গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আস্থাভাজন হয়ে নানা অপকর্মে জড়িত এবং দুর্নীতির মাধ্যমে বিপুল সম্পদ অর্জনকারী দাপুটে ৫ সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা বিচারের মুখোমুখি হওয়ার ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। সরকারের নির্দেশ উপেক্ষা করে দীর্ঘদিন কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকায় চলতি সপ্তাহে ১৭ জন পুলিশ কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। তাদের মধ্যে এই ৫ জন আওয়ামী লীগ সরকার আমলে অত্যন্ত প্রভাবশালী ছিলেন। তারা সরকারি চাকরির নিয়ম ভঙ্গ করে জড়িয়ে পড়েছিলেন নানান অপকর্মে।
গত বছর ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর ভেঙে পড়ে পুলিশ বাহিনী। অনেক পুলিশ সদস্য কর্মস্থলে যোগদান করে কয়েকদিন পর উধাও হয়ে যান। অনেকে ছুটি নেন, অনেকে ছুটি না নিয়েই উধাও হন। তাদের অধিকাংশই দেশে ছেড়ে পালিয়ে গেছেন বলে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে। যে কয়জন দেশের মধ্যে পালিয়ে রয়েছেন তারাও দেশ ছেড়ে পালানোর চেষ্টা করছেন। গুম কমিশন ও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুানালে অভিযুক্ত পুলিশ কর্মকর্তা বিশেষ করে দাপুটে পাঁচজন বিচারের মুখোমুখি হওয়া এবং সম্ভাব্য সাজা থেকে বাঁচতে কর্মস্থলে অনুপস্থিত থেকে উধাও হন। হাসিনার আমলে টানা ১৫ বছর পুলিশ বাহিনীতে প্রভাব খাটানো অতি-দলবাজ হিসেবে চিহ্নিত কর্মকর্তাদের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। চাকরি হারানো ছাড়াও মামলা, গ্রেপ্তার ও জনরোষের ভয়েও রয়েছেন তারা।
সাবেক পুলিশ সুপার ছানোয়ার হোসেন ও গোলাম মোস্তফা রাসেল এবং অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এস এম শামীম, ইফতেখায়রুল ইসলাম ও মিশু বিশ্বাস দীর্ঘদিন ধরে পুলিশের বির্তকিত শীর্ষ কর্মকর্তাদের আশীর্বাদে প্রভাবের সঙ্গে সারাদেশ দাপিয়ে বেড়াতেন। সর্বশেষ গত বছরের জুলাই আন্দোলনে দমন-পীড়ন ও ছাত্র-জনতার ওপর সরাসরি গুলির সঙ্গে জড়িত ছিলেন।
গত রোববার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের পুলিশ-১ শাখা থেকে ১৪টি পৃথক প্রজ্ঞাপন প্রকাশ করে। গত ২৬ জুন প্রজ্ঞাপনগুলোতে সই করেন সিনিয়র সচিব নাসিমুল গনি। তাতে বরখাস্ত হওয়াদের মধ্যে দাপুটে এই ৫ পুলিশ কর্মকর্তাও রয়েছেন। দাপুটে এই ৫ পুলিশ কর্মকর্তা ছাত্রজীবনে ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তাদের পরিবারও আওয়ামী পরিবার হিসেবে পরিচিত। অভিযোগ রয়েছে ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে তারা বিপুল অবৈধ সম্পদের মালিক হয়েছেন। দেশে-বিদেশে গড়ে তুলেছেন কালো টাকার পাহাড়।
এদিকে, দীর্ঘদিন ধরে কর্মস্থলে যোগ না দেওয়ায় চট্টগ্রাম রেঞ্জের সাবেক ডিআইজি নূরে আলম মিনাসহ ৩ পুলিশ কর্মকর্তাকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে সরকার। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব নাসিমুল গনি স্বাক্ষরিত পৃথক প্রজ্ঞাপনে এই তথ্য জানানো হয়েছে। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, চট্টগ্রাম রেঞ্জের সাবেক ডিআইজি নুরে আলম মিনা (বর্তমানে সারদা পুলিশ লাইনে সংযুক্ত) চলতি বছরের ৯ ফেব্রুয়ারি থেকে কর্মস্থলে অনুপস্থিত রয়েছেন। এ কারণে ২০১৮ সালের চাকরিবিধির ১২ ধারা অনুযায়ী তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। অন্য দুজন হলেন, ঢাকা মহানগর পুলিশের সাবেক উপকমিশনার মানস কুমার পোদ্দার (রেঞ্জ পুলিশ, বরিশালে সংযুক্ত) গত বছরের ১৮ অক্টোবর থেকে কর্মস্থলে অনুপস্থিত। অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রহমতুল্লাহ চৌধুরী (বর্তমানে পুলিশ সুপার পদে পদোন্নতিপ্রাপ্ত, শিল্প পুলিশে সংযুক্ত)। তাকেও সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের বিশেষ শাখা এটিইউয়ের সাবেক পুলিশ সুপার (বরিশাল রেঞ্জ ডিআইজি কার্যালয়ে সংযুক্ত) মোহাম্মদ ছানোয়ার হোসেন বিনা অনুমতিতে গত ১ জানুয়ারি থেকে কর্মস্থলে অনুপস্থিত। ছানোয়ার বরখাস্ত হওয়া অতিরিক্ত আইজিপি মনিরুল ইসলামের নির্দেশ পালন করতেন। বিরোধী দল ও মত দমনে অসংখ্য মানুষকে জঙ্গি দমনের নামে গুম-খুনে সরাসরি জড়িত ছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে। ২০১৬ সালের ২৬ জুলাই ঢাকার কল্যানপুরের জাহাজবাড়িতে জঙ্গিবিরোধী অভিযানে নেতৃত্ব দেন ছানোয়ার। ওই অভিযানে সন্দেহভাজন ৯ জঙ্গি মারা যায়। হাসান নামে একজনকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় আটক করে পুলিশ। পালিয়ে যায় আরও একজন। তারা সবাই জেএমবির সদস্য বলে দাবি করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। পুলিশে চাকরিরত অবস্থায় সিনেমা পরিচালনাও করেন ছানোয়ার। ঢাকা অ্যাটাক সিনেমা পরিচালনার জন্য ২০১৭ সালে শেখ হাসিনার হাত থেকে জাতীয় পুরস্কারও নেন। গত ঈদে এশা মার্ডার নামে মুক্তি পাওয়া সিনেমার পরিচালক ছিলেন তিনি। জুলাই আন্দোল দমনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন ছানোয়ার।
নারায়ণগঞ্জ জেলার সাবেক পুলিশ সুপার (বর্তমানে বরিশাল রেঞ্জ ডিআইজি কার্যালয়ে সংযুক্ত) গোলাম মোস্তফা রাসেল গত ১ জানুয়ারি থেকে কর্মস্থলে অনুপস্থিত। নারায়ণগঞ্জে ওসমান পরিবারের ছত্রছায়ায় তিনি লাইসেন্সধারী সন্ত্রাসী হিসেবে পরিচিত পান। আওয়ামী পরিবারের সন্তান পরিচয় দিয়ে চাকরিজীবনে বিরোধী দল ও মত দমনে নিয়োজিত ছিলেন। ক্ষমতার অপব্যবহার করে রাসেল দেশে-বিদেশে বিপুল সম্পদের মালিক বনে যান।
ডিএমপির সাবেক এডিসি এস এম শামীম গত বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর থেকে কর্মস্থলে অনুপস্থিত রয়েছেন। গোপালগঞ্জের সন্তান অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এস এম শামীম পুলিশ বাহিনীতে মূর্তিমান আতঙ্ক ছিলেন। ব্যাচমেটরা তাকে কসাই নামে ডাকতেন। গোপালগঞ্জে বাড়ি হওয়ায় শেখ হাসিনার আত্মীয় পরিচয়ে দাপট দেখিয়ে চলতেন। আইজিপিও তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারতেন না। ডিএমপির রমনা জোনের (কলাবাগান-নিউমার্কেট থানা) সরকারি পুলিশ কমিশনার থাকাকালীন ওসিদের চেয়ারে বসে দুই থানার পুরোটাই নিয়ন্ত্রণ করতেন। ব্যবসায়ীদের থানায় ডেকে চাঁদাবাজি ও বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তারের নির্যাতন করা এবং জোরপূর্বক অর্থ আদায় নিত্যদিনের ঘটনা ছিলো। সে সময় একাধিক ঘটনায় সাংবাদিকদের কাছে অভিযোগ গেলে, সাংবাদিকরা জানতে চাইলেই থানায় ডেকে মামলার হুমকি দিয়ে নিউজ না করতে বাধ্য করতেন। জুলাই আন্দোলনে রাজধানীতে ছাত্র-জনতার গুলি করার ঘটনায় শামীমের নাম উঠে এসেছে।
ডিএমপির আরেক সাবেক এডিসি ইফতেখায়রুল ইসলামকে বদলি করা হয়েছিল কক্সবাজার এপিবিএনের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হিসেবে। সেখানে গত ১৬ ফেব্রুয়ারি থেকে তিনি অনুপস্থিত। আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনার পক্ষে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সক্রিয় উপস্থিতি লক্ষ্যণীয়। সরকার ও পুলিশের পক্ষে নানা পোস্ট দিয়ে জনমত গঠনে পারদর্শী ছিলেন। ওসমান পরিবারের জামাই হওয়ায় পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তারা তাকে সমীহ করতেন।
ডিএমপি ডিবির সাবেক এডিসি (বর্তমানে জামালপুর ইন-সার্ভিস ট্রেনিং সেন্টারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার) মিশু বিশ্বাস গত বছরের ২৬ অক্টোবর থেকে কর্মস্থলে অনুপস্থিত। ট্রায়াথলেট হিসেবে মালয়েশিয়ার আয়রনম্যান পুরস্কার জিতে খ্যাতি পাওয়া মিশু বিশ্বাস চাকরি জীবনের অধিকাংশ সময় ডিএমপির বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ইউনিটগুলোতে দায়িত্ব পালন করেন। নিজেকে আওয়ামীপন্থি ও হাসিনার পুলিশ পরিচয় দিতে পছন্দ করতেন। জুলাই আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর গুলি ছুড়েছেন তিনি।
পুলিশ সদর দপ্তর সূত্র জানায়, ছাত্র-জনতার আন্দোলনে অভিযুক্ত পুলিশ কর্মকর্তারা সরাসরি নির্দেশ দিয়েছেন গুলি চালাতে। আর নির্দেশনা বাস্তবায়ন করেছেন মাঠপর্যায়ের পুলিশ সদস্যরা। যারা এসব ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত, তাদের আইনের আওতায় আনা হবে। তার মধ্যে সাবেক কর্মকর্তাও আছেন। হত্যা মামলায় কিছু পুলিশ কর্মকর্তার নাম এসেছে। তবে তারা ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন না বলে তদন্তে এসেছে। তারা পেশাদার ও সৎ কর্মকর্তা হিসেবেই পরিচিত। নিরীহ কোনো কর্মকর্তা বা সদস্য অহেতুক হয়রানির শিকার হবেন না বলেও জানিয়েছে সদর দপ্তর।
আপনার মতামত লিখুন :