রাজধানীর মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের একটি ভবনে বিধ্বস্ত হয়েছে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর একটি ‘এফ-৭ বিজিআই’ মডেলের প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমান।
সোমবার (২১ জুলাই) দুপুর ১টা ১৮ মিনিটে ঘটে যাওয়া এই দুর্ঘটনার পরপরই ঘটনাস্থলে পৌঁছায় উদ্ধারকারী দল। দ্রুত শুরু হয় উদ্ধার অভিযান, যা এখনো চলমান রয়েছে।
উন্নত সংস্করণের যুদ্ধবিমান ছিল এটি?
চীনের তৈরি ‘এফ-৭/জে-৭’ সিরিজের সর্বশেষ ও উন্নত সংস্করণ হলো ‘এফ-৭ বিজিআই’। ২০১৩ সালে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর বহরে যুক্ত হয় মডেলটির ১৬টি বিমান।
মূলত হালকা ও উচ্চগতিসম্পন্ন এই যুদ্ধবিমানটির নকশা ও প্রযুক্তি সোভিয়েত ইউনিয়নের মিগ-২১ বিমানের ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছে এই বিমানগুলো।
চীনের চেংদু এবং গুইঝো এয়ারক্রাফট নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ১৯৬৫ সাল থেকে এই সিরিজের বিমান তৈরি করে আসছিল। বাংলাদেশকে বিমান সরবরাহের পর ২০১৩ সালেই সিরিজটির উৎপাদন বন্ধ করা হয়। মোট তৈরি হয়েছে প্রায় ২৪ শতাধিক বিমান।
‘এফ-৭ বিজিআই’ মূলত আকাশ থেকে আকাশে লড়াইয়ের জন্য ব্যবহৃত হলেও এটি মাটির কাছাকাছি ক্লোজ এয়ার সাপোর্ট অভিযানে ব্যবহারেরও সক্ষমতা রাখে।
স্বল্পপাল্লার ইনফ্রারেড নির্দেশিত ক্ষেপণাস্ত্র বহনে সক্ষম এই বিমানটি প্রথমে শুধুমাত্র চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মি পরিচালনা করলেও পরে পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, জিম্বাবুয়ে, তানজানিয়াসহ বহু দেশে রপ্তানি হয় এবং ব্যবহার করেও আসছে।
দুর্ঘটনার ইতিহাস ও প্রশ্নবিদ্ধ নিরাপত্তা
বাংলাদেশ বিমানবাহিনীতে দীর্ঘদিন ধরেই যুক্ত রয়েছে চীনা তৈরি ‘এফ-৭ বিজি’ ও ‘এফ-৭ বিজিআই’ সিরিজের প্রশিক্ষণ ও যুদ্ধবিমান। ২০০৬ সালে প্রথম চালানে চীন থেকে আনা হয় ১২টি ‘এফ-৭ বিজি’ এবং ৪টি ‘এফটি-৭ বিজি’।
এরপর ২০১১ সালে আরও উন্নত ‘এফ-৭ বিজিআই’ এবং ‘এফটি-৭ বিজিআই’ আমদানির চুক্তি হয়, যা ২০১২-১৩ সালের মধ্যে সরবরাহ সম্পন্ন হয়।
বাংলাদেশে প্রতিটি বিমান আনুমানিক ৫৯ লাখ মার্কিন ডলার ব্যয়ে কেনা হয়। ইঞ্জিন তৈরি হয়েছে রাশিয়ার প্রযুক্তি ব্যবহার করে, তবে বাকি অংশ নির্মিত হয় সম্পূর্ণভাবে চীনে। উন্নত সংস্করণে যুক্ত করা হয় ডিজিটাল ককপিট, হেডস-আপ ডিসপ্লে এবং উন্নত রাডার।
এফ-৭-এর যত দুর্ঘটনা
তবে এসব যুদ্ধবিমানের অতীত রেকর্ড খুব একটা আশাব্যঞ্জক নয়। বিগত এক দশকে ‘এফ-৭’ সিরিজের অন্তত তিনটি বড় দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন দক্ষ পাইলটরা।
২০০৮ সালের এপ্রিলে টাঙ্গাইলের ঘাটাইলের পাহাড়িপাড়া গ্রামে পাইলটসহ বিধ্বস্ত হয় একটি এফ-৭ প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমান। এতে নিহত হন স্কোয়াড্রন লিডার মোর্শেদ হাসান। দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে তখন সম্ভাব্য কারিগরি ত্রুটির কথা উল্লেখ করা হয়।
২০১৫ সালের জুনে এফ-৭ এমবি ৪১৬ মডেলের একটি যুদ্ধবিমান চট্টগ্রামে বঙ্গোপসাগরের উপকূলে বিধ্বস্ত হয়। নিখোঁজ হন পাইলট তাহমিদ রুম্মান। এটি বিমান বাহিনীর জহুরুল হক ঘাঁটি থেকে উড্ডয়ন করেছিল। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার কয়েক মিনিট পর যুদ্ধবিমানটি পতেঙ্গা সৈকতের প্রায় ৬ নটিক্যাল মাইল দূরে সাগরে বিধ্বস্ত হয়।
২০১৮ সালের নভেম্বরে প্রশিক্ষণের সময় টাঙ্গাইলের মধুপুরে বিধ্বস্ত হয় এফ-৭ বিজি। এতে নিহত হন পাইলট আরিফ আহমেদ। এয়ারক্রাফটটি ঢাকা থেকে উড্ডয়নের ২৫ মিনিটি পর মধুপুরের রসুলপুর এলাকায় বিধ্বস্ত হয়ে আগুন ধরে যায়।
তদন্ত হয়, কিন্তু প্রতিকার নেই
প্রতিটি দুর্ঘটনার পরই বিমানবাহিনী অভ্যন্তরীণ তদন্তের কথা জানালেও তা থেকে কী ধরনের নিরাপত্তা জোরদার বা সংস্কার করা হয়েছে, সে বিষয়ে প্রকাশ্যে কোনো তথ্য নেই।
বিমান ও প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের মতে, পুরোনো প্রযুক্তির ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা, নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণের অভাব এবং নিরাপত্তা সংস্কার পরিকল্পনার ঘাটতির কারণেই এ ধরনের দুর্ঘটনা ঘটছে।
বর্তমানে ‘এফ-৭ বিজিআই’ মডেলটি বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। সীমিত প্রযুক্তির হলেও এটি প্রশিক্ষণের জন্য এখনো নিয়মিত ব্যবহার করা হয়।
তবে একের পর এক দুর্ঘটনায় বিমানবাহিনীর সক্ষমতা, রক্ষণাবেক্ষণ এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে।