কোয়ারেন্টাইন, আইসোলেশন, লকডাউন শব্দগুলো যখন ভুলতে বসেছে দেশের মানুষ, তখন আবারও দেশজুড়ে শুরু হয়েছে এর নতুন ঢেউ। শুধু জুন মাসেই ভাইরাসটিতে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ২২ জন। পুরো মাসে আক্রান্ত হয়েছেন ১৩৪।
পাঁচ বছর আগে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়া মহামারি করোনাভাইরাস ফের নতুন রূপে ফিরে আসছে বলে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে সাধারণ মানুষের মধ্যে। কিন্তু তারপরও কারো মধ্যে নেই স্বাস্থ্যবিধি মানার তাগিদ। এমন পরিস্থিতিতে ভাইরাসটির নতুন ভ্যারিয়েন্ট যাতে মহামারি আকারে ছড়িয়ে না পড়ে, সে জন্য সরকারকে স্বাস্থ্যবিধি মানাতে কঠোরভাবে নির্দেশনা দেওয়া উচিত বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। আর শনাক্ত রোগীদের ক্ষেত্রে আবারও আইসোলেশন প্রক্রিয়া অনুসরণ করার তাগিদ তাদের।
আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণাকেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি) পরিচালিত সর্বশেষ কোভিড-১৯ সার্ভিলেন্স ‘ন্যাশনাল ইনফ্লুয়েঞ্জা সার্ভিলেন্স ও পিএইচওসি’ বিশ্লেষণে দেখা গেছে, চলতি বছরের মে থেকে দেশে করোনা সংক্রমণের হার উল্লেখযোগ্য হারে বাড়তে শুরু করেছে। জুন মাসে ১ হাজার ৪০৯ জন সম্ভাব্য কোভিড-১৯ রোগীর নমুনা পরীক্ষা করা হয়। এর মধ্যে ১৩৪ জন পজিটিভ শনাক্ত হন, যা পরীক্ষার ৯ দশমিক ৫১ শতাংশ। এটি ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৫ সালের মে সময়কালে সর্বোচ্চ হার। এর আগে ২০২৩ সালের মে-আগস্ট এবং ২০২৪ সালের জানুয়ারি-আগস্টে সংক্রমণের হার ছিল ১ দশমিক ৫ শতাংশের বেশি। যদিও সর্বশেষ পাওয়া করোনাভাইরাসের নমুনাগুলোর জিনোম সিকুয়েন্সিং করে ‘ওমিক্রন বিএ ২.৮৬’ ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত হয়েছে, যা এর আগেও দেশে শনাক্ত হয়েছিল। কিন্তু সম্প্রতি এটি নতুন রূপ নিচ্ছে বলে ধারণা করছেন বিশেষজ্ঞরা। আইসিডিডিআরবি চলতি বছর সংক্রমণ বৃদ্ধির অন্যতম কারণ হিসেবে নতুন দুটি সাব-ভ্যারিয়েন্ট এক্সএফজি এবং এক্সএফসি বৃদ্ধির তথ্য তুলে ধরেছে।
করোনাকাল পেরিয়ে পুরোপুরি স্বাভাবিক এখন বিশ্ব। তাই কোনো ধরনের স্বাস্থ্যবিধি মানার কোনো বালাই দেখা যায় না সাধারণ মানুষের মধ্যে। জনসমাগম তো দূরে থাক, হাসপাতালগুলোতেও কাউকে মাস্ক ব্যবহার করতে দেখা যায় না। এ ছাড়া করোনার প্রকোপ সাম্প্রতিক সময়গুলোতে কম থাকায় হাসপাতালগুলোতেও নেই করোনা রোগীদের জন্য আলাদা কোনো চিকিৎসার ব্যবস্থা। তাই বেশির ভাগ রোগীকে বাড়িতে থেকেই চিকিৎসা নিতে হচ্ছে। এর মধ্যে ডেঙ্গুর প্রকোপও বেড়েছে দেশজুড়ে।
