ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২৪ জুলাই, ২০২৫

আবেগকে পুঁজি করে নৈরাজ্য

সেলিম আহমেদ
প্রকাশিত: জুলাই ২৩, ২০২৫, ১১:২৯ পিএম
ছবি- রূপালী বাংলাদেশ

‘এই নিয়েছে ঐ নিল যাঃ! কান নিয়েছে চিলে, চিলের পিছে মরছি ঘুরে আমরা সবাই মিলে...’ কবি শামসুর রাহমানের ‘প-শ্রম’ কবিতার মতো গত দুই দিন রাজধানীর উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় অর্ধশতাধিক শিক্ষার্থীর লাশ গুম করা হয়েছে এমন খবরের পেছেনে ছুটেছিল মানুষ।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকসহ বিভিন্ন মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া এই খবরে গা ভাসিয়েছেন অনেকেই। গত মঙ্গলবার এই অভিযোগ এনে রাজধানীতে বিক্ষোভও করেছেন একদল শিক্ষার্থী। তবে সরকার, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির তরফ থেকে সাফ জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, কোনো শিক্ষার্থীর লাশ গুম করা হয়নি।

তারপরও কোনো শিক্ষার্থীকে খুঁজে পাওয়া না গেলে তাকে খুঁজতে সরকারের পক্ষ থেকে সব সহায়তা করা হবে। আহত, নিহত ও নিখোঁজদের প্রকৃত তালিকা করতে কমিটিও করেছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি। গতকাল বুধবার দিনভর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটিতে অবস্থান করলেও কোনো শিক্ষার্থীকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না এমন অভিযোগ নিয়ে আসেননি কেউ।

বিভিন্ন সূত্রও বলছে, খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না এমন কোনো অভিযোগ নেই। তবে ৬টি অজ্ঞাত লাশ শনাক্ত করতে স্বজনদের ডিএনএ’র নমুনা নেওয়া হয়েছে। এদের মধ্যে কয়েকটি মরদেহ এতটাই বিকৃত যে, ছেলে না মেয়ে বোঝারও উপায় নেই।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটিতে কতজন শিক্ষক-শিক্ষার্থী রয়েছেন তা তালিকাভুক্ত রয়েছে। এখানে লাশ গুম করার কোনো সুযোগ নেই। পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের নেতাকর্মীসহ একটি মহল পরিকল্পিতভাবে দেশকে অস্থিতিশীল করার জন্য এই গুজব ছড়িয়েছিল।

দেশের নামকরা মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের উত্তরার দিয়াবাড়ির স্থায়ী ক্যাম্পাসের বিদ্যালয় ভবনে গত সোমবার বেলা ১টা ১২ মিনিটে আকস্মিকভাবে বিমানবাহিনীর একটি যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয়। এই ঘটনায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, গতকাল বুধবার পর্যন্ত ২৯ জন মারা গেছেন এবং বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ৬৯ জন।

তবে গত মঙ্গলবার দুপুর পর্যন্ত সর্বশেষ হালনাগাদ তথ্যে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) জানিয়েছিল, এ ঘটনায় ৩২ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছেন ১৬৫ জন।

আইএসপিআরের সঙ্গে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যে গড়মিল নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী অধ্যাপক ডা. সায়েদুর রহমান জানিয়েছেন, উত্তরা আধুনিক মেডিকেল থেকে একজনের মৃতদেহ সিএমএইচে পাঠানো হয়েছে। সেই সংখ্যাটি নিয়ে আমাদের তথ্যের পার্থক্য দেখা দিয়েছে। আমরা বলেছি, সিএমএইচে ১৫ জনের মৃতদেহ আছে। যদিও আইএসপিআরের তথ্যে ১৬ জন বলা আছে। তথ্যের পার্থক্যগুলো দূর হতে একটু সময় লাগবে।

এ ছাড়া আইএসপিআরের তথ্যে লুবানা হাসপাতাল অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। ওই হাসপাতালের তথ্য সম্পর্কে যোগাযোগ করা হয়েছে। তাদের রেজিস্টারে কোথাও মৃত্যু নেই। কিন্তু তারা মুখে বলছেন, দুজনকে মৃত অবস্থায় তাদের অভিভাবকেরা নিয়ে এসেছিলেন। ওই দুজনের নাম পরে কোনো হাসপাতালে আসেনি।

