রবিবার, ১০ আগস্ট, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


মো. আফজাল হোসেন

প্রকাশিত: আগস্ট ১০, ২০২৫, ০১:৩৬ এএম

দুর্নীতি মোকাবিলায় অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা

মো. আফজাল হোসেন

প্রকাশিত: আগস্ট ১০, ২০২৫, ০১:৩৬ এএম

দুর্নীতি মোকাবিলায় অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা

সভ্যতার ইতিহাসে ন্যায় ও সত্যের পথচলা কখনোই সহজ ছিল না। যুগে যুগে মানুষ অন্ধকারের মধ্যে থেকেও আলো খুঁজেছে আবার অনেক সময় আলো থাকলেও অন্ধকারের মুখোমুখি হতে ভয় পেয়েছে। সমাজ যখন উন্নতির দিকে এগোয়, তখন তার ভিতের সবচেয়ে বড় শত্রু হয়ে ওঠে দুর্নীতি ও সামাজিক অসঙ্গতি।

এগুলো ধীরে ধীরে মানুষের আস্থাক্ষয় করে, প্রজন্মের স্বপ্ন নষ্ট করে এবং নৈতিক ভিত্তি ভেঙে দেয়। এই অন্ধকারে আলো জ্বালানোর একটি শক্তিশালী হাতিয়ার হলো অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা। এটি এমন এক ধারার সংবাদকর্ম, যেখানে কেবল দৃশ্যমান ঘটনা নয় ঘটনার পেছনের সত্য, কারণ এবং প্রেক্ষাপট উন্মোচনের চেষ্টা করা হয়। একজন অনুসন্ধানী সাংবাদিক সেই জায়গায় পৌঁছান, যেখানে সাধারণ চোখ পৌঁছায় না; তিনি এমন সব প্রশ্ন করেন, যা অনেকেই করতে সাহস পান না; আর সবশেষে তিনি এমন একটি আয়না তৈরি করেন, যেখানে সমাজ নিজের মুখ দেখতে পায়।

দুর্নীতি ও অসঙ্গতি: নীরব ছায়ার বিস্তার
দুর্নীতি কোনো একদিনে জন্ম নেয় না। এটি ছোট ছোট আপসের মধ্য দিয়ে, অবহেলিত অনিয়মের মধ্যে দিয়ে ধীরে ধীরে বড় হয়। স্কুলে ভর্তি নিয়ে অস্বচ্ছতা, জনসেবায় বিলম্ব, প্রকল্পের বাজেটে অনিয়ম সবই দুর্নীতির নানা রূপ। একসময় এই অসঙ্গতি সামাজিক সংস্কৃতির মতো প্রভাব বিস্তার করে, যেন এটি অস্বাভাবিক নয় বরং স্বাভাবিক একটি প্রক্রিয়া।

অন্যদিকে, সামাজিক অসঙ্গতি শুধু অর্থনৈতিক নয় এতে অন্তর্ভুক্ত হয় বৈষম্য, অবিচার, অবহেলা এবং সুযোগের অসম বণ্টন। যখন একটি শ্রেণি অযৌক্তিক সুবিধা পায় এবং আরেকটি শ্রেণিবঞ্চিত হয়, তখন সামাজিক অসন্তোষ জন্ম নেয়। এ অবস্থায় মানুষের আস্থা ভেঙে যায়, যা উন্নয়নের পথে বড় বাধা।

এ নীরব ছায়াগুলো দূর করতে প্রয়োজন চোখ খোলা রাখা এবং সেটি ব্যক্তিগত পর্যায়ে সম্ভব হলেও, গণমাধ্যমের মাধ্যমে এটি সামাজিক শক্তিতে রূপ নেয়। অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা সেই সামাজিক শক্তির প্রধান চালিকা।

অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার প্রকৃতি ও শক্তি
অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা একটি ধীর, নিখুঁত এবং সাহসী কাজ। এর জন্য শুধু তথ্য সংগ্রহ নয়, তথ্যের উৎস যাচাই, প্রমাণ সংগ্রহ, প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ এবং পাঠকের কাছে বোধগম্যভাবে উপস্থাপন করা জরুরি।

এ ধারার প্রতিবেদনের কিছু মৌলিক বৈশিষ্ট্য হলো
১. দীর্ঘমেয়াদি পর্যবেক্ষণ ও গবেষণা একটি প্রতিবেদনের জন্য সাংবাদিক মাসের পর মাস তথ্য সংগ্রহ করতে পারেন।
২. প্রমাণভিত্তিক উপস্থাপনা, অনুমান নয়, বরং তথ্য ও দলিল দ্বারা সমর্থিত বক্তব্য।
৩. সমস্যার উৎস খোঁজা, কেবল ফল নয়, কারণ পর্যন্ত পৌঁছানো।
৪. সমাধানমুখী প্রস্তাব, পাঠক যেন শুধু সমস্যা দেখে হতাশ না হন, বরং আশার আলো পান।