জ্বরে আক্রান্ত বেশির ভাগ রোগীই ডেঙ্গু না করোনায় ভুগছেন, এটি চিহ্নিত করতে করতেই সময় পার হয়ে রোগীর অবস্থা খারাপ হয়ে মৃত্যু হচ্ছে জানিয়ে ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট টিবি হাসপাতালের প্রতিষ্ঠানপ্রধান ডা. আয়েশা আক্তার রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, আমরা সবাই মিলে ২০২০ সাল থেকে প্রায় ২০২৩ সাল পর্যন্ত করোনার একটা কঠিন সময় পার করেছি। তখন রোগীদের চিকিৎসায় সর্বোচ্চ চেষ্টা ছিল আমাদের। এখনো যদি রোগী বাড়ে আমরা সেবা দেওয়ার চেষ্টা করব। কিন্তু রোগীদের সচেতনতাটাও জরুরি। আমাদের হাসপাতালটা টিবি হাসপাতাল। যে রোগটি সবচেয়ে বেশি ছোঁয়াছে। এখানেও অনেক রোগী ও তাদের স্বজনরা আসছেন মাস্ক ছাড়াই। স্বাস্থ্যবিধির অন্যান্য বিষয় তো অনেক দূরে থাক, সাধারণ নিয়মগুলোও কেউ মানতে চাচ্ছেন না। তাহলে তো পরিস্থিতি খারাপের দিকেই যাবে।
একই অবস্থা ঢাকা মেডিকেলেরও। হাসপাতালটির মেডিসিন বিভাগের চিকিৎসক ডা. তুষার মাহমুদ বলেন, এই হাসপাতালে দেশের প্রায় সব এলাকা থেকে বিভিন্ন রোগ নিয়ে চিকিৎসা নিতে রোগীরা আসছেন। সাম্প্রতিক সময়ে যেহেতু জ্বরের প্রাদুর্ভাব বেড়েছে, তাই পরীক্ষা ছাড়া বোঝা যাচ্ছে না কোনটা করোনা বা কোনটা অন্য ভাইরাস। এ ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষ যদি হাসপাতালে আসার সময় বা জনসমাগম হয় এমন জায়গায় মাস্কের ব্যবহার করে, তাহলে মহামারি হবে না বলেই আশা করছি।
করোনা পরিস্থিতি বিষয়ে হেলথ অ্যান্ড হোপ স্পেশালাইজড হাসপাতালের পরিচালক ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, করোনা বা কোভিড-১৯ আবার বাড়তে শুরু করেছে। একই সঙ্গে ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, ভাইরাসজনিত জ্বর, শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণজনিত জ্বর, পানিবাহিত সংক্রমণজনিত জ্বর (যেমন টাইফয়েড) ইত্যাদি চলমান। এগুলোর সাথে করোনা যুক্ত হওয়ায় ভোগান্তি ও জীবনহানির সম্ভাবনা বেড়ে গেল। আমাদের পাশের দেশ ভারতে করোনা সংক্রমণ দ্রুত বাড়ছে। করোনার ওমিক্রন ধরনের কয়েকটি উপধরন দ্বারা এবার সংক্রমণ ছড়াচ্ছে। এই উপধরনগুলোর ছড়িয়ে পড়া বা মানুষকে আক্রান্ত করার ক্ষমতা বেশি। তবে রোগের তীব্রতা তৈরির ক্ষমতা অপেক্ষাকৃত কম। তবে যেকোনো সময় এই চরিত্রের পরিবর্তন হতে পারে। বয়স্ক মানুষ, দীর্ঘমেয়াদি জটিল রোগে আক্রান্ত মানুষ, শিশু, গর্ভবতী নারী এবং নানা কারণে যাদের শরীরের রোগপ্রতিরোধ শক্তি কম তারাই বেশি ঝুঁকিপূর্ণ।
এ জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বলেন, জনাকীর্ণ স্থানে অবশ্যই মাস্ক পরতে হবে। জ্বর হলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। দ্রুত সুস্থ হওয়ার জন্য জ্বরের ধরনটি শনাক্ত হওয়া জরুরি। স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব, করোনাসহ সব ধরনের জ্বরকে নিবিড় নজরদারিতে রাখা এবং জনসাধারণকে সময়ে সময়ে গাইড করা। ডা. লেলিন বলেন, করোনা জ্বর নিয়ে ফেসবুক বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কিছু মানুষ আতঙ্ক ছড়াছে; এসব গুজবে কান দেওয়ার দরকার নেই। এখনো দেশে করোনা বিষয়ে আতঙ্কিত হওয়ার মতো কোনো পরিস্থিতি তৈরি হয়নি।