এদিকে স্মরণকালের ভয়াবহ এই দুর্ঘটনায় অর্ধশতাধিক লাশ গুম করা হয়েছে এমন খবর গত মঙ্গলবার ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। এই খবরে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখান অনেকেই। মর্মান্তিক এই ঘটনার আবেগকে কাজে লাগিয়ে দিনভর চলে সমালোচনার ঝড়ও। যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয়ে হতাহতদের তথ্য গোপন করার অভিযোগ তুলে নিহতদের নাম-ঠিকানা প্রকাশ, আহতদের নির্ভুল তালিকা প্রকাশসহ ছয় দফা দাবিতে দিনভর কলেজ প্রাঙ্গণ ও আশপাশের এলাকায় বিক্ষোভ করেছে শিক্ষার্থীসহ সাধারণ মানুষ।

তারা হতাহতের সরকারি সংখ্যা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে। ‘নিয়ারলি হান্ড্রেড প্লাস ডেথ’, ‘লাশের নিরাপত্তা চাই’, ‘বিচার নয়, লাশের হিসাব চাই’, ‘সার্ভিং মার্ডার, হাইডিং কাউন্টস’ লেখা ফেস্টুন ও পোস্টার দেখা যায় বিক্ষোভরত শিক্ষার্থীদের হাতে। মিছিল ও স্লোগানে ওইদিন দিনভর উত্তপ্ত ছিল ক্যাম্পাস ও দিয়াবাড়ি এলাকা। ওইদিন সকাল সাড়ে ১০টার দিকে বিমান বিধ্বস্তের ঘটনাস্থল পরিদর্শন ও শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলতে মাইলস্টোন কলেজে যান সরকারের দুই উপদেষ্টা আসিফ নজরুল ও সি আর আবরার। সঙ্গে ছিলেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব ও প্রেস উইংয়ের এক সদস্য। এ সময় বিক্ষুব্ধ জনতা তাদের ৯ ঘণ্টা অবরুদ্ধ করে রাখেন। সন্ধ্যায় পুলিশ পাহারায় উত্তরা ছাড়েন তারা। 

এ ছাড়াও এ ঘটনায় ওইদিন সচিবালয়ে জোরপূর্বক প্রবেশ করে বিক্ষোভ করেন একদল শিক্ষার্থী। এ সময় সচিবালয়ে পুলিশের সঙ্গে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংঘর্ষে অন্তত শতাধিক আহত হয়েছেন। 

বিদ্যালয়টির একাধিক শিক্ষক, অভিভাবক ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ভয়াবহ এই দুর্ঘটনায় আহত ও নিহত সব শিক্ষার্থীকে উদ্ধার করা হয়েছে। আইএসপিআরের তথ্যমতে, নিহত ৩২ জনের মধ্যে ২৬ জনের লাশ হস্তান্তর করা হয়েছে। নতুন করে খোঁজ মিলছে না এমন কোনো তথ্য কারো কাছে নেই। হতাহত সবারই খোঁজ মিলেছে বলে দাবি তাদের। 

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, লাশ গুমের খবরটি পুরোটা গুজব। এটা পরিকল্পিতভাবে দেশকে অস্থিতিশীল করার জন্য করা হয়েছে। লাশ গুম হলে তার স্বজনরা কই গেলেন? তাদেরও কী গুম করা হয়েছে। যদি গুম করা না হয় তাহলে সন্তান নিখোঁজ দাবি নিয়ে আসছেন না কেন?

হতাহতের ‘প্রকৃত সংখ্যা’ নির্ধারণে কমিটি, নিখোঁজের খবর নিয়ে আসেনি কেউ।

যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয়ে নিহত, আহত ও নিখোঁজের ‘প্রকৃত সংখ্যা’ নির্ধারণে একটি কমিটি করেছে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ কর্তৃপক্ষ। গত মঙ্গলবার গঠিত ওই কমিটির বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, এই ঘটনায় ঘটনাস্থলে অনেক কোমলমতি ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক-কর্মচারী, অভিভাবক আহত ও নিহত হয়। এ ঘটনায় আহত, নিহত, নিখোঁজ শিক্ষার্থী ও অন্যদের প্রকৃত সংখ্যা নির্ণয় করে ঠিকানাসহ তালিকা প্রস্তুত করার জন্য কর্মকর্তা, অনুষদ সদস্য, অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠন করা হলো। কমিটি কাজ শেষ করে তিন কর্মদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দেবে বলেও উল্লেখ করা হয়েছে। 

কলেজের অধ্যক্ষ মোহাম্মদ জিয়াউল আলমকে সভাপতি করে গঠিত এ কমিটিতে সদস্য হিসেবে আছেন মো. মাসুদ আলম (উপাধ্যক্ষ-প্রশাসন), খাদিজা আক্তার (প্রধান শিক্ষিকা), লুৎফুন্নেসা লোপা (কো-অর্ডিনেটর), মনিরুজ্জামান মোল্লা (অভিভাবক), মারুফ বিন জিয়াউর রহমান (শিক্ষার্থী) ও মো. তাসনিম ভূঁইয়া (শিক্ষার্থী)।

