষ সুযোগ নেই। তবে দুটি ক্ষেত্রে অতিরিক্ত কর পরিশোধ করে ব্যবহারের সুযোগ রাখা হয়েছে।
এর একটি হলো কেউ নিজের জমিতে অপ্রদর্শিত অর্থ দিয়ে যদি বাড়ি তৈরি করেন, তাহলে দ্বিগুণ কর দিয়ে তা ব্যবহার করতে পারবেন। তবে তার বিরুদ্ধে অন্য কোনো সংস্থা প্রশ্ন করতে পারবে না, বিষয়টা কিন্তু তা নয়। অন্যান্য সংস্থার প্রশ্ন তোলার সুযোগ আছে।
দ্বিতীয় সুযোগটি হলো ফ্ল্যাট ক্রয়ের ক্ষেত্রে। এ ক্ষেত্রে আমরা কর পাঁচগুণ করে দিয়েছি। এটা খুব ব্যয়বহুল হয়েছে। তারপরও অনেকেই যেহেতু এটা নিয়ে কথা বলতেছে, আমার মনে হয়, স্যার (অর্থ উপদেষ্টা) সবাই আলোচনা করে চিন্তা করতে পারেন কি করবেন।
কী বিধান এসেছিল বাজেটে বর্তমানে ঢাকার গুলশান মডেল টাউন, বনানী, বারিধারা, মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকা ও দিলকুশা বাণিজ্যিক এলাকায় অবস্থিত ২০০ বর্গমিটারের আয়তনের ভবন বা অ্যাপার্টমেন্টে প্রতি বর্গমিটারে ছয় হাজার টাকা বিনিয়োগে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ রয়েছে।
বাজেটে বলা হয়েছিল, আগামী অর্থবছর থেকে প্রতি বর্গফুটে দুই হাজার টাকা করে; অর্থাৎ বর্গমিটারে (১০ দশমিক ৭৬৩৯ বর্গফুট) ২১ হাজার ৫৩০ টাকা খরচ করলে এই সুবিধা পাওয়া যাবে।
এবার ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে এসব এলাকায় অনধিক ২০০ বর্গমিটার পর্যন্ত কর দিতে হবে প্রতি বর্গফুটে ৯০০ টাকা করে। তাতে প্রতি বর্গমিটারে কর দিতে হবে ৯ হাজার ৬৮৮ দশমিক পাঁচ টাকা।
বর্তমানে ঢাকার গুলশান মডেল টাউন, বনানী, বারিধারা, মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকা ও দিলকুশা বাণিজ্যিক এলাকায় অবস্থিত অনধিক ২০০ বর্গমিটার আয়তনের ভবন বা অ্যাপার্টমেন্টে প্রতি বর্গমিটারে চার হাজার টাকা বিনিয়োগে কালো টাকা সাদা করা যায়।
বাজেটে বলা হয়, এ ধরনের ভবন বা অ্যাপার্টমেন্ট ও ফ্ল্যাট কেনার ক্ষেত্রে নতুন অর্থবছরে প্রতি বর্গফুটে ১ হাজার ৮০০ টাকা করে, অর্থাৎ প্রতি বর্গমিটারে ১৯ হাজার ৩৭৭ টাকা কর দিতে হবে। এভাবে এলাকাভেদে প্রতি ক্ষেত্রেই কর হার বাড়ানো হয়েছে।
এর আগে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ১৫ শতাংশ কর পরিশোধ করলে বিনা প্রশ্নে অপ্রদর্শিত অর্থ, নগদ টাকা ও শেয়ারসহ যেকোনো বিনিয়োগ ঢালাওভাবে বৈধ করার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। একইসঙ্গে জমি, ফ্ল্যাট, অ্যাপার্টমেন্ট কিনে থাকলেও এলাকা অনুযায়ী বেঁধে দেওয়া কর দিয়ে প্রশ্ন ছাড়াই সেগুলো বৈধ করার সুযোগ রাখা হয়েছিল তখন।
গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দেশের হাল ধরা মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের তরফে বারবার বলা হয়েছিল, তারা কালো টাকা বা অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগ করে সাদা করার সুযোগ রাখবে না।
গত সেপ্টেম্বরে সরকার কালো টাকা সাদা করার সুযোগ বাতিল করে। তবে তখন আবাসন খাত তথা ফ্ল্যাট বা ভবনে বিনিয়োগের এ সুযোগ বাতিলের কথা না বলায় এ বিধান বলবৎ থেকে যায়। এবার করের হার পাল্টে হলেও সে সুযোগ রাখার কথা বলা হয়েছিল বাজেটে।
বাজেট কাঠামো প্রস্তাবিত ব্যয়: আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য মোট সাত লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের প্রস্তাব করা হয়েছে, যা জিডিপির ১২.৭ শতাংশ। এর মধ্যে পরিচালনসহ অন্যান্য খাতে মোট পাঁচ লাখ ৬০ হাজার কোটি এবং বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে দুই লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। ২০১৫ সালের পর অদ্যাবধি কোনো বেতন কাঠামো প্রণীত না হওয়ার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে এবারের বাজেটে সরকারি কর্মচারীদের জন্য বিশেষ সুবিধার পরিমাণ বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে।
প্রস্তাবিত রাজস্ব আয়: আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরে মোট পাঁচ লাখ ৬৪ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আয়ের প্রস্তাব করা হয়েছে, যা জিডিপির ৯.০ শতাংশ। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের মাধ্যমে চার লাখ ৯৯ হাজার কোটি এবং অন্যান্য উৎস থেকে ৬৫ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহ করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
প্রস্তাবিত বাজেট ঘাটতি ও অর্থায়ন: আগামী অর্থবছরে আমারে সামগ্রিক বাজেট ঘাটতি ও ঋণ সহনীয় পর্যায়ে রাখা হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়াবে দুই লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকা, যা জিডিপির ৩.৬ শতাংশ।
প্রস্তাবিত বাজেটে মোট ঘাটতির মধ্যে এক লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে, এরমধ্যে জাতীয় সঞ্চয়পত্র থেকে সংগ্রহ করা হবে ১২ হাজার ৫০০ কোটি এবং এক লাখ এক হাজার কোটি টাকা বৈদেশিক উৎস হতে নির্বাহ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। আগামী অর্থবছরে সুদ পরিশোধ বাবদ মোট ব্যয় ধরা হয়েছে এক লাখ ২২ হাজার কোটি টাকা।
২০২৫-২৬ অর্থবছরে এডিপি ধরা হয়েছে দুই লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। তবে নন-এডিপিসহ এই ব্যয় হবে দুই লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকা।
সরকার আগামী অর্থবছরের জন্য জিডিপির লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে ৫.৫ শতাংশ, যা টাকার অংকে হবে ৬২ লাখ ৪৪ হাজার ৫৭৮ কোটি টাকা। আর মূল্যস্ফীতি নির্ধারণ করা হয়েছে ৬.৫ শতাংশ।
আপনার মতামত লিখুন :