তবে করোনার সংক্রমণ যাতে আর না বাড়ে এ জন্য স্বাস্থ্য বিভাগ কাজ করছে জানিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবু জাফর রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, আমরা ডেঙ্গুটা নিয়ে চিন্তিত ছিলাম। ডেঙ্গুর সংক্রমণ ইতিমধ্যে ৫ হাজার ছাড়িয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে হাসপাতালগুলোতে আলাদা ডেঙ্গু ওয়ার্ড করার যখন সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে, তখন করোনার এই ঊর্ধ্বমুখী সংক্রমণ ভাবাচ্ছে বেশি। আমরা সংক্রমণের গতি পর্যবেক্ষণ করছি। প্রয়োজনীয় নির্দেশনা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে দেওয়া হয়েছে। এখন জনগণের সচেতনতা সবচেয়ে জরুরি। জনসমাগমে যেন আমরা অবশ্যই মাস্কের ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারি, সেটা খেয়াল রাখতে হবে। আর জ¦র হলে সঙ্গে সঙ্গে পরীক্ষা করাতে হবে।
গত মাসেই স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এক বিশেষ বার্তায় জানিয়েছে, বিশ্বের বেশ কিছু দেশে কভিড-১৯-এর নতুন ভ্যারিয়েন্ট জেএন.১-এর সংক্রমণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এমতাবস্থায় উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে যেমন হাসপাতাল বা চিকিৎসাকেন্দ্র এবং উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ ব্যক্তি, যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম তাদের সতর্ক হিসেবে মাস্ক ব্যবহার করার পরামর্শ দেওয়া হলো। উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ ব্যক্তিদের চতুর্থ ডোজ ভ্যাকসিন নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হলো। সার্জারি অথবা অন্য কোনো রোগের চিকিৎসার ক্ষেত্রে শুধু কোভিড-১৯ লক্ষণ বা উপসর্গ থাকলে কোভিড-১৯ পরীক্ষা করার পরামর্শ দেওয়া হলো।
এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক অধ্যাপক ডা. হালিমুর রশিদ বলেন, পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন দেশে করোনার নতুন সাব-ভ্যারিয়েন্ট, বিশেষ করে ওমিক্রন এলএফ ৭, এক্সএফজি, জেএন-১ ও এনবি ১.৮.১-এর সংক্রমণ বাড়ছে। এ অবস্থায় আন্তর্জাতিক ভ্রমণকারীদের মাধ্যমে বাংলাদেশের সম্ভাব্য সংক্রমণ প্রতিরোধে ভারত ও অন্যান্য সংক্রামক দেশ এবং বাংলাদেশ থেকে ভারত ও অন্যান্য সংক্রামক দেশে ভ্রমণকারী নাগরিকদের জন্য দেশের সব স্থল, নৌ, বিমানবন্দরের আইএইচআর ডেস্কে নজরদারি জোরদার করতে হবে। পাশাপাশি ঝুঁকি মোকাবিলায় কিছু কার্যক্রম নিতে হবে।
আপনার মতামত লিখুন :