ইতিবাচক পরিবর্তনের উদাহরণ
বিশ্বজুড়ে অসংখ্য ঘটনা রয়েছে, যেখানে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন এনেছে। উদাহরণস্বরূপ এক দেশে একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন জনস্বাস্থ্য খাতে ভেজাল ওষুধের বিষয়টি প্রকাশ করে; ফলে সরকার দ্রুত আইন সংস্কার করে, উৎপাদন মানোন্নয়নের উদ্যোগ নেয় এবং সাধারণ মানুষও ওষুধ কেনার ক্ষেত্রে সচেতন হয়।
বাংলাদেশেও দেখা গেছে, নদী দখল, পরিবেশদূষণ, সড়ক নিরাপত্তা, কিংবা শিক্ষা খাতে অনিয়ম নিয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশের পর সমাজে তুমুল আলোচনা হয় এবং প্রায়ই নীতিনির্ধারকরা নতুন পদক্ষেপ নেন। এটাই অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার শক্তি এটি মানুষকে শুধু জানায় না, নড়িয়ে দেয়।

সমালোচনার পরিবর্তে সমাধান
অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার বড় গুণ হলো এটি চাইলে পুরোপুরি গঠনমূলক হতে পারে। অর্থাৎ, সমস্যার বিবরণ দেওয়ার পাশাপাশি সমাধানের পথও দেখাতে পারে। যেমন যদি কোনো এলাকায় বিশুদ্ধ পানীয় জলের সংকট নিয়ে প্রতিবেদন হয়, তবে প্রতিবেদনে শুধু সংকটের ছবি নয়, সম্ভাব্য সমাধান, প্রযুক্তির ব্যবহার, সফল কোনো অঞ্চলের উদাহরণও থাকতে পারে।

এভাবে সাংবাদিকতা শুধু সমস্যার আয়না নয়, সমাধানের মানচিত্রও হয়ে ওঠে। তখন পাঠকও সমস্যাকে অজেয় মনে করেন না; বরং ভাবেন ‘হ্যাঁ, পরিবর্তন সম্ভব।’

নৈতিকতা ও দায়িত্বশীলতা

অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা যেমন শক্তিশালী, তেমনি সংবেদনশীল। এখানে ভুল তথ্য দিলে বা প্রমাণ ছাড়া অভিযোগ করলে এর প্রভাব দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে, যা ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের জন্য অন্যায় হয়ে যাবে। তাই নৈতিকতার প্রশ্নটি এখানে সর্বোচ্চ গুরুত্ব পায়।
দায়িত্বশীল সাংবাদিক কখনোই তথ্য যাচাই ছাড়া প্রকাশ করেন না; তিনি সূত্রের গোপনীয়তা রক্ষা করেন; এবং উপস্থাপনার ভাষা এমন রাখেন, যাতে কারো সুনাম অযথা ক্ষুণœ না হয়। এ দায়িত্ববোধই অনুসন্ধানী সাংবাদিকতাকে টেকসই করে।

প্রযুক্তি যুগে নতুন দিগন্ত
ডিজিটাল প্রযুক্তি অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার জন্য নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে। এখন সাংবাদিকরা স্যাটেলাইট ছবি, অনলাইন ডেটাবেস এবং বিশ্লেষণমূলক সফটওয়্যার ব্যবহার করে জটিল তথ্য সহজে বিশ্লেষণ করতে পারেন। সোশ্যাল মিডিয়া থেকেও সূত্র পাওয়া যায়, যদিও সেখানে ভুয়া খবরের ঝুঁকি বেশি, তাই যাচাই অপরিহার্য।
প্রযুক্তি শুধু তথ্য সংগ্রহ সহজ করেনি পাঠকের কাছে তথ্য পৌঁছানোর গতিও বাড়িয়েছে। ভিডিও প্রতিবেদন, ইন্টারঅ্যাকটিভ গ্রাফিক্স বা ডেটা জার্নালিজম সবই অনুসন্ধানী সাংবাদিকতাকে আরও জীবন্ত করে তুলছে।

সামাজিক অংশগ্রহণের গুরুত্ব
অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার সাফল্য একা সাংবাদিকের ওপর নির্ভর করে না, এটি সমাজের অংশগ্রহণের ওপরও নির্ভরশীল। অনেক সময় সাধারণ মানুষই এমন তথ্য দেন, যা বড় একটি প্রতিবেদনের সূত্র হয়ে দাঁড়ায়। তাই নাগরিকদের সচেতনতা এবং সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে সহযোগিতা জরুরি।
পাঠক যদি সমস্যা দেখে নীরব না থেকে গণমাধ্যমকে জানান, আর গণমাধ্যম যদি দায়িত্বশীলভাবে তা যাচাই করে প্রকাশ করে, তবে দুর্নীতি ও অসঙ্গতি টিকতে পারবে না।

আলো ছড়াবার অঙ্গীকার
দুর্নীতি ও সামাজিক অসঙ্গতি মোকাবিলায় অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা কেবল একটি পেশা নয়, এটি একটি সামাজিক অঙ্গীকার। এর প্রতিটি প্রতিবেদন হতে পারে ন্যায়ের বীজ, প্রতিটি তথ্য হতে পারে পরিবর্তনের সূচনা।
আমরা যদি চাই, সমাজে সত্য, স্বচ্ছতা ও ন্যায় প্রতিষ্ঠিত হোক, তবে গণমাধ্যম, নীতিনির্ধারক এবং সাধারণ মানুষ সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার আলো যতদূর ছড়াবে, দুর্নীতি ও অসঙ্গতির অন্ধকার ততটাই সরে যাবে।

মো. আফজাল হোসেন কলামিস্ট, বিশ্লেষক ও সাংবাদিক

Shera Lather
Link copied!