এদিকে গতকাল দিনভর কলেজে অবস্থান করলেও কোনো শিক্ষার্থী, শিক্ষক বা অভিভাবক এই ঘটনার পর নিখোঁজ রয়েছেন, এমন অভিযোগ নিয়ে আসেননি। মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের এক শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, নিখোঁজ রয়েছেন এমন কোনো তথ্য তাদের কাছে নেই। 

হতাহতের সংখ্যা গোপন করা অসম্ভব: প্রেস সচিবপ্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেছেন, বড় বড় দুর্যোগ নিয়ে রিপোর্ট করা একজন হিসেবে আমি বলে দিতে পারি যে, বাংলাদেশে হতাহতের সংখ্যা গোপন করা কার্যত অসম্ভব।

তিনি গতকাল বুধবার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এক পোস্টে বলেন, ২০০২ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে অসংখ্য বড় বড় দুর্যোগ নিয়ে রিপোর্ট করা একজন হিসেবে আমি বলে দিতে পারি যে, বাংলাদেশে হতাহতের সংখ্যা গোপন করা কার্যত অসম্ভব। প্রাথমিকভাবে, পরিবারগুলো তাদের প্রিয়জনদের নিখোঁজ হিসেবে রিপোর্ট করে। তবে হাসপাতাল এবং কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে তথ্য পাওয়া গেলে তারা সাধারণত তাদের আত্মীয়দের শনাক্ত করতে পারে। এক্ষেত্রে মাইলস্টোন কলেজ প্রতিদিনের উপস্থিতির রেকর্ড ক্রস-রেফারেন্স করে হিসাব-বহির্ভূতদের শনাক্ত করতে পারে।

তিনি জানান, গতকাল (মঙ্গলবার) স্কুল পরিদর্শনের সময় স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে দুজন উপদেষ্টা স্কুল ক্যাম্পাসে একটি কন্ট্রোল রুম স্থাপনের নির্দেশ দেন। এই সুবিধাটি আহত এবং মৃতদের সংখ্যা সম্পর্কে নিয়মিত আপডেট সরবরাহ করবে।

মৃত্যুর সংখ্যা নিয়ে গুজব ছড়ানো হচ্ছে: আইএসপিআর

মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের মৃত্যুর সংখ্যা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক গুজব ছড়ানো হচ্ছে বলে জানিয়েছেন আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল সামি উদ দৌলা চৌধুরী। গতকাল বুধবার এক বার্তায় তিনি বলেন, সম্প্রতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে, মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের মৃত্যুর সংখ্যা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক গুজব ছড়ানো হচ্ছে। অনেকেই না বুঝে এসব গুজবে বিশ্বাস করছেন।

তিনি বলেন, ঘটনার পরপরই কোনো পূর্বনির্দেশনা ছাড়াই বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সর্বোচ্চ প্রচেষ্টার মাধ্যমে দ্রুত সাড়া দিয়েছে, যেমনটি সবসময় করে থাকে। আমাদের সন্তানদের বিষয়ে কোনো তথ্য গোপন করার ইচ্ছা বা প্রয়াস আমাদের নেই। আমি নিজে এবং আইএসপিআর টিম সরাসরি ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলাম।

অতএব, আইএসপিআরের পরিচালক হিসেবে আমি স্পষ্টভাবে ঘোষণা করছি, যেকোনো গণমাধ্যম চাইলেই এ বিষয়ে তদন্ত করতে পারে, সেনাবাহিনীসহ যে কাউকে ইন্টারভিউ করতে পারে বা সংশ্লিষ্ট যেকোনো স্থান পরিদর্শন করতে পারে। আমরা সর্বোচ্চ সহায়তা দিতে প্রস্তুত আছি এবং আপনাদের যেকোনো প্রয়োজনে সর্বাত্মকভাবে সহযোগিতা করব।

সার্বিক বিষয়ে শিক্ষা উপদেষ্টা সি আর আবরার বলেন, ঘটনাটা ঘটেছে একটা নির্দিষ্ট এলাকায়। যেখানে প্রতিটি ছাত্রের নাম তালিকাভুক্ত রয়েছে। শিক্ষকদের নাম রয়েছে, হাটেবাজারে বা রেল স্টেশনে এই ধরনের দুর্ঘটনা ঘটলে লাশ কাউন্ট করা মুশকিল হতো। আমরা ছাত্রদের তালিকা হস্তান্তর করতে স্কুল কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়েছি। সেখানে যদি কোনো শিক্ষার্থী মিসিং থাকে অবশ্যই কর্তৃপক্ষ সেটার জন্য দায়বদ্ধ। আমার জানা মতে এখনো এ ধরনের পরিস্থিতি হয়নি।